প্রকৃত আলোয় আলোকিত হউক সবার হৃদয়।
তিউনিশিয়ার সফল বিপ্লবের পথ ধরে একই পথে এগিয়ে এসেছে অন্যান্য আরব দেশের জনগন। এ তালিকায় আছে ইয়েমেনের নাম। আসে সুদান। কিন্তু যে দেশটির জনগণ সারা বিশ্বের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে তা হলো মিশর।
নীল নদের দেশ মিশরের রাস্তা-ঘাট আজ মুক্তিকামী জনতার পদভারে মুখরিত। অসংখ্য আযাদী প্রিয় জনতার পবিত্র রক্তে রঞ্জিত। হোসনী মোবারকের ৩০ বছরের স্বৈরসাশনের অবসান এখন সময়ের ব্যপার মাত্র। এ গণবিপ্লব নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষের উদ্বেগ উতকণ্ঠা লক্ষনীয়। আমরাও জানতে আগ্রহী মিশরের জনগণের এ মহান আন্দোলন সম্পর্কে।
কারা আছে এ আন্দোলনের পেছনে? সেখানকার সেনাবাহিনী, প্রধান বিরোধি দল মুসলিম ব্রাদারহুড, নোবেল বিজয়ী মোহাম্মদ এল বারাদি, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ওয়াফাদা কাদের কী ভূমিকা? তাদের প্রতিবেশি ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল, বিশ্ব মোড়ল আমেরিকা, অন্যান্য আরব রাষ্ট্র কে কী ভাবছে? এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক আলফাজ আনামের তিউনিসিয়া ও মিসর বিপ্লব: আরব বিশ্বে নতুন যুগের সূচনা কলামটি শেয়ার করলাম সামহোয়ার এর ব্লগারদের সাথে।
তিউনিসিয়া ও মিসর বিপ্লব: আরব বিশ্বে নতুন যুগের সূচনা
আলফাজ আনাম
তিউনিসিয়া থেকে ইয়েমেন। উত্তর আফ্রিকা আর আরব বিশ্বের দেশগুলোতে এখন রাজনৈতিক পরিবর্তনের আন্দোলন গণজাগরণে রূপ নিয়েছে। তিউনিসিয়ায় বেন আলী সরকারের পতন আর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর আলজেরিয়া, মিসর, জর্ডান আর সুদানে চলছে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। ইতোমধ্যে তিউনিসিয়ার প্রধান রাজনৈতিক দল আল নাহাদার নেতা রশিদ ঘানুশি ২২ বছর নির্বাসনে থাকার পর দেশে ফিরে এসেছেন।
একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের মাধ্যমে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। তবে মিসরের পরিস্থিতি এখন সবচেয়ে উত্তপ্ত। গত আট দিনের আন্দোলনের শেষ পর্যন্ত একটি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যাচ্ছে। যদিও তিউনিসিয়ার মতো দ্রুত ৩০ বছরেরও বেশি সময় থেকে ক্ষমতাসীন মোবারক সরকারের পতন কিংবা সামরিক স্বৈরশাসনের চূড়ান্ত অবসান ঘটবে এমনটা আশা করা যায় না। আন্দোলনের যে গতিপ্রবাহ তাতে ৮২ বছরের বৃদ্ধ হোসনি মোবারকের পক্ষে ক্ষমতায় থাকা যে সম্ভব হবে না, তা অনেকটা নিশ্চিত।
মিসরে যেকোনো পরিবর্তনে দেশটির বিরোধী রাজনৈতিক দল আর সেনাবাহিনীর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, সৌদি আরব ও ইসরাইলের নানামুখী ভূমিকা থাকবে। যদিও হোসনি মোবারক এখন কালক্ষেপণের নীতি অবলম্বন করছেন। বলেছেন, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় থাকতে চান। আর এতে পশ্চিমা দেশগুলোরও সমর্থন রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ, এই সময়ের মধ্যে তাদের অনুগত লোকদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া যাবে।
এখন তিনি মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন এনে ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করছেন। সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না এমন ঘোষনাও দিয়েছেন, কিন্তু সরকারবিরোধী আন্দোলনে তাতে কোনো প্রভাব পড়ছে না। এখন বিক্ষোভ দমনে মোবারক পেটোয়া বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছেন। অপরদিকে সেনাবাহিনী ঘোষণা দিয়ে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। ইতোমধ্যে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো লক্ষাধিক লোকের সমাবেশে জানিয়ে দিয়েছেন হোসনি মোবারকের পতনের পরই শুধু পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
তার পতন না হওয়া পর্যন্ত বিক্ষোভ সমাবেশ ও সাধারন ধর্মঘট চলবে। অনেক বিক্ষোভকারী তার বিচার দাবি করেছে।
কারা আছে আন্দোলনে
তিউনিসিয়া আর মিসরে যখন সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, তখন গণমাধ্যমগুলোর ধারণা ছিল না বিক্ষোভের রূপ এতটা ভয়াবহ হবে। ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক আর টুইটারের মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে আন্দোলন হচ্ছে এমন ধারণাই দেয়া হচ্ছিল। প্রযুক্তি তো আন্দোলন করে না এর পেছনে কেউ না কেউ থাকে।
