বেঁচে থাকার মহত্তম উদ্দেশ্যটা খুজে ফিরছি
গত কয়েক মাস জুড়েই অনলাইনস্ফিয়ার আর মিডিয়ায় তুমুল প্রতিবাদ চলছে রামপালের বিদ্যুত্ কেন্দ্র তৈরীর বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রের একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে সব ঝুট ঝামেলা (!) এড়িয়ে ক্ষমতাসীনদের লুটপাটের বিরুদ্ধে চোখ বন্ধ করে চলতেই পছন্দ করি বরাবর। আজ হঠাত্ তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির একটা বুকলেট হাতে পড়ার পর টের পেলাম কতটা জাতীয় স্বার্থবিরোধী এই চুক্তি।
গত ২০শে এপ্রিল২০১৩ বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান উপলক্ষে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি, বাস্তবায়ন চুক্তি, ও যৌথ উদ্যোগ চুক্তির সম্পূরক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে এক পক্ষ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড(পিডিবি) এবং অন্য পক্ষ ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কর্পোরেশন(এনটিপিসি) ।
এতে পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই মংলা সমুদ্র বন্দরের কাছে রামপালের ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহন এবং বালু ভরাটের কাজ শুরু হয়।
এটি রামপালের প্রথম পর্যায়ের কেন্দ্র। পরবর্তীতে এখানে একই ক্ষমতা সম্পন্ন আরও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হবে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৭০ ভাগ অর্থ আসবে বিদেশী ঋণ থেকে বাকি ৩০ ভাগের ১৫ ভাগ বাংলাদেশ থেকে এবং বাকি ১৫ ভাগ ভারত থেকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে পুরো ঋণের সমস্ত সুদ এবং দায়- দায়িত্ব বাংলাদেশ বহন করলেও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকানা ৫০ ভাগ ভারতের এবং ৫০ ভাগ বাংলাদেশের।
পিডিবি এবং এনটিপিসি’ র মধ্যে সমঝোতা অনুসারে আমদানি করা কয়লার দাম যদি প্রতি টন ১০৫ ডলার হয় তবে ইউনিট প্রতি ৫ টাকা ৯০ পয়সা দরে অথবা কয়লার দাম যদি প্রতি টন ১৪৫ ডলার হয় তবে ইউনিট প্রতি ৮ টাকা ৮৫ পয়সা দরে বিদ্যুৎ ক্রয় করবে বাংলাদেশ। এবং পিডিবির কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয় এনটিপিসি ও পিডিবি ইতিমধ্যেই প্রতি টন ১৪৫ ডলার দরে কয়লা আমদানি চূড়ান্ত করে ফেলেছে এর ফলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুত্ মূল্য পড়বে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা।
অথচ ২০ ডিসেম্বর ২০১১ তে ওরিয়ন গ্রুপের সাথে পিডিবি যে চুক্তি করে সে অনুযায়ী একই রকম আমদানি করা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ৫২২ মেগাওয়াটের একটি হবে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় এবং খুলনার লবনচরা ও চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ২৮৩ মেগাওয়াটের ২ টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে। মাওয়া থেকে সরকার ৪ টাকা এবং বাকি দুটি থেকে ৩ টাকা ৮০ পয়সা দরে সরকার বিদ্যুৎ ক্রয় করবে বলে চুক্তিতে বলা হয়।
মোট টাকার অঙ্কে এই প্রজেক্টের ক্ষতি পিলে চমকানোর মত।
যেখানে সমসাময়িক একই রকম আমদানি করা কয়লাভিত্তিক একাধিক ক্ষুদ্র প্রজেক্টের জন্য বিদ্যুতের সর্বোচ্চ খুচরা মুল্য (কিলোওয়াট-আওয়ার ইউনিট) ৪ টাকা, সেখানে এই প্রকল্পের বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি মূল্য ৮.৮৫ টাকা। অর্থাত্ ইউনিট প্রতি অতিরিক্ত ৪. ৮৫ টাকা ক্ষতি হবে এবং দৈনিক ২০ ঘন্টা ধরে ৩০ বছর এই কেন্দ্র চালু থাকার পর মোট ১ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি গুনতে হবে। এর সাথে যোগ করতে হবে সুন্দরবন ধ্বংসের দরুন জনগনের বিশাল অংকের ক্ষতি।
মনে হতে পারে প্রাকৃতিক ক্ষতিই বা কতটুকু। সুন্দরবনেরপাশে রামপালে যেমন ১৪ কিমি দূরত্বের কথা বলে আশ্বস্ত করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ফায়েত্তি কাউন্টিতে ১৯৭৯-৮০ সালে ১২৩০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত কেন্দ্রের সময়ও একইভাবে আশ্বস্ত করা হয়েছিল।
