জীবনে কোনো দিন প্রিজন ভ্যানে উঠিনি। এ নিয়ে কোনো কৌতূহলও ছিল না কখনো। রাস্তায় মাঝে-মধ্যে প্রিজন ভ্যানের দেখা মিলত। অনেক আসামি নিয়ে যখন রাজপথ দিয়ে যেত তখন ভেতরের লোকজন দাঁড়িয়ে ভ্যানের ওপরের অংশের ক্ষুদ্র জানালা নামক নেট দেওয়া সরু ছিদ্র দিয়ে আশপাশের পথচারীদের দেখত। কেউবা হাত নাড়ত।
আমি যখন কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে থেকে ভ্যানে ওঠলাম তখন রাত হয়ে গেছে। সেখানে একটি কাকপক্ষীও ছিল না। বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভ্যানে ওঠলাম। আত্মবিশ্বাস বললাম এ কারণে যে, আমার মোশন সিকনেস রয়েছে।
গাড়িতে উঠলেই প্রথমে বমি বমি ভাব হয়। কিছুক্ষণ পর ওয়াক করে তা ছেড়ে দেওয়ার অভ্যাস। খুব ছোটকাল থেকেই শারীরিক এই দুর্বলতা বহন করে আসছি। শত চেষ্টা করেও তা ছাড়াতে পারিনি। অনেকে পরামর্শ দিয়েছে নানানভাবে।
কেউবা বলেছেন, ট্যাবলেট বড়ি খেতে, কেউবা বলেছেন চুইংগাম চিবাতে। আবার গ্রামের লোকজন বলত মুখের ভেতর ধাতব পয়সা ঢুকিয়ে তা চুষতে। আমি কালক্রমে সবই করেছি কিন্তু বমি বন্ধ করতে পারিনি। খুবই আরামদায়ক এবং শব্দবিহীন পৃথিবীর নামকরা গাড়িগুলোতেও আমার অভ্যাস বদলাতে পারিনি। তাই আজ গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়েই প্রিজন ভ্যানে উঠলাম এবং মনে মনে বললাম— কোনো অবস্থাতেই বমি করা চলবে না।
বমি না করার দৃপ্ত প্রত্যয়ের পেছনে অবশ্য প্রয়োজনীয় একটা কারণও ছিল। আমি ছিলাম সারা দিন রোজা। রোজা অবস্থায় কোর্ট-কাচারি, তারপর কারাগারে আগমন এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে অন্য স্থানে বদলির আদেশে মানসিকভাবে বিক্ষুব্ধ ছিলাম। ফলে ইফতারির সময় পর্যন্ত খাবার গ্রহণ করতে পারিনি। পেটে তখন খাদ্য ও পানির বেশ চাহিদা ছিল।
কাজেই গাড়ির মধ্যে যদি বমি করে দেই তবে পেট তো খালি হয়ে যাবে। খাব কি? গাড়ি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা যেমন জানতাম না তদ্রূপ আমার পরবর্তী ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে তাও অনুমান করতে পারছিলাম না। সম্ভবত অন্য কোনো জেলে। হতে পারে নারায়ণগঞ্জ, কিংবা গাজীপুর বা কাশিমপুর। সরকার যদি আমার প্রতি খুবই বিরক্ত হয় তবে পাঠাতে পারে নরসিংদী জেলে।
ঢাকা জেলের স্বল্পকালীন সময়ে জেনেছিলাম, বন্দীদের রাতের খাবার লকআপ হওয়ার আগেই রুমে রুমে পৌঁছে দেওয়া হয়। সাধারণত সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে লকআপ হয়ে যায়। আমি যখন ঢাকা কারাগার থেকে রওনা দিলাম তখন রাত ৮টা পার হয়ে গিয়েছিল। কাজেই রাত ১২টার আগে কোনো জেলগেটে পৌঁছা সম্ভব নয়। রাস্তায় যানজট।
কারণ ঢাকা মহনগরী তখন ভীষণ ব্যস্ত ঈদের কেনাকাটা নিয়ে।
যা বলছিলাম। বমি করব না বলে দৃঢ়তার সঙ্গে মানসিক প্রস্তুতি নিলাম। বিরাট প্রিজনভ্যান। আমি একাই যাত্রী।
