আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গ্রীক মিথলজি ১৯ (ভালোবাসার গল্প- কিউপিড এবং সাইকী- শেষ পর্ব)

গ্রীক মিথলজি ১৮ (ভালোবাসার গল্প- কিউপিড এবং সাইকী- প্রথম পর্ব) অনুযায়ী সাইকীকে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভয়ংকর দানবের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য (শিল্পী- এডওয়ার্ড বার্নে জোন্স, ১৮৯৫ সাল)
পূর্বের পর্বের পর--
বোনেরা চলে যাবার পর সাইকী নিবিষ্টমনে চিন্তা করতে লাগলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন, তার স্বামীকে খুব ভালোবাসেন, পরক্ষনেই মনে হলো তিনি তো এক ভয়ংকর সাপ। একবার হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন, তো পরক্ষনেই মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যান। সারাদিন এভাবে পার করে দেবার পর এক চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে এলেন। হত্যা করুন, বা নাই করুন, আজ রাতে সাইকী অবশ্যই তার স্বামীকে দেখবেন।


রাতে স্বামী এসে যখন সাইকীকে ভালোবেসে গভীর ঘুমে ডুবে গেলেন, সাইকী তখন চুপিসারে বিছানা থেকে উঠে বাতি জ্বালিয়ে, হাতে ছুরি নিয়ে পা টিপে টিপে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালেন। বাতিটি তুলে ধরলেন- স্বামীর চেহারার উপর। কিন্তু এ কি! কী দেখছেন সাইকী! তার কাছে মনে হতে লাগলো তার স্বামী পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম এবং মধুরতম পুরুষ মানুষ। তিনি দেখলেন বিছানায় শুয়ে আছেন এক আশ্চর্য সুন্দর যুবক পুরুষ। হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন সাইকী, নিজের অজান্তেই হাত থেকে খসে পড়লো ছুরি।

স্বামীর দিকে নিনির্মেষে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু সাধ যেনো মেটে না। বুঝতে পারলেন, বোনদের ফাঁদে পড়ে তিনি কি চরম ক্ষতিটাই না করতে যাচ্ছিলেন! আরেকটু ঝুঁকে যেই দেখতে যাবেন, বাতি থেকে এক ফোঁটা গরম তেল স্বামীর গায়ে ছিটকে পড়লো। চকিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো স্বামীর। সাইকীকে দেখে সবকিছু বুঝতে পারলেন, হতাশ হলেন স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতায়। একটিও কথা না বলে চলে গেলেন ঘর থেকে।


বাতি জ্বালিয়ে সাইকী তার স্বামীকে দেখছেন (শিল্পী- গুইসেপ্পে মারিয়া ক্রেস্পি)
সাইকী দৌড়ে অন্ধকারে তার পিছু নিলেন। শোনা গেলো তার স্বামীর কন্ঠস্বর, “আমি কিউপিড, প্রেমের দেবতা। যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে তো প্রেম বাঁচতে পারে না!” এই কথা বলে একরাশ দুঃখ আর হতাশা নিয়ে কিউপিড চলে গেলেন। আর সাইকী হতবুদ্ধির মতো বসে রইলেন। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন, প্রেমের দেবতা কিউপিড তার স্বামী, আর তিনিই কিনা হচ্ছেন সবচেয়ে হতভাগিনী স্ত্রী, যে কি না তার স্বামীকে বিশ্বাস করতে পারলেন না! তার নিজের কাছে ধরে রাখতে পারলেন না! হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিলেন সাইকী, কিউপিড যদি তাকে ছেড়েও চলে যান, তিনি কিউপিডকে খুঁজে বের করবেন।

তিনি দেখাবেন, স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা কতটুকু। তার আগে, ঠিক করলেন সাইকী, তার বোনদের শাস্তি দিবেন।
তিনি প্রথমেই গেলেন বড় বোনের কাছে, সে তখন এক হীন রাজ্যের রানী। সাইকী গিয়ে তার বড় বোনকে বললেন, “আমার স্বামী ছিলেন প্রেমের দেবতা কিউপিড। আমার আচরনে কষ্ট পেয়ে তিনি আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন, যাবার আগে বলে গেছেন, আমি নাকি দুষ্ট প্রকৃতির।