যদিও পশ্চিমা দেশগুলো প্রথম দিকে ভেবেছিল ফেসবুকের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনে হোসনি মোবারকের ওপর কিছুটা চাপ সৃষ্টি হবে, তা শেষ পর্যন্ত পশ্চিমা স্বার্থেই কাজে লাগানো যাবে। সময় যতই গড়িয়েছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে, এই আন্দোলনের পেছনে রাজনৈতিক শক্তি প্রধান নিয়ামক ভূমিকা পালন করছে। এতে মূল ভূমিকা পালন করেছে দেশটিতে নিষিদ্ধ ইসলামপন্থী সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুড। ইন্টারনেটের মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত করছে ‘৬ এপ্রিল মুভমেন্ট’ নামে একটি সংগঠন। যাদের রাজনৈতিক পরিচয় এখনো গোপনীয় রয়েছে।
এ ছাড়া ‘ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর চেঞ্জ’ নামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবীদের একটি মোর্চাও আন্দোলন গড়ে তুলতে কাজ করেছে। এই সংগঠনের মুখপাত্র হিসেবে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এলবারাদিকে সামনে আনা হয়। এই মোর্চায় মুসলিম ব্রাদারহুডের সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে। আলঘাদ নামে আরেকটি রাজনৈতিক দলও এই মোর্চায় রয়েছে। ওয়ফাদা পার্টি নামে সেকুলার আরেকটি রাজনৈতিক দল মিসরে রয়েছে।
দলটি গত নির্বাচন বর্জন করলেও অতীতে মোবারক সরকারের সাথে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু এই দলের জনসমর্থন খুবই সামান্য।
মুসলিম ব্রাদারহুড
আরব আর উত্তর আফ্রিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ান আল মুসলিমিনের নেতৃত্বে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে। সংগঠনটি এখনো মিসরে নিষিদ্ধ। নাম আলাদা হলেও মুসলিম ব্রাদারহুড ও তিউনিসয়ায় আল নাহাদার রাজনৈতিক দর্শন অভিন্ন।
জন্মের পর থেকে সংগঠনটি সব আরব দেশে ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসকদের রোষানলে পড়েছে। মিসরে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের জন্ম হয়েছিল ১৯২৮ সালে, যা দ্রুত আরব দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। দলটির প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল বান্না। যিনি শুধু রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, জনকল্যাণমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে সমগ্র আরব বিশ্বে ইখওয়ানকে জনপ্রিয় রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম হন। কার্যত আরব বিশ্বে ঔপেনিবেশিক শাসন পরবর্তী ইসলামের রাজনৈতিক আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি তিনি তৈরি করে গেছেন।
১৯৪০ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে হাসান আল বান্নার এই দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অজ্ঞাত পরিচয় এক বন্দুকধারীর গুলিতে হাসান আল বান্নাকে হত্যা করা হয়। ধারণা করা হয়, ইখওয়ানের রাজনৈতিক আন্দোলন দমনের অংশ হিসেবে তাকে হত্যা করা হয়। এর পর থেকে মিসরের প্রত্যেক সামরিক শাসকদের দিয়ে নিপীড়নের শিকার হয়েছে দলটির নেতাকর্মীরা। জামাল আব্দুল নাসেরের স্বৈরশাসনের অবসানে আনোয়ার সাদাতের ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্টের প্রতি ইখওয়ানের সমর্থন ছিল।
কিন্তু আনোয়ার সাদাত ক্ষমতায় আসার পর অল্প কিছু দিন ইখওয়ানকে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর অনুমতি দেয়া হলেও আবারো দলটি নিষিদ্ধ করা হয়। এর আগে ১৯৫৪ সালে জামাল আব্দুল নাসেরের ওপর আক্রমণের অভিযোগ এনে দলটি নিষিদ্ধ করা হয়। হাজার হাজার ইখওয়ান নেতাকর্মীকে জেলে পোরা হয়। ইখওয়ানের শীর্ষস্থানীয় ছয়জন নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়। এর মধ্যে ছিলেন অপর প্রভাবশালী নেতা সাইয়েদ কুতুব।
ইসলামের রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নিয়ে সাইয়েদ কুতুবের বইগুলো এখনো এই রাজনৈতিক বিশ্বাসীদের কাছে সমান গ্রহণযোগ্য। যিনি শুধু মিসর নয়, গোটা বিশ্বে ইসলাম বিষয়ে একজন পণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