আমাকে ঢুকিয়ে লকআপ করে দেওয়া হলো। কয়েকজন সিপাহি লকআপের বাইরে অর্থাত্ প্রিজন ভ্যানের একদম পেছনে একটি বেঞ্চের ওপর বসে রইল। আমাকে তালাবদ্ধ করে চাবি নিয়ে গেল ড্রাইভার। অর্থাত্ গাড়িতে চলার পথে আমি যদি মারাত্মক কোনো সমস্যায় পড়ি পেছনে বসা সিপাহিরা ইচ্ছা করলেও আমাকে সাহায্য করতে পারবে না। অবস্থাদৃষ্টে আমি নিজের মনকে আরও মজবুত হওয়ার জন্য অটোসাজেশন দিতে থাকলাম।
প্রিজন ভ্যানের মধ্যে লোহার তৈরি দুটি বেঞ্চ পাতা রয়েছে। আর আছে দাঁড়িয়ে থাকার সময় ধরার জন্য ছাদের সঙ্গে লটকানো একটি লোহার রড। ভেতরে কোনো লাইট বা বসা অবস্থায় ধরার জন্য কোনো হাতল নেই। চারদিকে ময়লা এবং ছেঁড়া কাগজের স্তূপ। গুমোট গরমের পচা গন্ধের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষের ফেলা থুথুর উত্কট গন্ধ পাচ্ছিলাম।
গাড়ির ভেতরকার নোংরা পরিবেশের কারণে প্রথমেই আমার মাথা ঘুরতে আরম্ভ করল। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিল। বহু পুরনো ডিজেল ইঞ্জিনের লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা গাড়ি। ফলে গগণবিদারী বিকট আওয়াজ এবং দুর্গন্ধযুক্ত কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গাড়ি চলা শুরু করল। কোনো জানালা না থাকার কারণে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
তাই নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য আমি ওঠে দাঁড়ালাম।
এত কিছুর মধ্যেও আমার বেশ হাসি পাচ্ছিল। কারণ রাস্তায় চলতে গিয়ে আমি যখন প্রিজন ভ্যানগুলোতে আসামিদের উপরের নেট দেওয়া সরু ছিদ্রপথ দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি মারতে দেখতাম তখন মাঝে-মধ্যে মনে প্রশ্ন জাগত— ওরা এমন করে কেন। আজ নিজে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে সেসব আসামির দুরবস্থার বাস্তব রূপ বুঝতে পেরে কিছুটা হলেও আবিষ্কারের আনন্দে প্রীত হলাম। আরও একটি ঘটনা আমার মনে পড়ল— কুকুরের কথা।
পৃথিবীতে কুকুরই নাকি একমাত্র প্রাণী যে কিনা নিজের বমি আবার নিজেই খেতে পারে। স্মরণ করতেই সারা শরীর ঘিন ঘিন ঘৃণায় রি রি করে উঠল।
একাকিত্ব হলো জীবনের সাধনা লাভের উত্কৃষ্ট উপায়। উর্দু বা হিন্দুতে একাকিত্বকে বলা হয় তানহা। আল্লাহ রাসূল (সা.)-কে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল— জীবন সম্পর্কে সত্যিকার উপলব্ধি কীভাবে অর্জন করা যায়।
তিনি বলেছিলেন— তানহা বা একাকিত্ব। হুজুর (সা.)-এর কোনো হাদিস বর্ণনা করতে হলে রাবি বা বর্ণনাকারীর নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন। এই হাদিসটির রাবির নাম আমার মনে নেই। কিংবা কোন গ্রন্থে তা উল্লেখ রয়েছে তাও বলতে পারব না। তবে বিখ্যাত হাদিস বেত্তা ড. তাহির উল কাদরীর কাছে আমি এটি শুনেছিলাম।
একাকিত্ব মানুষের জীবনে পূর্ণতা দেয়। পৃথিবীর তাবত্ বিখ্যাত ও মহান ব্যক্তি তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ একাকিত্বে কাটিয়েছেন। কখনো ইচ্ছা করে আবার কখনো বা বাধ্য হয়ে। তারা কেউবা গেছেন নির্জন পাহাড়ের কোনো গুহায়, অথবা গভীর জঙ্গলে। আবার কারও ভাগ্যে ঘটেছে কারাবাস।
