আসসালামু আলাইকুম,
আশা করি সবাই ভাল আছেন
গত পর্বে আমি এই প্রযুক্তির ব্যবহার সম্বন্ধে আপনাদের বলেছিলাম। এই পর্বে এই প্রযুক্তির সংক্ষিপ্ত একটা ইতিহাস আপনাদের বলব।
বিদেশে ব্রেনওয়েভ এনট্রেইনমেন্ট নিয়ে যারা প্রচুর কাজ করছেন এবং গবেষণা করছেন এরকম অনেকে দাবি করেন যে শব্দ বা আলোর মাধ্যমে মানসিক অবস্থা পরিবর্তনের বিষয়টি ইইজি মেশিন আবিষ্কৃত হওয়ার বহু আগেই বিভিন্ন ব্যক্তি দ্বারা পরিলক্ষিত হয়েছে। অনেকে এমনও দাবি করেন যে, ঘূর্ণায়মান চাকার ভিতর দিয়ে সূর্যের আলো আসার সময় যে কম্পমান আলোর সৃষ্টি হয় মানুষের মনের উপর তার প্রভাব টলেমী ২০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রত্যক্ষ করেছেন। তবে সে সময় আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকার কারনে এ সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে কেউ খুব বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেনি।
ব্রেনওয়েভ এনট্রেইনমেন্ট প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করার ক্ষেত্রে খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করছে ইইজি (EEG) মেশিন। এই মেশিন আবিষ্কারের পর তুলনামুলকভাবে এই প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণার কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে।
ইইজি মেশিন সম্বন্ধে খুব সংক্ষেপে বলছি। আমাদের শরীর ও মনের বিভিন্ন ধরণের কার্যকলাপ ব্রেন নিয়ন্ত্রণ করে এবং এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ব্রেন এর ভিতর বিভিন্ন ধরণের বৈদ্যুতিক কার্যক্রম সংঘটিত হয়। ইইজি মেশিন এর সাহায্যে আমাদের ব্রেন এর এইসব বৈদ্যুতিক কার্যক্রম সনাক্ত করা যায় এবং এই কার্যক্রম এ কোন ত্রুটি থাকলে তাও সনাক্ত করা যায়।
১৯৪০ এর দশকে উইলিয়াম গ্রে ওয়াল্টার নামক এক বিজ্ঞানী মানবমস্তিষ্কে আলোর প্রভাব নিয়ে প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেন। ১৯৫৯ সালে বিজ্ঞানী চ্যাট্রিয়ান শব্দের মাধ্যমে মানসিক অবস্থা পরিবর্তন করার বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করেন। এর পর থেকে এ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করার জন্য আরো অনেক বিজ্ঞানী কাজ শুরু করেন এবং এখনো করছেন।
১৯৬০ এর দশকে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানসিক উদ্বিগ্নতা এবং ব্যথার অনুভূতি কমানোর উপায় নিয়ে গবেষণা করেছেন। ব্যথা নিবারন বিষয়ে অভিজ্ঞ ডাক্তার (অ্যানেসথেটিস্ট) এম.এস. সিডোভ এই দশকে একটি অভিনব কাজ শুরু করেন।
সেটি হচ্ছে, তিনি এই প্রযুক্তির মাধ্যমে আলো ব্যবহার করে অপারেশন এর রোগীদের মানসিক উদ্বিগ্নতা ও ব্যাথা কমানোর চেষ্টা করেন যাতে তাদেরকে প্রয়োগ করা ব্যাথা নিবারক (অ্যানেসথেসিয়া)কম পরিমাণে লাগে।
এই দশকের আরেকটি বড় উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেন বার্নার্ড মার্গোলিস নামক এক সার্জিক্যাল ডেন্টিস্ট। তিনি ব্রেনওয়েভ এনট্রেইনমেন্ট নিয়ে তার গবেষণায় বেরিয়ে আসা বেশ কিছু বিষয় একটি নিবন্ধে প্রকাশ করেন। এই নিবন্ধে তিনি বলেন যে, দাঁতের বিভিন্ন ধরণের অপারেশন এর আগে যেসব রোগীর উপর ব্রেনওয়েভ এনট্রেইনমেন্ট প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে সে সব রোগীরা অপারেশন করার সময় কম ভয় পেয়েছে, তারা অপারেশনের ভীতির কারণে কম চিৎকার করেছে এবং তাদের ক্ষেত্রে কম পরিমাণ অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করতে হয়েছে।
১৯৭০ এর দশকে এই প্রযুক্তির বিষয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণাটি করেন বিজ্ঞানী জেরাল্ড অস্টার।
১৯৭৩ সালের সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনে “অডিটরি বিটস ইন ব্রেইন” নামক একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এই নিবন্ধে তিনি “বাইনরাল বিট” ও “মনোঅরাল বিট” সম্বন্ধে তার গবেষণালব্ধ তথ্য ও আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করেন। এই নিবন্ধ প্রকাশিত হবার পর ব্রেনওয়েভ এনট্রেইনমেন্ট প্রযুক্তি এবং মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ও স্নায়ুসম্পর্কিত বিষয়ে এই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে গবেষণার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। পরবর্তীতে “রবার্ট মনরো” নামক একজন ব্যক্তি বাইনরাল বিট, মেডিটেশন, মানুষের সচেতনতার স্তর ও এই প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের আত্মউন্নয়ন সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে গবেষণা করার জন্য একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান “মনরো ইনস্টিটিউট” প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৮০ এর দশকে নরম্যান শেলী নামক এক গবেষক তার গবেষণায় দেখতে পান যে, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরী করা ১০ হার্জ ফ্রিকোয়েন্সির (পরবর্তী একটি পর্বে হার্জ ও ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে) ৩০ মিনিটের একটি শব্দের প্রভাবে মানুষের সচেতনতা এবং মেজাজ খুবই ইতিবাচকভাবে পরিবর্তিত হয়।
