চট্টগ্রামের হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা মুফতি ইজাহারুল ইসলামের মাদরাসা জমিয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়ায় গত সোমবারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটিকে যখন পুলিশ প্রশাসন ও দেশের একশ্রেণীর মিডিয়া ‘গ্রেনেড বিস্ফোরণ’ বা ‘বোমা তৈরির সময়’ বিস্ফোরণ হিসাবে উপস্থাপনের প্রাণান্তকর চেষ্টায় রত, তখন এ ঘটনায় আহতদের চিকিত্সকরা দিলেন ভিন্ন তথ্য। তারা জানিয়েছেন, এ ঘটনায় হতাহতদের কারো শরীরে বোমা বা গ্রেনেডের স্পিল্গন্টার এমনকি এসবে ব্যবহৃত কোনো উপাদানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
এদিকে এ ঘটনায় মুফতি ইজাহারুল ইসলামের ছেলে মুফতি হারুন ইজাহারকে গতকাল গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুটি মামলায় ৫ দিন করে ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
ডাক্তার বলছেন, বিস্ফোরকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চিকিত্সক মোতাহার হোসেন জানিয়েছেন, মাদরাসা থেকে আসা আহতদের কারো শরীরে তারা স্পিল্গন্টার পাননি, এ ধরনের কোনো ক্ষতও তাদের শরীরে দেখা যায়নি। তিনি জানান, মারা যাওয়া একজনের শরীরের নব্বই শতাংশই পুড়ে গেছে।
অপরজনের শরীরের ৮৫ শতাংশ দগ্ধ ছিল। ডা. মোতাহার আরো জানান, অন্যান্য যারা হাসপাতালে আছে তারাও আগুনে পুড়ে আহত।
পুলিশের বক্তব্য এখনও অনুমাননির্ভর : এদিকে বিস্ফোরণ কী কারণে হয়েছে, সে সম্পর্কে ঘটনার তিনদিন পরও অনুমান ছাড়া নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না তদন্ত সংশ্লিষ্ট কেউ।
পুলিশের পক্ষ থেকে ‘গ্রেনেড তৈরির সরঞ্জাম’ বলে যেসব জিনিস উদ্ধার করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে, সেগুলো আদৌ গ্রেনেড তৈরির উপকরণ কিনা তা নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, গ্রেনেড বা বোমার বিস্ফোরণ হলে হতাহতদের শরীরে স্পিল্গন্টারের আঘাত থাকতো কিংবা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো।
কিন্তু এ ঘটনায় হতাহতদের ক্ষেত্রে তেমন কিছুই ঘটেনি। হতাহতদের সবার শরীরই ছিল আগুনে ঝলসানো।
এদিকে বিস্ফোরণের পরপরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন অপরাধ দমন বিভাগ সিআইডির চট্টগ্রাম জোনের সহকারী পুলিশ সুপার হ্লা চিং প্রু। তিনি জানান, সেখানে মানুষের শরীরের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চোখে পড়েনি।
একই সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যে রুমে বিস্ফোরণের পর সেখানকার প্রায় সবকিছু পড়ে ছাই হয়ে গেল, এমনকি সিলিংয়ে ঝোলানো ফ্যানের পাখাও ক্ষতিগ্রস্ত হলো, সেই রুমে কীভাবে কথিত ‘তাজা তিনটি গ্রেনেড’ অবিস্ফোরিত থেকে যায়? এবং পরে সেগুলো পুলিশ উদ্ধার করে!
যদিও মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ও কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম প্রথম থেকেই দাবি করে আসছে, এটি স্রেফ অগ্নিকাণ্ডের একটি ঘটনা, যার সূত্রপাত ল্যাপটপের চার্জার থেকে।
তাছাড়া সেখানে রান্নার জন্য কেরোসিনের চুলা থাকায় আগুন ব্যাপক আকার ধারণ করে। ‘গ্রেনেড বিস্ফোরণ’ বলে প্রচারকে তারা ‘পুলিশের নাটক’ বলে অভিহিত করেছেন।
এদিকে এ ঘটনায় পুলিশ চট্টগ্রামের খুলশী থানায় দুটি মামলা করেছে, যার মধ্যে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে। মামলাটির ব্যাপারে খুলশী এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত সিএমপির পাঁচলাইশ জোনের সহকারী কমিশনার শাহ মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেন, এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তদন্ত করছেন, গোয়েন্দা পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট কাজ করছে, সেখানে কী ধরনের বিস্ফোরণ ঘটেছে তা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তদন্ত করে দেখছেন।
ঘটনাস্থলে গোয়েন্দা পুলিশ ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা সিআইডি টিম পরিদর্শন করে আলামত সংগ্রহ করেছে।
এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের একাধিক টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেককে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও করা হয়েছে।
ফায়ার ব্রিগেড তদন্ত কমিটির প্রধান আবদুল মালেক বলেছেন, কীভাবে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে সে ব্যাপারে এখনো আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি, ঘটনাস্থলে গিয়ে আমি যা দেখেছি তাতে মনে হয়েছে খুব বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটেছে, তবে এই বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানে আরো তদন্তের প্রয়োজন আছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার উপ-কমিশনার কুসুম দেওয়ান জানান, বিস্ফোরণের ধরন নিয়ে এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না, ঘটনাস্থল থেকে যেসব আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে সেসব বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে।
উদ্ধার করা সরঞ্জাম নিয়ে সন্দেহ : পুলিশের উদ্ধার করা ‘গ্রেনেড তৈরির সরঞ্জাম’ বলে দাবি করা বস্তুগুলো নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