হজরত ইউসুফ (আ.) ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বা ইমাম আবদুল মালেকের কারাবাসের ঘটনা আমরা অনেকেই জানি।
আমি যখন এসব ভাবছিলাম তখন গাড়ি বেশ হেলে-দুলে পুরান ঢাকার অলিগলি পার হয়ে বঙ্গবাজার ডান দিকে রেখে বামে পলাশীর দিকে মোড় নিল। আমি নিশ্চিত হলাম— আমাকে নারায়ণগঞ্জ নেওয়া হচ্ছে না। রাস্তায় চলাচলকারী শত শত গাড়ির হর্ন, ইঞ্জিনের শব্দ এবং মানুষের চিত্কার-চেচামেচিতে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল। শব্দ দূষণ যে কাকে বলে— সেদিন তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।
গাড়ি জ্যামের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল হোটেল সোনারগাঁওয়ের সামনে। লোকজন রাস্তা পার হচ্ছিল। আগে কখনো মনোযোগ দিয়ে রাস্তা পার দেখিনি। কিন্তু আজ দেখলাম, কেউ কেউ খুব সতর্কতার সঙ্গে ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে ধীরে ধীরে পার হচ্ছে। কেউবা আবার কোনো দিকে না তাকিয়ে ভোঁ দৌড় দিয়ে পার হচ্ছিল।
স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক যুগল একে অপরকে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে আঁকড়ে ধরে পার হচ্ছিল— যেন গাড়ির তলে পড়লে দু’জনে একসঙ্গেই পড়বে বা মরবে।
আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং রাস্তার পাশের চিরচেনা দৃশ্য দেখতে দেখতে অচেনা চিন্তার জগতে বিচরণ করছিলাম। এবার আমি বসলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম ধ্যান করব।
দুই ধরনের ধ্যান আমার জানা আছে। ইসলামী ধর্মমতে- মারফতের লাইনের কিছু ধ্যান আমি জনৈক সম্মানিত পীরের কাছে তালিম নিয়েছিলাম। আবার কোয়ান্টাম মেথড অনুযায়ী গুরুজি ওরফে মহাজাতকের পরিচালনায় কোয়ান্টম কোর্সের ওপর গ্রাজুয়েশন করেছিলাম। আমার মনে হয়, পৃথিবীর তাবত্ ভালো জিনিসের মূল বা রুট যেমন এক তদ্রূপ মন্দ জিনিসের রুটও একই রকম। বহু বছর আগে পীর সাহেবের দরবারে ধ্যানের যে তালিম নিয়েছিলাম তা প্রায় হুবহুই দেখলাম মহাজাতকের দরবারে।
যারা গভীর ধ্যানমগ্ন হওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছেন তারা সহজেই যে কোনো বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও নিজেকে সম্পূর্ণরূপে অন্যভুবনে নিয়ে যাওয়ার কৌশল জানেন। নিজের বিশ্বাস, আস্থা এবং অবিচলতা দিয়ে আপন ভুবন তৈরি করে সেখানে ডুবে থাকতে পারেন। নজরুল যেটি বলেছেন— ‘আমি জাহান্নামে বসে হাসি পুষ্পের হাসি। ’ এটা কেবল কথার কথা নয় কিংবা নিছক একটি কবিতার লাইন নয়। পৃথিবীতে এমন বহু উদাহরণ পাওয়া যাবে যেখানে মানবরূপী মহামানবেরা জাহান্নামের আগুনের মতো ভয়ঙ্কর বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পুষ্পের হাসি হেসেছেন।