দীর্ঘ সময় নিষিদ্ধ থাকার পর ১৯৮০ সালে ইখওয়ান আবারো মূলধারায় ফিরে আসে। ওয়াফদ পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে জোটবদ্ধ হয়। ইখওয়ানের ওপর অব্যাহত নিপীড়ন ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উত্থানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণে এই দলের একটি অংশ আশির দশকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেয়।
যদিও তাদের সংখ্যা ছিল খুবই সামান্য।
১৯৮১ সালে ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরে বিক্ষুব্ধ সৈনিকের হাতে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা’দাত প্রাণ হারানোর পর তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সে সময় থেকে যে জরুরি অবস্থা তিনি জারি করেছিলেন তা ৩০ বছর ধরে চলে এসেছে। প্রথমে পাঁচ বছর এবং পরে সাত বছর মেয়াদের জন্য তিনি বারবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, যেখানে কারো প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ ছিল না। সর্বশেষ নির্বাচনে ২০০৪ সালে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ রেখেছিলেন।
২০০৪ সালের সব শেষ নির্বাচনে তিন কোটি ২০ লাখ রেজিস্টার্ড ভোটারের ২৭ শতাংশ অংশ নেন। আর ৭৫ শতাংশ ভোট তারা হোসনি মোবারকের পক্ষে দিয়েছেন বলে দেখানো হয়। অর্থাৎ দেশটির মাত্র ২০ শতাংশ ভোটারের রায় নিয়ে মোবারক এখন প্রেসিডেন্ট। তখন যিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তাকে নির্বাচনের পরপরই জেলে ঢোকান মোবারক। একই সাথে তার দলকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করার পদক্ষেপ নেন।
গত ৩০ বছরে তিনি কোনো সময় জনগণের সামনে আসেননি। জনগণ তার চেহারা দেখে রেডিও টিভিতে। সংসদকে তিনি বানিয়েছেন নিজ ইচ্ছায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে। আনোয়ার সাদাতের পথ ধরে তিনি মিসরের বৃহত্তম বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করেন। এর সদস্যরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে বিগত সংসদে ৮২টি আসনে জয়ী হয়েছিলেন।
ইখওয়ানের এই সাফল্যে ভীত হয়ে পড়েন মোবারক। গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে ব্রাদারহুডের একজন সদস্যও যেনো সংসদে আসতে না পারেন তার জন্য সব ব্যবস্থা করেন। প্রথম দফা নির্বাচনের অবস্থা দেখে মুসলিম ব্রাদারহুড নির্বাচন বয়কট করে।
মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে যাতে এই দলের সমর্থক নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সে জন্য সংবিধান সংশোধন করা হয়। মূলত জালিয়াতির নির্বাচনের পর থেকে হোসনি মোবারক সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ ফুঁসে উঠতে থাকে।
ইখওয়ানের রাজনৈতিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে হোসনি মোবারকের দমনমূলক কর্মকাে র বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো পুরোপুরিভাবে অবগত ছিল। গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ কিংবা নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কখনই মোবারক সরকারের সমালোচনা বা চাপ প্রয়োগ করেনি। বরং তারা ইসলামপন্থী দলটির ওপর নির্যাতনকে সমর্থন জুগিয়েছে। সক্রিয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনকেও সশস্ত্র বা জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করার কারণে মিসরের মানুষের কাছে এটাই প্রমাণিত হয়েছে ইসলামমাত্র খারাপ বর্বর এবং সন্ত্রাসী বুশের এই নীতি মিসরের শাসকগোষ্ঠী বাস্তবায়ন করছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের এখনকার বক্তব্য দেশটির মানুষের ওপর খুব কমই প্রভাব ফেলবে।
সামনে এলবারাদি
আন্তর্জাতিক আণবিক সংস্থার সাবেক প্রধান ও নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ এলবারাদি এখন মিসরের সরকারবিরোধী আন্দোলনে মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করেছেন। ইতোমধ্যে মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষ থেকে তাকে সমর্থন জানিয়ে বলা হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে বিরোধী রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তিনি আলোচনায় অংশ নেবেন। অপর দিকে মুসলিম ব্রাদারহুড সম্পর্কে এলবারাদি তার অবস্থান স্পষ্ট করছেন যুক্তরাষ্ট্রের এবিসি টেলিভিশনের সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘দে আর নো ওয়ে এক্সট্রিমিস্টস। দে আর নো ওয়ে ইউজিং ভায়োলেন্স। ’ তিনি আরো বলেছেন, মুসলিম ব্রাদারহুডের জনসমর্থন রয়েছে এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতো তাদের রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে।