তিনি ঠিক করেছেন আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার বড় বোনকে বিয়ে করবেন”। বড় বোন এই কথা শুনে তড়িৎগতিতে তার স্বামীকে মিথ্যা কথা বলে সেই পাহাড়ের চূড়ায় গেলেন। সেখানে গিয়ে কিউপিড এবং পবন দেবতা জেফায়ারকে ডাকতে লাগলেন। কিন্তু জেফায়ার তাকে তুলে নিয়ে হঠাৎ করে নিচে ফেলে দিলেন, পাথরের উপর পড়ে বড় বোনের সেখানেই সমাধি হয়ে গেলো। অন্য বোনেরও ঠিক একই অবস্থা হলো, সাইকী এভাবেই অসৎ উপদেশ দেওয়ার জন্য বোনদের উপর প্রতিশোধ নিলেন।

সাইকী এরপর দেবতাদের কৃপা পাওয়ার জন্য বনে-বাদাড়ে, পাহাড়ে ঘুরতে লাগলেন।
এদিকে তেলের ফোঁটার কারণে তার ক্ষতস্থানের চিকিৎসার জন্য কিউপিড এলেন তার মা ভেনাসের কাছে। কিউপিড অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় পৃথিবী থেকে যেনো সব ভালোবাসা, প্রেম নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে লাগলো। পৃথিবী হয়ে উঠতে লাগলো নিরামন্দময় কুৎসিত এক জায়গা। ভেনাস তার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, কার জন্য কিউপিডের এই অবস্থা।

কিউপিড যখন সব কথা খুলে বললেন, বললেন সাইকী তার স্ত্রী, এই কথা শুনে ভেনাস আরো ক্ষুদ্ধ হলেন। তিনি কিউপিডের চিকিৎসা না করে, সেই অবস্থাতেই রেখে চলে গেলেন। ভেনাস খুঁজতে বেরুলেন সাইকীকে, যে মরণশীল তাকে আরো ঈর্ষাকাতর করে তুলেছেন। তিনি সবাইকে বুঝিয়ে দেবেন, দেবীর ক্রোধ থেকে কেউই নিস্তার পেতে পারেন না!
সাইকী তখন গভীর হতাশা আর দুঃখ নিয়ে দেবতাদের উদ্দেশ্যে কিউপিডকে ফিরে পাবার জন্য প্রার্থনা করতে লাগলেন, চেষ্টা করতে লাগলেন দেবতারা যেনো তার উপর সদয় হোন। কিন্তু দেবতারা সাইকীর দুখে সমব্যাথী হলেও, ভেনাসের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে কেউই সাইকীকে সাহায্য করতে চাইলেন না।

অবশেষে ঘুরতে ঘুরতে এক উঁচু পাহাড়ের সন্ধান পেলেন সাইকী, যেখানে ছিলো এক অসাধারণ মন্দির। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সম্ভবত আমার ভালোবাসা, আমার স্বামী সেখানে আছেন!” এবং মন্দিরে প্রবেশ করলেন।
মন্দিরে প্রবেশ করামাত্রই দেখলেন কিছু শস্যবীজ একত্রে মিশানো অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মন্দিরের মেঝেতে। সাইকী অনুভব করলেন, যে কৃষক এই শস্যবীজগুলো রোপন করবেন, তাকে এই বীজগুলো রোপন করতে অনেক কষ্ট করতে হবে। এই চিন্তা করে তিনি শস্যবীজগুলো আলাদা করতে লাগলেন এবং সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখলেন।

মন্দিরটি ছিলো শস্যদেবী সেরেসের (দিমিতারের রোমান নাম)। সেরেস সাইকীর কাজে খুব খুশি হলেন। তিনি বললেন, “ওহ সাইকী! ওহ হতভাগী সাইকী! আমি তোমাকে ভেনাসের ক্রোধ থেকে বাঁচাতে হয়তো পারবো না, কিন্তু বলতে পারি কীভাবে তুমি তাকে সন্তুষ্ট করতে পারো। তুমি সরাসরি ভেনাসের কাছেই যাও, তার দাসী হিসেবে নিজেকে সমর্পন করো। চেষ্টা করো তার ক্ষমা পেতে।