মাদরাসার এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যা উদ্ধার করা হয়েছে, তার কিছু জিনিস বাসার পাইপের ফিটিংস। মাদরাসা ও মুফতি ইজাহারের বাসার নির্মাণকাজের জন্য এগুলো এনে রাখা হয়েছিল, ঘটনাস্থল থেকে সাংবাদিকদের তোলা ছবি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেই তা ভালোভাবে বোঝা যাবে বলে তিনি দাবি করেন।
হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেছেন, মাদরাসা শিক্ষাকে বিতর্কিত করতে সরকার নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। সেজন্য তারা বোমা উদ্ধারের নামে নাটক করেছে। এটা কওমি মাদরাসার বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের চলে আসা ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রেরই একটি অংশ বলে তিনি জানান।
সরকারের এই আচরণের দাঁতভাঙা জবাব দেয়া হবে বলেও হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন মাওলানা আজিজুল হক।
মুফতি হারুন ১০ দিনের রিমান্ডে : মাদরাসায় বিস্ফোরণের ঘটনায় মুফতি ইজাহারুল ইসলামের ছেলে মুফতি হারুন ইজাহারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুটি মামলায় ৫ দিন করে ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। দুটি মামলার একটি হচ্ছে বিস্ফোরক আইন ও অন্যটি এসিড আইনের মামলা।
গত সোমবার মাদরাসাটিতে বিস্ফোরণ ও গ্রেনেড উদ্ধারের ঘটনায় খুলশী থানা পুলিশ মুফতি ইজাহার ও তার ছেলে হারুন ইজাহারসহ ১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা এবং বাসায় ‘১৮ বোতল এসিড পাওয়া’র ঘটনায় এসিড আইনে শুধু বাবা-ছেলেকে আসামি করে আরেকটি মামলা দায়ের করে।
এ দুটি মামলায় পুলিশ গতকাল দুপুরে হারুনকে মহানগর হাকিম সৈয়দ মুশফিকুল ইসলামের আদালতে হাজির করে ৭ দিন করে ১৪ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায়।
আদালত ৫ দিন করে ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।
এছাড়া শুধু বিস্ফোরক আইনে হারুনের সঙ্গে গ্রেফতার জুনায়েদ নামে অপরজনের ১ দিন ও অপর ৫ আসামির ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।
হারুন ইজাহার ও জুনায়েদকে বুধবার ভোর পৌনে ৪টার দিকে হাটহাজারী উপজেলার ইছাপুর গ্রামের জানালী চৌধুরীর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। ওই বাড়িতে তারা আত্মগোপনে ছিলেন বলে জানিয়েছেন অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া নগরীর কোতোয়ালি থানার ওসি এ কে এম মহিউদ্দিন সেলিম।
আরো একজনের মৃত্যু : সোমবারের বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত আরো একজন হাসপাতালে মারা গেছেন।
তার নাম জোবায়ের আহমদ (২৪)। তিনি মাদরাসাটির শিক্ষার্থী। গতকাল ভোর ৬টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ২। এর আগে মঙ্গলবার রাতে একই হাসপাতালে চিকিত্সাধীন আরো একজন মারা যান।
তার নাম হাবিব। বিস্ফোরণে ৫ জন আহত হয়েছিলেন।
গল্প সাজিয়ে মাদরাসা ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বরদাশত করা হবে না —ইসলামী আন্দোলন : ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চট্টগ্রাম মহানগরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলহাজ আবুল কাশেম মাতব্বর, সহ-সভাপতি নুরুল ইসলাম বিএসসি ও সেক্রেটারি মুহাম্মদ আল-ইকবাল এক বিবৃতিতে ‘মাদরাসাবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্র’ উল্লেখ করে বলেন, দুর্ঘটনার প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর ঘটনাস্থল থেকে হ্যান্ড গ্রেনেড উদ্ধার রহস্যজনক। সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য অসত্ উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে বোমা বিস্ফোরণের গালগল্প প্রচার করছে। নেতারা বলেন, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জামিয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়া মাদরাসায় রান্নার চুলা থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডের ফলে বৈদ্যুতিক আইপিএস বিস্ফোরণের নিছক দুর্ঘটনাকে সরকার বোমা বিস্ফোরণের গালগল্প সাজিয়ে দেশের কওমি মাদরাসা ধ্বংসের ষড়যন্ত্র শুরু করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর ছেলে জয় ‘মাদরাসা কমানোর জন্য আন্দোলনে নেমেছি’ বলে মাদরাসাবিরোধী যে হুমকি দিয়েছিলেন, এটা সেই ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রেরই অংশ।
নেতারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়ে বলেন, দেশের কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, যদি এ ঘটনায় কেউ দোষী হয় আইনে তার শাস্তি হবে। কিন্তু কোনো তদন্ত ছাড়াই ইসলামি নেতাদের গ্রেফতার, নিরীহ মাদরাসা ছাত্রদের হয়রানি এবং হাজার হাজার ছাত্রের লেখাপড়া বন্ধ করে মাদরাসা সিলগালা করে দেয়া কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চট্টগ্রাম মহানগর নেতারা অবিলম্বে মাদরাসা-মসজিদ খুলে দিয়ে মাদরাসায় পড়াশোনার পরিবেশ ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, লালখান বাজার মাদরাসা খুলে দিতে হবে, মসজিদে আজান-নামাজ ও জামায়াত বন্ধ মেনে নেয়া হবে না। সরকার শেষ সময়ে যা করছে, তার চরম খেসারত দিতে হবে সরকারকে।
পত্রিকা হতে সরাসরি কপিপেষ্ট
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।