মুসলিম ব্রাদারহুড মূলত এলবারাদিকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে চাইছে। যার এই মুহূর্তে লক্ষ্য হচ্ছে মোবারকের পতন। ক্ষমতায় বসা নয়। এ ছাড়া এলবারাদির কোনো রাজনৈতিক দল নেই। ফলে রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য তাকে মুসলিম ব্রাদারহুডের কাছে ফিরে আসতে হবে।
সেনাবাহিনীর ভূমিকা
মিসরে যেকোনো পরিবর্তনে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমরা যদি মিসরের অতীত ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, দেশ পরিচালনায় সেনাবাহিনী কতটা ভূমিকা নিয়েছে। ১৯২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশরা মিসরকে স্বাধীন ঘোষণা করে। তবে অ্যাংলো-মিসর চুক্তি অনুযায়ী চলতে থাকায় মিসর তখনো পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেনি। ১৯৩৬ সালে এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
মিসরের ক্ষমতায় থাকেন রাজারা। ১৯৫২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্র ও সংসদ দুটোই বিলুপ্তি ঘোষণা করে সামরিক জান্তা। প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পর জেনারেল মোহাম্মদ নাজির ১৯৫৩ সালে মিসরের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৫৪ সালে জামাল আবদুল নাসের তাকে সরিয়ে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল ছয় দিনের যুদ্ধে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে সিনাই উপত্যকা হারায় তেল আবিবের কাছে।
এতে জামাল আবদুল নাসের প্রভাব হারান দেশ ও জনগণের ওপর। তার মৃত্যুর পর আনোয়ার সাদাত মিসরের প্রেসিডেন্ট হন। সোভিয়েত বলয় থেকে তিনি নিজেকে মার্কিন বলয়ে সরিয়ে নেন। আনোয়ার সা’দাত ইসরাইলের সাথে আলোচনা ও শান্তির উদ্যোগ নেন। ১৯৭৭ সালে তিনি আকস্মিকভাবে ইসরাইল সফরে যান।
১৯৭৯ সালে ইসরাইলের দখল করা সিনাই ফেরত পাওয়ার বিনিময়ে ক্যাম্প ডেভিট শান্তিচুক্তি করে প্রথম আরব দেশ হিসেবে ইহুদি রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি দেন। এ জন্য তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারও দেয়া হয়। ১৯৮১ সালে এক বিক্ষুব্ধ আততায়ীর হাতে আনোয়ার সা’দাত নিহত হন। এরপর দেশটির প্রেসিডেন্ট হন হোসনি মোবারক। তার পর থেকে তিনি পঞ্চমবারের মতো হ্যাঁ-না ভোটে প্রেসিডেন্ট হন।
১৯৮১ সালে আনোয়ার সা’দাতের হত্যাকাে র পর হোসনি মোবারক ক্ষমতা গ্রহণ করেন। বিমান বাহিনীর সাবেক এই কর্মকর্তাকে ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে সেনাবাহিনী। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সেনাবাহিনীর সমর্থন তিনি হারাচ্ছেন। কারণ, ইতোমধ্যে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে বিক্ষোভকারীদের ওপর কোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগ করা হবে না। বিক্ষোভকারীদের সাথে সেনাবাহিনীর সহাবস্থান দেখা গেছে।
অনেক সেনাকর্মকর্তা বিক্ষোভে শামিলও হয়েছে। দেশটিতে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা ও সেনাবাহিনীর বড় আকারের কারণে অনেক পরিবার সেনাবাহিনীর সদস্য রয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের সাথে সেনাবাহিনীর এক ধরনের সম্পর্ক রয়েছে। এখন দেখার বিষয় গণতান্ত্রিক উত্তরণে সেনাবাহিনী কী ভূমিকা রাখে নাকি মোবারকের মতো আরেকজন ক্ষমতায় আসীন হন। এই মুহূর্তে তারা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলেও মিসরের অতীত ইতিহাস বলে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর চুপ থাকার কথা নয়।
মোবারক দ্রুত ক্ষমতা না ছাড়লে কিংবা তার অনুগত কাউকে বসালে সেখানে ক্যু-পাল্টা ক্যুর ঘটনাও ঘটতে পারে।
ইসরাইলের আতঙ্ক