তাহলেই হয়তোবা তুমি তোমার স্বামীকে ফিরে পেতে পারো”। সাইকী সেরেসের কথা শুনলেন। তিনি ভেনাসকে খুঁজতে বের হলেন, ঠিক সেই সময়ে ভেনাসও সাইকীকে খুঁজছিলেন। তিনি সাইকীকে খুঁজে পাওয়ার জন্য এতো উন্মত্ত ছিলেন, ঘোষনা দিলেন, যিনি সাইকীর খোঁজ এনে দিতে পারবেন, তাকে তিনি সাতটি অসাধারণ চুমু দিবেন, যার প্রত্যেকটিতে সে ভেনাসের মিষ্টি জিহবার তীক্ষ্ণ স্বাদ পাবে!
অবশেষে ভেনাস সাইকীকে খুঁজে পেলেন। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ভেনাস বললেন, “তুই কি নতুন স্বামী খুঁজছিস? পুরানো স্বামীটি যেহেতু তোর দেয়া আঘাতে প্রায় মরার দশা! কিন্তু জেনে রাখিস, তুই এতো কুৎসিত যে কষ্টের কাজ না করলে তুই কোনো নতুন প্রেমিক খুঁজে পাবি না।

যা হোক, কষ্টের কাজে আমি তোকে দীক্ষা দিবো, এটুকু সহানুভূতি আমি তোর উপর করতে পারি,” এই বলে সাইকীকে তার মন্দিরে নিয়ে শস্যদানায় ভর্তি একটি বিরাট ঝুড়ি দিলেন, যে ঝুড়িতে গম, ভুট্টা, পপিসহ বিভিন্নরকম শস্যদানা একত্রে মিশিয়ে রাখা। সন্ধ্যার মধ্যে শস্যদানাগুলো আলাদা করে রাখার আদেশ দিয়ে ভেনাস চলে গেলেন।
সাইকী হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন শস্যদানার স্তুপের সামনে। তার পক্ষে কী একাকী এই কাজ করা সম্ভব? দেবতাদের মন না টললেও, ক্ষুদ্র পিপড়ার দল সাহায্য করতে এগিয়ে এলো সাইকীকে। হাজার হাজার পিঁপড়ারা বিভিন্ন জাতের শস্যবীজ আলাদা আলাদা স্তুপ করে রাখতে লাগলো।

সন্ধ্যায় ভেনাস যখন এসে দেখলেন সাইকী কাজ শেষ করেছেন, খুব ক্ষিপ্ত হলেন। এবার আরো একটি কঠিন কাজ দিলেন। বললেন, “নদীর ধারে যেখানে ঘন জঙ্গল, সেখানে স্বর্নলোমওয়ালা ভেড়ার পাল চরে বেড়ায়। তুই ঐ ভেড়ার গাঁ থেকে স্বর্ণলোম তুলে নিয়ে আয়”। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত সাইকী যখন নদীর তীরে পৌঁছালেন, তখন তার কাছে মনে হলো, আর নয়- এই নদীর জলে ডুবে মরে সকল যন্ত্রনার অবসান করি! যেই নদীতে ডুব দিতে যাবেন, এক সবুজ ঘাসের ডগা তাকে বলে উঠলো, “সাইকী, তুমি মরলে তো হেরে গেলে! এতো সহজেই কী তুমি হারতে চাও? যে কাজটাকে তুমি খুব কঠিন ভাবছো, সেটা অতোটা কঠিন নয়।