পবিত্র কোরআনে হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর ঘটনা স্বয়ং আল্লাহপাক বর্ণনা করেছেন। অত্যাচারী পৌত্তলিক শাসক যখন তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার জন্য চিতার আগুন জ্বালাল তখন মুসলমান জাতির পিতা নির্বকাির চিত্তে বসে রইলেন কোনো উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠা প্রকাশ না করেই। ফেরেশতারা তাকে সাহায্য করার প্রস্তাব দিলেন। তিনি ততোধিক নির্বিকার চিত্তে উত্তর দিলেন— ‘আমি তো কোনো অন্ধ খোদার ইবাদত করি না যে, তোমাদের সাহায্য লাগবে। ’ পরবর্তী ইতিহাস সবারই জানা।
হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মহাকবি আল্লামা ইকবাল বলেছেন— সেই আল্লাহ এবং সেই আগুন এখনো বিদ্যমান— কেবল নেই ইব্রাহিম (আ.)। আজও যদি কোনো ইব্রাহিমকে অগ্নিকুণ্ডে ফেলা হতো তবে সেখানে আগুনের পরিবর্তে সুন্দর এক গুলিস্তান (ফুলের বাগান) পয়দা হয়ে যেত।
ধ্যানগ্রস্ত হয়ে মহত্ কিছু ভাবার বহু চেষ্টা আমি অনেকবার করেছি। কিন্তু সফল হতে পারিনি। পাহাড়, সমুদ্র বা বনভূমির কাছাকাছি নির্জন এলাকাতে একাকী চলে গিয়েছি কেবল সিদ্ধি লাভ করার জন্য।
কিন্তু সিদ্ধি লাভ তো দূরের কথা সাধারণ সফলতাও অর্জন করতে পারিনি। শৈশব থেকেই পীর আউলিয়াদের মহত্ব ও কেরামতি নিয়ে নানান কাহিনী শুনে আসছি। কেউ জায়নামাজে করে নদী পার হয়েছেন, কেউবা পানির ওপর দিয়ে হেঁটে গেছেন আবার কেউ কেউ বাতাসে উড়ে বেড়িয়েছেন। আল্লার অলিদের এসব কারামতি আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি এবং মাঝে-মধ্যে সাধনা করি, অলি-আল্লাহ হওয়ার জন্য। কিন্তু আমার শত শত দুর্বলতা, অজ্ঞানতা এবং অলসতা আমাকে কাঙ্ক্ষিত পথে অগ্রসর হতে দেয়নি।
যদিও সুযোগ আমি কম পাইনি। মহান আল্লাহ আমাকে যতই সুযোগ দিয়েছেন আমি নাফরমানির মাধ্যমে সুযোগগুলোর ব্যবহার ঠিকমতো করতে পারিনি।
প্রিজন ভ্যানটি হেলে দুলে এগিয়ে যাচ্ছিল। ধারণা করলাম মহাখালী ওভারব্রিজ পার হচ্ছে। আমি ভ্যানের মধ্যে রক্ষিত একটি হাতলওয়ালা প্লাস্টিকের চেয়ার দেখতে পেয়ে সেখানে বসে পড়লাম।
সেখানে তখন আলো-আঁধারির লুকোচুরি হচ্ছিল। রাস্তার পাশের লাইটপোস্টের বা কোনো নিয়ন সাইনের আলো মাঝে মধ্যে প্রিজন ভ্যানের উপরের দিককার লোহার জালিযুক্ত ক্ষুদ্র জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে কিছুটা আলোকময় করছিল। অন্যথায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। আবহাওয়াও বেশ গরম। ঘামছিলাম।
দুর্গন্ধ ও শব্দদূষণ তো ছিলই। এরই মধ্যে আমি ধ্যান করার চেষ্টায়রত হলাম। উদ্দেশ্য নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানো। অর্থাত্ পথিমধ্যে যেন বমি না হয়। কিংবা অন্য কোনো প্রাকৃতিক কর্মের জরুরত না পড়ে।
কিন্তু কিভাবে ধ্যান মগ্ন হব। ! আমি যে জীবনে কর্মটি কখনো ভালোভাবে একবারের জন্যও পারিনি।