তিউনিসিয়া ও মিসরে হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান ইসরাইলের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসরাইল শুধু তার একজন বিশ্বস্ত বন্ধুকে হারাচ্ছে না, মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় আসতে পারে এমন শঙ্কা প্রকাশ করেছে। অনেক পশ্চিমা নেতা এখন মোবারকের অগণতান্ত্রিক শাসনের সমালোচনা করায় ইসরাইল ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। ইসরাইল আরব বিশ্বে মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান তার নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে।
কারণ, ব্রাদারহুডের সাথে হামাসের আদর্শিক ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। মিশরের সাথে ইসরাইলের অধিকৃত সিনাই অঞ্চলে ১৩০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। ১৯৪৮ ও ১৯৫৬ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানের স্বেচ্ছাসেবকরা পেশাদার সেনাবাহিনীর চেয়েও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল। মুসলিম ব্রাদারহুডের প্যান-ইসলামিক চেতনা ও আদর্শিক দৃঢ়তাকে ভয় পায় ইসরাইল। ইসরাইল প্রকাশ্য শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন আরেকটি ইরানের উন্থানে তারা ভীত।
ব্যর্থ পশ্চিমানীতি
তিউনিসিয়া ও মিসরে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য আমেরিকান ও ইউরোপীয় দেশগুলোর নীতি চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারা এক দিকে গণতন্ত্র বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বললেও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ, নির্বাচনী ফলাফল জালিয়াতি, রাজনৈতিক নিপীড়নকারী শাসকদের সমর্থন জুগিয়েছে। এসব দেশের সেকুলার শাসক ও সিভিল সোসাইটি ইসলামপন্থী দলগুলোকে মৌলবাদী ও জঙ্গি হিসেবে প্রতিপন্ন করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের নির্মূলে সহায়তা করেছে। ফলে সাধারণ মানুষ পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তাদের শুধু ইসরাইলের স্বার্থরক্ষাকারী দেশ হিসেবে এখন দেখছে।
এ অঞ্চলের মানুষ দেখছে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের কথা বলছে অথচ রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হচ্ছে না। তারা দেখছে ফিলিস্তিনে নির্বাচনের মাধ্যমে হামাস বিজয়ী হলেও তাদের সরকার পরিচালনা করতে দেয়া হয়নি। একই পন্থা নেয়া হয়েছিল আলজেরিয়ায়। সেখানে ইসলামিক সলভেশন ফ্রন্ট বিপুল ভোটে বিজয়ী হলেও পশ্চিমা দেশগুলো সামরিক শাসক বুতাফ্লিকাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে। এরপর গৃহযুদ্ধে হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছে।
ইসলামপন্থী দলগুলোকে নিপীড়নের মাধ্যমে কোণঠাসা করার নীতি কতটা ভুল ছিল তা এখন প্রমাণিত হচ্ছে। আরব দেশগুলোতে পরিবর্তন মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাব অনেকটা খর্ব করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ এসব দেশে একান্তভাবেই ইসরাইলের স্বার্থরক্ষায় অনুগত শাসক বসানো কঠিন হয়ে পড়বে। মিশরে মার্কিন নিয়ন্ত্রন বহাল রাখতে একজন দূত পাঠানো হয়েছে। বিবিসির এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রর ইচ্ছে সেখানে সেনাবাহিনীর মধ্যে থেকে কেউ ক্ষমতা গ্রহণ করুক।
কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতি চলমান গনঅভ্যুন্থানে গ্রহণযোগ্য হবে না বলে তারা মনে করছেন। তা হিতে বিপরীত হতে পারে বলে ওবামা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কার্যত এখন মিশরের ব্যাপারে মার্কিন এবং ইসরাইলি নীতির মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। ইসরাইল চাইছে হোসনি মোবারককে টিকিয়ে রাখতে অথবা অন্তত তার মতো কাউকে বসাতে। অপরদিকে মার্কিন নীতি নির্ধারকদের বড় অংশ যেমন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জনকেরি মোবারককে সরাসরি পরিত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
তুরস্কের ভূমিকা
তিউনিসিয়া ও মিসরে রাজনৈতিক পরিবর্তনে তুরস্ক ও সৌদি আরব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তিউনিসিয়ায় আল নাহাদা নেতা রশিদ ঘানুশি লন্ডনের একটি পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ইমাম খোমেনি নয় বরং এরদোগানের সাথে তুলনা করলে তিনি খুশি হবেন। ঘানুশি লন্ডনে অবস্থানকালে তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল একেপি’র সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল এমনকি তার লেখা বইগুলো তুর্কি ভাষায় অনুবাদ করেছে একেপি। আগামী দিনে তিউনিসিয়ায় তুরস্কের প্রভাব আরো বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। অপর দিকে এক সময়ে তুরস্কের ওসমানীয় খিলাফতের অধীন ছিল মিসর।