ভেড়াগুলো খুব হিংস্র অবশ্যই, কিন্তু তুমি সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা কর। সন্ধ্যার দিকে ভেড়াগুলো পানি খেতে নদীর ধারে আসে, তখন তুমি জঙ্গলে গেলে দেখবে কাঁটাঝোপের সাথে অনেক স্বর্নলোম আটকে রয়েছে”। সাইকী আবারো তার কাজ সমাপ্ত করতে পারলেন। ভেনাস যেনো আরো ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি বললেন, “তোকে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ সাহায্য করছে।

তাই তোকে আরো কাজ করতে হবে। তোকে স্টিক্স নদীর উৎসধারা ঝরনা থেকে সোরাহি ভর্তি করে পানি আনতে হবে”। বাস্তবিক অর্থেই এই কাজটি অনেক কঠিন। সাইকী যখন স্টিক্স নদীর উৎসধারায় গেলেন, তখন দেখলেন ঝরনার কাছে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। সেখানে পাখাওয়ালা কেউ ছাড়া অন্য কারো পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।

আবারো অপ্রত্যাশিতভাবে সাহায্য পেলেন সাইকী, এবার এক ঈগলের নিকট হতে। ঈগলটি ঠোঁটে করে সোরাহিটি নিয়ে ঝরনার কালো পানিতে ভর্তি করে আবার সাইকীর কাছে নিয়ে এলো। সাইকী যখন সোরাহী ভর্তি পানি নিয়ে ভেনাসের সামনে এলেন, ভেনাস প্রচন্ড হতাশায় মুষড়ে পড়লেন। হতাশা থেকেই নির্বোধের মতো সাইকীকে আরেকটি কাজ করার আদেশ দিলেন।
সাইকীর হাতে একটি বাক্স দিয়ে ভেনাস বললেন, “যা, পাতালপুরীতে গিয়ে রানী প্রসার্পিনার (পার্সিফোনের রোমান নাম) কাছে তার সৌন্দর্য্যের কিছু অংশ চাইবি।

বলবি অসুস্থ ছেলের সেবা করতে গিয়ে ভেনাসের গায়ের রং ময়লা হয়ে গিয়েছে। তাই প্রসার্পিনার রুপের কিছু অংশ ধার করে নিয়ে আসবি”।
সাইকী ভেবেছিলেন একটা টাওয়ার থেকে নিচে লাফ দিলেই হয়তোবা সরাসরি পাতালপুরীতে যাওয়া যাবে। সেই চিন্তা করে টাওয়ারে উঠে যখন লাফ দিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে যাবেন, তখনই টাওয়ারটি মানুষের কন্ঠে কথা বলে উঠলো। টাওয়ারটি সাইকীকে জানালো, পাতালপুরীতে যাওয়ার রাস্তা পাওয়া যাবে দক্ষিন হেলাসে অবস্থিত এক বিশাল ফাটলের মধ্যে দিয়ে।

সাইকীকে আরো উপদেশ দিলো, দুই টুকরো রুটি এবং দুইটি মুদ্রা নিয়ে যাওয়ার জন্য। ফাটল দিয়ে ভিতরে ঢুকলে মৃত্যুর নদী দেখা যাবে, সেই নদী পার হতে হবে লোভী মাঝি চারণের মাধ্যমে, তখন চারণকে একটি মুদ্রা দিতে হবে, আরেকটি মুদ্রা দিতে হবে ফিরে আসার সময়। নদী পার হলে সোজা রাস্তা ধরে চলে গেলেই পাওয়া যাবে হেডিসের প্রাসাদ, যেখানে পাহাড়া দিচ্ছে তিন মাথাওয়ালা এক কুকুর, সার্বেরাস। কুকুরটিকে রুটি দিলেই সে পথ ছেড়ে দিবে। সাইকীকে আরো বলা হলো, পাতালপুরীর কারো প্রতি দয়া না দেখাতে এবং কারো অনুরোধ না রাখতে- যেটা পাতালপুরীতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।