ফলাফল সাথে সাথে বুঝা না গেলেও ধীরে ধীরে পেকান বৃক্ষ মরতে শুরু করে। ২০১০ সালের হিসেবে বিদ্যুত্ কেন্দ্রের কারনে সালফার ডাইঅক্সাইডের নিঃসরনে পেকান, এলম,ওক সহ বিভিন্ন গাছ আক্রান্ত হয় এবং বহু পেকান বাগান ধ্বংস হয়ে যায়। সালফার আর এসিড বৃষ্টির ফলে হাইওয়ে ২১ এর ৪৮ কিমি এলাকাজুড়ে এর ক্ষতিকর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এ বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে বছরে ৩০ হাজার টন সালফার ডাই অক্সাইড নির্গমনের ফলেই যদি এ অবস্থা হয় তবে সুন্দরবনের মাত্র ১৪ কিমি দূরবর্তী রামপাল থেকে বছরে ৫২ হাজার টন সালফার ডাই অক্সাইড নির্গত হলে পরিবেশগত স্পর্শকাতর সুন্দরবনেরঅবস্থা সহজেই অনুমেয়।
এছাড়া এই বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে বছরে প্রায় ৭৯ লক্ষ টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হবে যা প্রায় ৩৪ কোটি গাছ কেটে ফেলার সম পরিমাণ ক্ষতি হবে এছাড়া মার্কারী, আর্সেনিক এবং সীসার ক্ষতিকর প্রভাবে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হবে আশে পাশের প্রাণী এবং পরিবেশ।
এছাড়া বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য ব্যবহৃত কয়লা থেকে বছরে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার টন ফ্লাই এশ এবং ২ লক্ষ টন বটম এশ তৈরী হবে যার মাধ্যমেও ব্যাপক মাত্রায় দুষণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া বিদ্যুত কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি শীতলায়ন সহ অন্যান্য কাজের জন্য সুপেয় পানি ব্যবহার করতে হবে অথবা পশুর নদী থেকে ঘন্টায় ৪০০০ ঘনমিটার হারে পানি প্রত্যাহার করতে হবে যা শুকনো মৌসুমের জন্য পরিবেশগত সমস্যার কারন হতে পারে। এছাড়া সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে দৈনিক গড়ে ১৩ হাজার টন কয়লা পরিবহন করতে হবে। অগভীর নদী হওয়াতে ছোট ও মাঝারি মানের প্রচুর সংখ্যক নৌযান ব্যবহার করতে হবে এবং এতে পরিবেশগত দূষনের সাথে বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম তার স্বাভাবিক মাত্রা ধরে রাখতে পারবে না। এসব নৌযান থেকে কয়লা, পোড়া ডিজেল নদীতে দূষনের সৃষ্টি করবে সাথে শব্দ এবং বায়ুদূষণ তো থাকছেই।
যে ভারতীয় এনটিপিসি বাংলাদেশে সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মান করতে যাচ্ছে তার নিজের দেশেই ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশন এক্ট ১৯৭২ অনুযায়ী বিদ্যুত্ কেন্দ্রের ১৫ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে এবং পরিবেশ ও বনমন্ত্রনালয়ের গাইড লাইন ম্যানুয়াল ২০১০ অনুযায়ী কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্রের ২৫ কিমির মধ্যে কোন বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম কিংবা বনাঞ্চল থাকা চলবে না। ২০১০ এ মধ্যপ্রদেশে এনটিপিসির এক হাজার একর জমির উপর ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ প্রকল্প বাতিল করে দেয়া হয় কৃষিজমির ক্ষতির কারনে সেখানে আমাদের দেশের ১৮৩৪ একরের প্রকল্পের ৯৫ ভাগই কৃষি জমি। এছাড়া কর্ণাটকের রাজিব গান্ধী ন্যাশনাল পার্কের ২০ কিমি দূরে ১০০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত্ কেন্দ্রের অনুমোদন ও বাতিল করা হয় ভারতীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের গাইডলাইন অনুসারে। যে ভারতীয় এনটিপিসি তার দেশে সুন্দরবনের দশ ভাগের এক ভাগ আয়তনের বনের বিশ কিমি এর মধ্যে তাপ বিদ্যুত্ কেন্দ্রের অনুমোদন পায় না সেই ভারতীয় কোম্পানীকে সুন্দরবন ধ্বংস করে তাপ বিদ্যুত্ কেন্দ্র করার অনুমতি কেন দেয়া হল? অর্থনৈতিকভাবে এত লোকসান দিয়ে রামপালের স্থানীয় মানুষদের তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে কার স্বার্থে এই বিদ্যুত্ কেন্দ্র? আমরা আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে অবশ্যই সুসম্পর্ক চাই। কিন্তু তা হতে হবে সকল ক্ষেত্রে সমতা,নায্যতা এবং আত্মসম্মানবোধ বজায় রেখে।
নতজানু পররাষ্ট্রনীতি কিংবা বানিজ্যিক নীতির মাধ্যমে সেটা অর্জন করা সম্ভব নয় কখনোই। সুন্দরবন রক্ষায় লং মার্চ সফল হোক। অবিলম্ব জাতীয় স্বার্থ বিরোধী রামপালের তাপ বিদ্যুত্ কেন্দ্রের প্রকল্প বাতিল করা হোক।
তথ্যসূত্র: তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত্বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির বুকলেট; বর্ধিত সংস্করন আগস্ট ২০১৩ ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।