এ অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহের ওপর তুরস্কের গভীর দৃষ্টি রয়েছে। এক সময় তুরস্ক আর মিসর ছিল মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সম্প্রতি ইসরাইল-তুরস্ক সম্পর্কে পরিবর্তন এসেছে। মিসরে যদি মোবারক সরকারের পতন ঘটে তবে মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলোর ইসরাইলি নীতিতেও পরিবর্তন আসবে। তুরস্কের গুরুত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উপলব্ধি করে ইতোমধ্যে বারাক ওবামা তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর সাথে মিশর পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন।
তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েব এরদোগান মিসরের জনগণের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন হোসনি মোবারকের উচিত জনগনের কথা শোনা। অপর দিকে মিসরের পরিবর্তনে সৌদি আরব প্রকাশ্য কোনো অবস্থান না নিলেও তুরস্কের উদ্যোগের সৌদি আরবের সমর্থন রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসককে সৌদি আরব তাৎক্ষণিকভাবে আশ্রয় দিলেও তার অন্য কোনো আত্মীয়কে আশ্রয় দেননি। তারা কানাডাসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।
আরব বিশ্বে নতুন বার্তা
মিসর আর তিউনিসয়ার গণ-আন্দোলনের প্রভাব অন্যান্য আরব দেশগুলোতে পড়ছে। জর্ডানের প্রধান বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুড ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে। জর্ডানের বাদশাহ তার মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিয়েছেন এবং নতুন প্রধানমন্ত্রীকে সংস্কার আনার নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও ব্রাদারহুডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নতুন প্রধানমন্ত্রী সংস্কার আনার ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যক্তি নন। এ ছাড়া বিক্ষোভ হয়েছে ইয়েমেনে এমনকি আলজেরিয়া এবং সুদানে।
সুদানের মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা ড.হাসান তুরাবিকে সামরিক শাসক ওমর হাসান আল বশির আবারো গ্রেফতার করেছে। ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ পরিস্থিতি বুঝে পার্লামেন্টে ঘোষণা দিয়েছেন, আগামীতে তিনি আর প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবেন না। ৩২ বছর ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তার ছেলে কাছেও ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। তিনি বিরোধী দলের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। যদিও বিরোধী দল তার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
মরোক্কতে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু হতে পারে বলে সংবাদ মাধ্যমগুলো আভাষ দিয়েছে। এসব দেশে এই মুহূর্তে সরকার পরিবর্তনের ঘটনা না ঘটলেও আন্দোলনের রেশ অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে। বিরোধী দলগুলো শুধু ইসলামপন্থী হওয়ার কারণে পশ্চিমা সমর্থন নিয়ে ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী নিপীড়নের পথ থেকে সরে না এলে তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়ার মতো পরিস্থিতি ঘটতে পারে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নালকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক যুগের সূচনা হয়েছে। যদিও তার নিজের দেশে ইসলামপন্থী বিরোধী দলের ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
বিরোধী দলগুলো বড় আকারের বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। তার পরও এই বাশার আল আসাদ যে নতুন যুগের সূচনার কথা বলছেন আরব শাসকরা তার সাথে নিজেদের কতটা খাপ খাওয়াতে পারেন তার ওপর নির্ভর করবে তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকা। না হলে হয়তো আরো অনেককে বেন আলী কিংবা মোবারকের পরিণতি বরণ করতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।