চারণ এক মৃত ব্যক্তিকে এড়িয়ে সাইকীকে মৃত্যু নদী পার করে দিচ্ছে (১৮৬৫ সালে আর্নেষ্ট হিল্লেম্যাকারের আঁকা ছবি)
টাওয়ারের কথামতো সাইকী পাতালপুরীতে গেলেন, সবকিছুই ঠিকমতো হলো। রানী প্রসার্পিনার সাথে দেখা হলো। প্রসার্পিনা তাকে পাতালপুরীর কেদারায় বসতে বললেন, এবং প্রথমে কিছু খেয়ে বিশ্রাম নিতে বললেন। কিন্তু সাইকী কেদারায় না বসে মেঝেতে বসলেন, কারণ তিনি জানতেন, কেদারায় বসলে সবকিছু ভুলে যাবেন। সাইকী কোনো খাবারও খেলেন না, কারণ তিনি জানতেন, পাতালপুরীর এই খাবারগুলো খেলে আর কখনও পাতালপুরী থেকে ফিরে যেতে পারবেন না।

তিনি প্রসার্পিনাকে তার পাতালপুরীতে আসার উদ্দেশ্য বললেন। প্রসার্পিনা খুশি হয়েই দেবী ভেনাসের জন্য কিছু রুপ বাক্সে ভরে দিলেন এবং সাইকী পৃথিবীতে ফিরে এলেন।
পৃথিবীর প্রথম মানবী পান্ডোরার যেমন অধিক কৌতুহল ছিলো, সব নারীদের মধ্যেই জিউস বোধহয় সেই কৌতুহলটা ঢুকিয়ে দিয়েছন মাত্রাতিরিক্ত। অত্যাধিক কৌতুহলের কারণেই সাইকী ভাবলেন দেখাই যাক না বাক্সের মধ্যে কী রুপ লাবন্য লুকানো রয়েছে! যদি সেইরকম কোনো রুপ লাবন্য থেকেই থাকে, তাহলে তিনি নিজেও একটু গায়ে মাখবেন। যেই ভাবা সেই কাজ, সাইকী বাক্সটি খুলে ফেললেন।

কিন্তু এ কী! ভিতরটাতো ফাঁকাই মনে হচ্ছে। কিন্তু একটু পরেই প্রবল আলস্যের কারণে সাইকী গভীর নিদ্রার জগতে চলে গেলেন।
ততদিনে কিউপিড তার ক্ষত থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন, এবং সাইকীর প্রতি অভিমান ভুলে তার সাথে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন। ভেনাসের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সাইকীকে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। ঠিক সেই সময়েই দেখলেন সাইকী ঘুমিয়ে আছেন।

কিউপিড তখন সাইকীর চোখ থেকে নিদ্রা মুছে নিয়ে বাক্সে বন্দী করলেন এবং তীরের মৃদু স্পর্শ দিয়ে জাগিয়ে তুললেন। সাইকীকে বললেন বাক্সটি ভেনাসের কাছে পৌঁছে দিতে আর শোনালেন আশ্বাসবানী- এখন থেকে সবকিছু ঠিকমতো চলবে। সাইকী খুশি মনে ভেনাসের কাছে চললেন।
কিউপিড কিন্তু নির্ভার হতে পারলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন ভেনাস কখনোই এতো সহজে রাজী হবেন না।

তাই কিউপিড গেলেন দেবরাজ জিউসের কাছে, সব কথা খুলে বলে সাহায্য চাইলেন। জিউস রাজী হলেন কিউপিড এবং সাইকীকে সাহায্য করতে। তিনি স্বর্গে সব দেবতাদের নিয়ে এক সভা ডাকলেন। সেখানে ভেনাসও উপস্থিত হলেন। জিউস ঘোষনা দিলেন, সাইকীকে অমরত্ব দেওয়া হবে।