১৯৯১-৯২ সালের দিকে আমার পীর সাহেবের বাসায় নিয়মিত ধ্যানের অনুশীলন হতো। আমরা বলতাম মোরাকাবা। আমার সঙ্গী পীর-ভাইয়েরা কঠোর অনুশীলন করে তরতর করে পদোন্নতি পেয়ে উপরে ওঠে যাচ্ছিলেন।
কিন্তু আমি এগুতেই পারছিলাম না। আমার পীর সাহেব আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। আমাদের সমাজে পীর বলতে যেমনটি বোঝায় অর্থাত্ বড়সড় একটি দরগা থাকতে হবে। বহুসংখ্যক অনুসারী থাকবে। বিশেষ বিশেষ পার্বণ উপলক্ষে মুরিদানরা পীরের বাড়িতে আসবেন নানারকম উপহার নিয়ে।
শুরু হবে জলসা বা ওয়াজ মাহফিল। বড় সড় একটি সিংহাসনে পীর সাহেব বসে থাকবেন। পীরের খলিফারা ওয়াজ করবেন আর ফাঁকে ফাঁকে পীরের কেরামতি বর্ণনা করবেন। এসব কেরামতের কথা শুনে উপস্থিত মুরিদানরা হাউমাউ করে কান্না শুরু করবেন। তারপর গরু বা খাসির গো্ত দিয়ে ভূরিভোজন।
আমার পীর সাহেবের দরবার অবশ্য ওরকম ছিল না। মতিঝিলের কলোনির মধ্যে পীর সাহেবের সরকারি বাসা। এটাকে বলা হতো পোস্ট অফিস কলোনি। এজিবি কলোনির উল্টোদিকে এবং টিঅ্যান্ডটি কলেজের ঠিক পাশে। পীর সাহেবের সরকারি পদবি ছিল অ্যাডিশনাল পোস্টমাস্টার জেনারেল।
বয়স্ক মানুষ, চাকরিও বেশি দিন ছিল না। তার ড্রয়িংরুমে আমরা ৪০/৫০ জন ভক্ত প্রতি সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর তালিম নিতাম। পীর সাহেবের শেখানো সূত্র মতে, চোখ বুঝে ধ্যান করতে হতো নিবিষ্ট মনে একাগ্রতার সঙ্গে। কখনো একঘণ্টা ধরে চোখ বুঝে থাকতে হতো। ৫/৬ মিনিট পরই শুরু হতো আমার উসখুশ।
আমি ধ্যানগ্রস্ত অবস্থায় গোপনে চোখ মেলে দেখতাম— অন্যরা কি করছে। সবাই ধ্যানমগ্ন কেবল আমি ছাড়া। এরপর শুরু হতো শরীরের নানা স্থানে চুলকানি যাকে আমরা আক্ষরিক ভাষায় বলি খাউজ। মাঝে মধ্যে হাঁচি আসত এবং বিকট শব্দে হাঁচি দিতাম। এভাবেই প্রায় এক বছর চেষ্টা করলাম।
আমার কোনো উন্নতি হচ্ছে না দেখে পীর সাহেব আমার প্রতি উত্সাহ হারিয়ে ফেললেন। তদ্রূপ আমিও নিজের অপারগতার কারণে দরবারে যাতায়াত কমিয়ে দিলাম এবং এক সময় বন্ধ করে দিলাম। এর ২/৩ বছর পর পীর সাহেব ইন্তেকাল (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন) করলেন। এখন প্রায়ই আফসোস হয় সেই দিনগুলোর জন্য। একটু সতর্ক হলে হয়তো আমিও ভালো কিছু করতে পারতাম।
এবার বলি কোয়ান্টাম সম্পর্কে। সবাই পরামর্শ দিল একবার গিয়ে কোয়ান্টামে কোর্স করে এসো। ভালো লাগবে। তখন আমি এমপি হিসেবে দুই বছর পার করেছি। টেলিভিশনের টকশো ও লেখালেখির কারণে বেশ পরিচিতি পেয়েছি।
কিন্তু বিভিন্ন কারণে মন অশান্ত থাকত সারাক্ষণ। দিনে-রাতে ঘুম আসত না। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি প্রায়ই ধৈর্য হারিয়ে ফেলছি। আমার সমস্যার শুরুটা হয়েছিল আমার একটি নতুন ব্যবসার সমস্যা এবং ক্রমাগত লোকসান নিয়ে। সারা জীবনের সঞ্চয় এবং ব্যাংকের লোন নিয়ে একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি দিয়েছিলাম এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগেই।
