১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসির রায় দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনাল মঙ্গলবার এই রায় ঘোষণা করে। হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মান্তরে বাধ্য করাসহ মোট ২৩টি অভিযোগ উত্থাপন করা হয় সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ৯টি অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয় রাষ্ট্রপক্ষ। এই ৯টি অভিযোগের মধ্যে সাতটি হত্যা ও গণহত্যা সংক্রান্ত; আর দুটি অভিযোগ অপহরণ ও নির্যাতনের।
প্রমাণিত অভিযোগগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগনেতা শেখ মোজাফ্ফর আহমদ ও তার ছেলেকে হত্যা, রাউজান পৌরসভার সতীশ চন্দ্র পালিতকে হত্যা, ঊনসত্তরপাড়ায় গণহত্যা, জগতমল্লপাড়ায় গণহত্যা, সুলতানপুর এলাকায় নেপাল চন্দ্র ও অন্য তিনজনকে হত্যা, কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের স্বত্বাধিকারী অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা ইত্যাদি লোমহর্ষক ও নির্মম হত্যাকাণ্ড। সেই সঙ্গে রয়েছে সালেহ উদ্দিন ও নিজাম উদ্দিনকে অপহরণ ও তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের অভিযোগ।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে সাকা চৌধুরীর ফাঁসির রায়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল মানুষ এবং একাত্তরে ক্ষতিগ্রস্তদের স্বজন-পরিজন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। আনন্দ-উল্লাস করেছেন। বস্তুত এ রায় শুধু একটি মামলার গতানুগতিক বিচারিক ফলাফল ঘোষণা নয়, এ যেন এক কলঙ্কিত ইতিহাসের সত্য উদঘাটন।
এই রায়কে আজকের সময়ের প্রেক্ষাপটে বিবেচনার অবকাশ নেই; বিবেচনা করতে হবে আজ থেকে বিয়াল্লিশ বছর আগের সময়-প্রেক্ষাপটে। সাকা চৌধুরী আজ কোন্ রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা কিংবা তার বর্তমান সামাজিক অবস্থান কি, এসব ভুলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সুদূর একাত্তরে- জাতীয় ইতিহাসের এক দুর্যোগপূর্ণ সময়ে, যখন চলছে স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের ওপর পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের নানামাত্রিক অত্যাচার- হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, অপহরণ ইত্যাকার বর্বর কর্মকা-। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় এই যে, অগণিত বাঙালী দামাল ছেলেরা স্বাধীনতার জন্য যাদের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত, সেই হানাদার বাহিনীরই দোসর হয়ে সাকা চৌধুরীদের মতো দেশদ্রোহীরা বাঙালী নিধন-নির্যাতনে লিপ্ত থাকে। সাকা চৌধুরীদের চট্টগ্রামের বাসভবন ‘গুডসহিল’ তখন ভয়াবহ টর্চার সেল হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করে। সাকার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরা যে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন, তা যেমন লোমহর্ষক তেমনি আতঙ্কজনক।
সেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে বেরিয়ে আসে : এক মূর্তমান দোর্দ-প্রতাপ খলনায়কের মতো তিনি চট্টগ্রামের মুক্তিকামী মানুষের, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সামনে আবির্ভূত হন মুক্তিযুদ্ধকালে। সঙ্গে তার সাঙ্গোপাঙ্গসহ ঘাতক দল। চট্টগ্রামের ঊনসত্তরপাড়ার ৬৯/৭০ জনকে হত্যা, জগতমল্লপাড়ার ৩২ জন হিন্দু নারী-পুরুষকে হত্যা, অজাতশত্রু সন্তসদৃশ সমাজসেবক ও মানবতাবাদী চিকিৎসক অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে প্রার্থনারত অবস্থায় মন্দির থেকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে এনে গুলি করে হত্যা ইত্যাদি ঘটনায় সাকার সরাসরি সম্পৃক্ততার বিবরণ দিয়েছেন সাক্ষীরা। সকল সাক্ষ্যপ্রমাণ বিচার-বিশ্লেষণ করেই ট্রাইব্যুনাল রায় প্রদান করেছে; যার মাধ্যমে আইনের শাসন যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তেমনি ঘোষিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিজয়। আরও প্রমাণিত হয়েছে- অপরাধী যত ক্ষমতাশালীই হোক না কেন, একদিন না একদিন তাকে আইনের মুখোমুখি হয়ে প্রাপ্য শাস্তি মাথাপেতে নিতে হয়।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ ইতিহাসের কলঙ্ক। এর সঙ্গে জড়িতদের যথাযথ বিচার হলে জাতি সেই কলঙ্ক থেকে মুক্তি পাবে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকপথে দেশ এগিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। সাকার ফাঁসির রায় সেই পথের আরেকটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।