এই দশকে আর্টুরো ম্যান্স নামক আরেক ব্যক্তি আইসোক্রনিক টোন নামক একটি বিশেষ ধরণের শব্দ উদ্ভাবন করেন যার মাধ্যমে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সুফল আরও ভালভাবে পাওয়া সম্ভব হয়। ড. গ্লেন সলোমন এবং আরও বেশ কয়েকজন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাথাব্যথা দূর করা এবং মানসিক প্রশান্তি লাভ ও মানসিক চাপ কমানো নিয়ে গবেষণা করেন। মাইকেল হাচিনসন এই দশকে একটি অতি চমকপ্রদ বই লিখেন যাতে তিনি এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মেডিটেশন করা, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করা, নির্দিষ্ট ধরণের মানসিক অবস্থা অর্জন করাসহ আরও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে তার গবেষণা ও ধারণা অন্যদের কাছে তুলে ধরেন।
১৯৯০ এর দশকেও বেশ কিছু গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল শহরে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশদের উপর পরিচালিত একটি গবেষণা।
এই গবেষণায় দেখা যায় যে, এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে মাংসপেশীর উপর চাপ ও হৃদ-স্পন্দন উভয়ই কমে আসে। এছাড়াও এই গবেষণায় আরও দেখা যায় যে, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করার পর কর্মক্ষেত্রে পুলিশরা কঠিন পরিস্থিতিগুলো আগের চেয়ে বেশী দক্ষতার সাথে এবং তুলনামূলকভাবে কম মানসিক চাপে থাকা অবস্থায় মোকাবিলা করতে পারছে। ১৯৯২ সালে কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রিপোর্টে বলা হয় যে, সঠিক মাত্রায় ও সঠিক পরিমানে এই প্রযুক্তির ব্যবহারে ব্যথা কমানো সম্ভব। এই দশকে পরিচালিত আরও বেশ কিছু গবেষণায় দীর্ঘমেয়াদী মানসিক অবসাদ, উচ্চ রক্তচাপ, মাথাব্যথা ও মাইগ্রেন এর সমস্যা, মানসিক অস্থিরতা এবং দীর্ঘমেয়াদী ব্যথা নিবারণ করার ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সুফল পাওয়া যায়।
এভাবে আগের দশকগুলোর ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও এই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা চলছে।
বিজ্ঞান ও মেডিক্যাল সায়েন্সের উৎকর্ষতার কারণে মানুষের ব্রেন নিয়ে যত তথ্য জানা যাচ্ছে ততই এই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রও বেড়ে যাচ্ছে।
আগেকার বিজ্ঞানীদের মত বর্তমানেও বিজ্ঞানীরা অধিকতর উন্নত যন্ত্রপাতির সাহায্যে তাদের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। একবিংশ শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য কয়েকজন বিজ্ঞানী যারা এই বিষয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন তারা হলেনঃ ড. থমাস বুদজিনস্কি, মনোবিজ্ঞানী মাইকেল জয়েস, ডেভিড সিভার এবং ট্রান্সপারেন্ট করপোরেশন নামক একটি কোম্পানীর ড. টিনা হুয়াং।
আশা করি আজকের লেখাটা পড়ে আপনি সময়ের সাথে সাথে এই প্রযুক্তির বিষয়ে কি ধরণের গবেষণা হয়েছে সে বিষয়ে কিছুটা হলেও একটা ধারণা পেয়েছেন।
আগামী একটি পর্বে এই প্রযুক্তি কিভাবে কাজ করে সে বিষয়ে আপনাদের জানাব।
তবে এই প্রযুক্তি কিভাবে কাজ করে তা বুঝতে হলে এই প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিত কিছু বিষয় সম্বন্ধে ধারণা থাকা দরকার। এই বিষয়গুলো না জানা থাকলে এই প্রযুক্তির কার্যপ্রণালী আপনি পুরোপুরি বুঝতে পারবেন না।
আগামী পর্বে আমি সেই সব বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা করব।
আশা করি সে পর্যন্ত ভাল থাকবেন। আজকের মত এখানেই শেষ করছি।
~ এহসান
(চলবে......)
আগের পর্বঃ
১। পর্ব -০১: বিস্ময়কর প্রযুক্তি ব্রেনওয়েভ এনট্রেইনমেন্টঃ (পরিচয় হওয়ার গল্প)
২। পর্ব -০২: বিস্ময়কর প্রযুক্তি ব্রেনওয়েভ এনট্রেইনমেন্টঃ (আমাদের জীবনে এর ব্যবহার)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।