কিন্তু এমপি হওয়ার পর আমার দৈনন্দিন ব্যস্ততা এত বেড়ে গেল যে, ব্যবসায় সময় দেওয়া একদম সম্ভব হচ্ছিল না। আমার অন্যসব পুরনো ব্যবসা কোনো মতে টেনেটুনে চলছিল। কিন্তু গার্মেন্টটি নিয়ে পড়লাম মহা ঝামেলায়। রোজই একটা না একটা সমস্যা লেগেই থাকে আর প্রতিটি রপ্তানির ক্ষেত্রেই ক্রমাগত লোকশান গুনতে থাকলাম। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে— বসুন্ধরা এলাকায় বহু আগে কেনা ২৩ কাঠা জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলাম।
জমিটি কিনেছিলাম সুন্দর একটি বাড়ি করার মানসে। শুধু এখানেই শেষ নয়— আমার প্রিয় লেক্সাস জিপটিও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলাম দায় মেটানোর জন্য। বহু বছর ধরে আমি সচ্ছল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। সুন্দর গাড়ি, পোশাক আশাক, খাবার-দাবার এবং বিদেশ ভ্রমণ আমার পারিবারিক জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মাত্র দুই বছরের মধ্যে আমি বলতে গেলে দরিদ্র ব্যক্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছিলাম।
ফ্যাক্টরিটি প্রথমে বিক্রি করার জন্য বহু চেষ্টা-তদবির করলাম। এরপর চেষ্টা করলাম ভাড়া দেওয়ার জন্য। উভয় ক্ষেত্রেই আমার সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো। এরই মধ্যে কয়েকবার শ্রমিক অসন্তোষ, বিশ্বব্যাপী নিট গার্মেন্ট ব্যবসায় ধস এবং ব্যাংকের দেনার দায় সীমা অতিক্রম করার কারণে এলসি করা বন্ধ হয়ে গেল। এ অবস্থায় বন্ধুরা বলল, কোয়ান্টামে কোর্স করার জন্য।
আমার এত অভাবের মধ্যেও নয় হাজার টাকা ফি দিয়ে কোয়ান্টম কোর্সে ভর্তি হলাম। তিন দিনের কোর্স। প্রতিদিন বিরতিহীনভাবে সকাল থেকে রাত ৮টা অবধি কোর্স চলবে। তখন আবার সংসদ অধিবেশন চলছিল। আমি সব কিছু বাদ দিয়ে একান্ত অনুগত ছাত্রের মতো কোর্সে অংশগ্রহণ করলাম।
খুব মনোযোগ দিয়ে গুরুজির বক্তব্য শুনলাম। এক অর্থে চমত্কার এবং মনোমুগ্ধকর। তার বক্তব্যের সারবেত্তা, প্রকাশভঙ্গি এবং উপস্থাপনা যে কোনো অমনোযোগী ছাত্রও মনোযোগের সঙ্গে শুনতে বাধ্য। আমিও শুনলাম এবং মনে মনে বেশ প্রশান্তি অনুভব করলাম। কিন্তু সমস্যা বাঁধল অন্য জায়গায়।
কোর্সের দ্বিতীয় দিন থেকে শুরু হলো মেডিটেশন বা ধ্যান পর্ব। কিছুক্ষণ বক্তৃতা আবার কিছুক্ষণ ধ্যান। গুরুজির হুকুমে চোখ বুঝে ধ্যান করতে হবে। আমিও চোখ বুঝলাম। কিন্তু ২/৩ মিনিট পর শুরু হলো উসখুশ।
আমরা চোখ বুঝে গুরুজির বক্তব্য শুনছিলাম এবং সেমতে নিজেদের মনকে পরিচালিত করার কৌশল রপ্ত করছিলাম। হয়তো অনেকে পারছিল। কিন্তু আমি পারছিলাম না। আমি এক ফাঁকে চোখ খুলে আশপাশের দৃশ্য এবং গুরুজিকে দেখার চেষ্টা করলাম। আমি এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখ দিয়ে এমনভাবে দেখার চেষ্টা করলাম যেন কেউ বুঝতে না পারে।
ধ্যানের সময় পুরো হলরুমে পিনপতন নীরবতা চলছিল। হলভর্তি লোক। কম করে হলেও পনেরশ’ তো হবেই। আমার আসন ছিল একদম সামনে। সম্ভবত এমপি হিসেবে আমাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে সামনে বসানো হয়েছিল।