মার্কারী (হার্মিসের রোমান নাম) সাইকীকে নিয়ে এলেন দেব-প্রাসাদে, জিউস নিজে স্বর্গের ফল এম্ব্রোসিয়া সাইকীকে খেতে দিয়ে অমরত্ব দান করলেন। আর তাতেই দেবী ভেনাস কিউপিডের সাথে সাইকীর বিয়ে দিতে রাজী হলেন। কারণ, সাইকী এখন অমর! তাছাড়া, তিনি চিন্তা করলেন, সাইকী এখন থেকে স্বর্গে থাকবে, তাই পৃথিবীর মানুষ তার কথা ভুলে গিয়ে আবার ভেনাসের পুজা- অর্চনা শুরু করবে। তাই বিশাল ভোজের মধ্যে দিয়ে কিউপিড এবং সাইকীর আনুষ্ঠানিক বিয়ের অনুষ্ঠান হলো এবং এভাবেই সবকিছুর সুন্দর সমাপ্তি ঘটলো।
কিউপিডের সাথে সাইকীর আনুষ্ঠানিক বিয়ের অনুষ্ঠান, ছবিতে বসা অবস্থায় ভেনাসকেও দেখা যাচ্ছে (পম্পেও গিরোলামো বাটোলির আঁকা)
রোমান লেখক আপুলিয়াস-ই একমাত্র লেখক, যিনি আমাদেরকে এই অসাধারণ প্রেমের কাহিনীটি বর্ননা করেন।

অন্য কোনো মিথ লেখক এই কাহিনী বিবৃত করেন নি। আপুলিয়াস আমাদেরকে আরো জানান, কিউপিড এবং সাইকীর একজন কন্যা সন্তান জন্মগ্রহন করেন, যার নাম দেওয়া হয়েছিলো ভোলুপ্টা, বাংলায় যার অর্থ তৃপ্তি।
সাইকী কিউপিডের প্রথম চুমু খাচ্ছে (শিল্পী- ফ্রাঙ্কোইস জেরার্ড, ১৭৯৮ সাল)
(বোসিস এবং ফিলোমোনের গল্প ছাড়া আফ্রোদিতি চক্রের ভালোবাসার গল্পের এখানেই সমাপ্তি। গ্রীক মিথলজিতে আরো অনেক ভালোবাসার গল্প আছে, যেগুলো সময়মতো বলা হবে। আমরা এখনো আছি আফ্রোদিতির গল্পকথায়।

পরবর্তী পর্বে থাকবে আফ্রোদিতির প্রতিহিংসার গল্প। )
এই সিরিজের আগের লেখাগুলোঃ
সৃষ্টিতত্ত্বঃ পর্ব-১: বিশ্ব-ব্রক্ষ্মান্ডের সৃষ্টি এবং ইউরেনাসের পতন পর্ব-২: টাইটান যুগের সূচনা এবং অলিম্পিয়ানদের জন্ম পর্ব-৩: প্রথম টাইটান যুদ্ধ এবং জিউসের উত্থান পর্ব-৪: মানবজাতির সৃষ্টি, প্রমিথিউস এবং পান্ডোরা উপাখ্যান পর্ব-৫: প্রমিথিউসের শাস্তি এবং আইও পর্ব-৬: আবার যুদ্ধ- জায়ান্ট এবং টাইফোয়িয়াস পর্ব-৭: ডিওক্যালিয়নের প্লাবন
দেবতাদের গল্পঃ এথেনা এবং আফ্রোদিতি পর্ব-৮: জিউস, মেটিস এবং এথেনার জন্ম পর্ব-৯: এথেনার গল্পকথা-প্রথম পর্ব পর্ব-১০: এথেনার গল্পকথা- দ্বিতীয় (শেষ) পর্ব পর্ব-১১: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ আফ্রোদিতি, হেফাস্টাস এবং অ্যারিসের ত্রিমুখী প্রেমকাহিনি পর্ব-১২: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ অ্যাডোনিসের সাথে অমর প্রেমকাহিনী পর্ব-১৩: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ এনকেসিসের সাথে দূরন্ত প্রেম
ভালোবাসার গল্পঃ পর্ব-১৪: পিগম্যালিয়ন এবং গ্যালাতিয়া পর্ব-১৫: পিরামাস এবং থিসবি পর্ব-১৬: হিরো এবং লিয়েন্ডার পর্ব-১৭: বোসিস এবং ফিলোমোন পর্ব-১৮: কিউপিড এবং সাইকী- প্রথম পর্ব
লেখকঃ
এস এম নিয়াজ মাওলা
ছবি সূত্রঃ ইন্টারনেট

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.