আমার পাশের সিটে ছিলেন সেনা গায়েন্দা সংস্থা অর্থাত্ ডিজিএফআইএর এক পরিচালক। নাম কর্নেল সরোয়ার। তিনি মূলত মিডিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিধায় আমাকে ভালোভাবে চিনতেন। কোর্স শুরু হওয়ার প্রারম্ভে আমাদের মধ্যে পারস্পরিক পরিচয় হয় এবং সঙ্গে কিছু হূদ্যতাও হয়ে যায়। তিনি মূলত এসেছেন তার মেয়েকে নিয়ে।
সুযোগ পেয়ে নিজেও কোর্সটি করছেন। ধ্যান পর্বে আমার অমনোযোগিতার প্রাথমিক পর্বে আমি চোখ খুলে প্রথমেই তাকালাম কর্নেল সরেয়ারের দিকে। সে তখনো চোখ বুঝে ছিল বটে তবে জোর করে চোখ বুঝে থাকলে চোখ যেমন পিট পিট করে পলক মারে— তার চোখও তেমন নড়ছিল। আমার অন্যপাশে বসা ভদ্রলোক দেখি হা করে ঘুমোচ্ছেন আর গড় গড় ফটাস ফটাস শব্দ করে নাক ডাকতে শুরু করেছেন। আমি আর স্থিল থাকতে পারলাম না।
শুরু হলো হাসি। চোখ বুঝে আমি কুট কুট করে হাসতে শুরু করলাম। আর ফাঁকে ফাঁকে গুরুজির দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে দেখতে চেষ্টা করলাম যে, তিনি আমার অপকর্ম লক্ষ্য করছেন কিনা। দেখলাম তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছেন! আমি এবার সত্যিই চোখ বুঝলাম এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম ধ্যানমগ্ন হওয়ার জন্য।
আমাদের গাড়িটি ইতোমধ্যে উত্তরা পার হতে চলেছে।
ধ্যানে বসার আগে আমি আরও একবার দাঁড়িয়ে রাস্তার অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলাম। এরপর বসে চোখ বুঝে ধ্যানের প্রাথমিক শপথগুলো মনে মনে উচ্চারণ করে পছন্দমতো আনন্দভুবনে ঢোকার চেষ্টা করলাম। সময়টা ছিল শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি। আমি গ্রামের ছেলে। শৈশব ও কৈশর কেটেছে পল্লীগ্রামে—ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানায়।
আমি নিজেকে নিয়ে গেলাম প্রায় ৪০ বছর পেছনে এমনই শ্রাবণ মাসের কোনো এক বিকেলে। আমাদের গ্রামের বাড়িগুলো প্রায় সবই ছিল সাধারণ ভূমি থেকে ১৪/১৫ ফুট উঁচুতে। মূলত বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গৃহস্থরা এত উঁচুতে বাড়ি নির্মাণ করত। তার পরও ভরা বর্ষার মৌসুমে অনেকের বাড়িতে পানি উঠত। বাড়ির ভূমি থেকে আরও ৪/৫ ফুট উঁচু করে ঘর তৈরি করত।
ফলে অনেক সময় বাড়ির সামনের ওঠোনে পানি চলে আসত। শিশু-কিশোরদের তখন আনন্দের সীমা থাকত না। ঘর থেকে নামলেই হাঁটু পানি। অনেকে ঘরের দরজার সামনে বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরত।
আমি কল্পনার জগতে ডুবে গিয়ে সেই সময়কার এক বিকেলের কথা স্মরণ করার চেষ্টা করলাম।
সাধারণত আষাঢ় মাসে চারদিকে পানি থৈ থৈ করত। পানির রং হতো খোলাটে এবং স্রোতও থাকত প্রবল। কিন্তু শ্রাবণের মাঝামাঝি সময় পানি এমন পরিষ্কার হয়ে যেত, ১০/১২ ফুট নিচের ঘাস ও মাটি স্পষ্ট দেখা যেত। হাজারও প্রজাতির ছোট ছোট রঙবেরঙের মাছ পানির নিচে দিয়ে দলবদ্ধভাবে সাঁতার কাটত। গজার, শৈল প্রভৃতি মাছের পোনা তাদের মায়ের তত্ত্বাবধানে ঘুরে বেড়াত।
কোনো বিপদের আঁচ পাওয়া মাত্র মা মাছটি হা করত আর বাচ্চারা সব মায়ের মুখের ভেতর লুকাত।
আমাদের বাড়িতে বেশ কয়েকটি নৌকা ছিল বর্ষাকালে চলাচলের জন্য। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোট নৌকাটি ছিল আমার। আমরা স্থানীয় ভাষায় বলতাম কোষা নৌকা। আমার কাকা আমাকে আদর করে নৌকাটি কিনে দিয়েছিলেন।
বিকেল বেলা নৌকা নিয়ে বের হতাম বেড়ানোর জন্য।
শ্রাবণ মাসের এক বিকেলে আমি আমার কোষা নৌকাটি নিয়ে বের হলাম। আকাশ ছিল স্বচ্ছ এবং মেঘমুক্ত। ঝির ঝির বাতাস বইছিল। বাড়ির সামনের আমন ধানের ১০/১২ বিঘার ক্ষেতটি পার হলেই দিগন্ত জোড়া খালি জায়গা।
আগে পাটক্ষেত ছিল। কিছু দিন হলো পাট কেটে নিয়ে গেছে। কয়েকশ’ বিঘাব্যাপী উন্মুক্ত এলাকা। নিচে স্বচ্ছ পানি আর উপরে নীল আকাশ। মৃদুমন্দ বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ আমার কোষা নৌকার সঙ্গে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পর অন্তত এক ছন্দময় শব্দ সৃষ্টি করছে।
সম্পূর্ণ নির্জন এলাকা। আশপাশে কোনো লোকজন নেই। যতদুর চোখ যায় কেবল পানি আর পানি। কিছু দূর পর পর কেবল কয়েকটি তালগাছ বীরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। শ্রাবণের বাতাসে তালগাছের পাতায় কেমন যেন বাঁশির মতো এক ধরনের আওয়াজ করছিল।
সূর্য তখন ডুবু ডুবু। পাখিরা দল বেঁধে উঠে যাচ্ছে আপন নিড়ে। প্রকৃতির এমনতরো একটি পরিবেশে আমি কোষা নৌকাটির ওপর চিত্ হয়ে শুয়ে পড়লাম। দৃষ্টি তখন আকাশের দিকে। আমি শুয়ে আছি চিত্ হয়ে আর আমার নৌকাটি মৃদু ঢেউয়ের তালে ছন্দময় গতিতে দোল খাচ্ছে।
একবার মনে হলো আবেশে চোখ বুজি। কিন্তু নীল আকাশের অপার সৌন্দর্য এবং পশ্চিম আকাশের রক্তিম আভা আমাকে চোখ বুজতে দিল না। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে একবার আল্লাহকে খোঁজার চেষ্টা করলাম আবার পশ্চিম দিগন্তে তাকিয়ে আকাশের লাল রঙের মধ্যে ইমাম হাসান-হোসেনকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। এমন সময় কিসের যেন একটি আঘাত লাগল আমার নৌকাটিতে। বেশ বড়সড় আঘাত।
আমি উঠে বসলাম এবং পানির দিকে তাকালাম। বিরাট একটি বোয়াল মাছ আমার নৌকার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দুষ্টুমি করে লেজ দিয়ে একটি আঘাত করে গেল। প্রবল সেই আঘাতে নৌকাটি সেই মুহূর্তে দুলে উঠল এবং আমাকে আকাশ দেখার ধ্যান থেকে জমিনে নামিয়ে আনল। আমার চিন্তা যখন এ পর্যন্ত এগুলো তখনই টের পেলাম আমাদের প্রিজন ভ্যানের লকআপ খুলে গেছে এবং সিপাহিরা আমাকে ডেকে বলছে, নামেন। আমরা এসে গেছি।
আমি নামলাম এবং ফটকের দিকে তাকালাম। ফটকের উপরে লেখা কাশিমপুর কারাগার।
(বাংলাদেশ প্রতিদিন- এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।