লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই,তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। (http://www.ishakkhan.blogspot.com)
থপ থপ। থপ থপ।
হালকা পায়ে হাঁটার আওয়াজ।
লোকটা টলতে টলতে এগুচ্ছে। অনিয়মিত পা ফেলা। কোন ছন্দ নেই। মন দিয়ে কিছুক্ষণ আওয়াজটা শুনলে মনে হয়, একটা গোলমাল আছে।
গোলমাল? হ্যাঁ। বিশাল গোলমাল। বহুদিন আগেই লোকটার সবকিছু গোলমাল হয়ে গেছে। ৩১ আগস্ট রাত ২ টা, খুব গোলমেলে একটা সময় হিসেবে তার জন্য লেখা হয়ে গেছে।
লোকটা খুন করেছিল।
ঠাণ্ডা মাথায় খুন। কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার। বউকে জবাই করে মেরে বস্তায় ভরে রান্নাঘরে লুকিয়ে রেখেছিল। জানাজানি হতে সময় লেগেছিল তিন হপ্তা। বিবাহিতা একজন মহিলার লাশ পাওয়া গেলে প্রথম সন্দেহই পড়ে স্বামীর ওপরে।
কাজেই তাকে ধরে নিয়ে আসা হল। কেসটা খুব বেশী প্যাঁচালো হল না। মাত্র তিনটি হিয়ারিংয়েই সে সবকিছু স্বীকার করে বসলো। অশান্তির সংসার, কাজেই বউকে খুন করে বস্তায় ভরে রাখাটাই একমাত্র যৌক্তিক সমাধান ছিল।
কেউ কেউ অবশ্য একটু গাইগুঁই করেছিল।
একটা ধারণা জাজের কানে তোলার চেষ্টা করেছিল যে সহজ-সরল মানুষটিকে অমানুষিক নির্যাতন করে আদালতে অপরাধ স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু লোকটা নিজেই বলল, তার ওপর কোন অত্যাচার হয় নি, বরং পুলিশ খুব ভাল ব্যবহার করেছে!
যাবজ্জীবন হবার একটা সুযোগ ছিল। কিন্তু যখন সে বেশ মাথা উঁচু করেই বলল যে এই খুনের জন্য সে বিন্দুমাত্র লজ্জিত নয়, তখন যে একটা অপশন বাকি থাকে, সেটাই নির্ধারিত হয়ে গেল। তারপর থেকে সে দিন গুণতে শুরু করল, বুঝতে পারলো যে পৃথিবীর আলো-বাতাস আর খুব বেশীদিন তার জন্য বরাদ্দ নেই। তারপর গতমাসে সে একটা আন্দাজ পেয়ে গেল যে এ মাসেই তার ভবলীলা সাঙ্গ হবে।
আজ সন্ধ্যে থেকেই লোকটার ব্যস্ত সময় গেছে। বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন এসেছে দেখা করতে। শেষ দেখা। সবার কাছেই ছিল টিফিন ক্যারিয়ারে করে আনা খাবার। আশ্চর্য ব্যাপার, একজন মানুষ মরে যাবার আগে কেন যেন সবাই প্রিয় খাবারের ওপর খুব জোর দেয়।
কাজেই সে তখন থেকে ডিম ভাজা, কমলালেবু আর কালোজাম মিষ্টি খেয়েছে বেশ কয়েকটা।
এক বুড়ি, সম্ভবত লোকটার মা, এসে অনেকক্ষণ হু হু করে কেঁদেছেন। ছেলে খুন করেছে, তার শাস্তিই হওয়া উচিৎ। কিন্তু মা তো। আধ ঘণ্টা পার হবার পরও যখন তাঁর থামার কোন লক্ষণ দেখা গেল না, তখন কয়েকজন মিলে তাঁকে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেল।
রাত দশটার দিকে এলেন মাওলানা সাহেব। একেবারে ভাবলেশহীন চেহারা। আমার বিশেষ পরিচিত লোক। তাঁর এখানে আসা খুব সুখকর বিষয় নয়। তিনি এসেছেন মানেই আজ রাতে কারো বিদায় ঘটবে।
চিরবিদায়।
তিনি এলেন, একেবারে দাঁড়ি-কমা ঠিক রেখে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে একটা নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন, অতঃপর তওবা পড়ালেন। দোয়া-কালাম পড়তে পড়তে লোকটার মতো অন্য সবারও চোখের পানি ঝরল।
আমার একটা অভিযোগ আছে। এসব কাজ দিনের বেলায় কেন করা হয় না? সবার ঘুম নষ্ট করে একটা বেকায়দা সময় কেন ঠিক করা হল? রাত দুটো মরার জন্য একটা লাগসই সময় হল?
লোকটাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হল।
একদম আপত্তি করল না। সবরকম অস্থিরতার ঊর্ধ্বে যেন চলে গেছে লোকটা। টানাহেঁচড়া করতে হল না, জাপটে ধরে নেয়া লাগলো না, লোকটা বেশ আগ্রহ করেই রওনা দিলো ফাঁসিকাষ্ঠের দিকে। মাওলানা সাহেব নিশ্চয়ই লোকটাকে সাহস দিয়েছিলেন, এই দুনিয়া একদিন যখন ছেড়ে চলেই যেতে হবে, যাবার সময় আপত্তি করা ঠিক নয়।
দু’দিকে দু’জন সেন্ট্রি।
সামনে ম্যাজিস্ট্রেট আর জেলার সাহেব। সেই সাথে আমি। আমার কাজ আছে।
লোকটা কোনদিকে তাকাচ্ছে না, একদম সোজা মাটির দিকে চেয়ে আছে। আর তাকিয়েই কী হবে? একটু পর যে চোখ বুজে যাবে, সে চোখের সব দেখার আশই মিটে যায়।
আর মনটা হয়ে যায় খুব শান্ত।
চারপাশের সেলগুলোর দিকে আমি চোখ বুলিয়ে দেখলাম। অনেক জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ কি আশ্চর্য কৌতূহল নিয়েই না একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। লোকটা যেখানে যাত্রা করছে, যেন লোকটার মুখাবয়ব দেখেই সবাই সে জায়গাটা সম্পর্কে একটা আন্দাজ করতে চাইছে। কেউ কেউ হয়তো প্রার্থনা করছে, এমন কপাল যেন নিজের না হয়।
এসে গেছি আমরা। ফাঁকা জায়গায় একটা প্ল্যাটফরম। তাকালেই চোখে পড়ে অত্যন্ত নিরীহদর্শন একটা তৈরি করে রাখা ফাঁস। বেশ সুগোল। যে বানিয়েছে সে নিশ্চয়ই যত্ন করে বানিয়েছে।
দড়িটা বেশ মজবুত, ছিঁড়ে পড়ার ভয় নেই।
আমাকে দোষ দেবেন না। এখুনি মরতে চলেছে এমন একজনের সাথে পায়ে পায়ে হাঁটার সময় নিজেকে অন্যমনস্ক রাখতেই আমি কিছুটা হাস্যরস করি।
আমার কাঁধে একটা মৃদু ধাক্কা পড়লো। আমি কাজ শুরু করলাম।
লোকটা যেন দম দেয়া একটা পুতুল, কিছু বলতে হল না, নিজেই গিয়ে দাঁড়ালো ফাঁসের নিচে। আমি ধীরে ধীরে তার মাথায় কালো কাপড়টা পরিয়ে দিলাম। বরফের মতো ঠাণ্ডা লোকটার শরীর। আমি অবশ্য চমকালাম না। এর আগে যতজনকে মৃত্যুর ঠিক আগমুহূর্তে স্পর্শ করেছি, সবার শরীর ছিল সাপের মতো ঠাণ্ডা।
মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেই কি আত্মা শরীর ছেড়ে চলে যায়? যে বস্তুটি শরীরকে উষ্ণ করে রাখে, সেটা কি মৃত্যু সমীপবর্তী হওয়া মাত্রই এতদিনের আশ্রয় ছেড়ে উড়াল দেয়? হয়তো। আমার কী?
কালো কাপড়ে ঢাকা বলে লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আমি ঠাহর করে দেখতে পেলাম, কাপড়টা অল্প অল্প কাঁপছে। লোকটা কি কাঁদছে? বাঁচতে চাইছে? নাকি বিড়বিড় করে নিজেকে সাহস দিচ্ছে? সে কি বলছে, কোন ভয় নেই, আর তো মাত্র কয়েকটা মিনিট। কোন যন্ত্রণা হবে না, কোন যন্ত্রণা হবে না।
একটুও না।
অস্বস্তিকর নীরবতা। কানের কাছে একটা মশা পিন পিন করছে, আওয়াজটা খুব জোরালো আর বিরক্তিকর ঠেকছে।
জেলার সাহেব এবং ম্যাজিস্ট্রেটের চাহনিও যাকে বলে একেবারে শুন্য দৃষ্টি। মরতে যাচ্ছে অথবা মরে গেছে এমন কারো আশেপাশে থাকা সবাই বোধহয় কিছুক্ষণের জন্য মৃত হয়ে যায়।
অবশেষে দূর থেকে ঘড়ির মৃদু আওয়াজ ভেসে এলো। পর পর দু’বার। ঢং ঢং। সবাই চুপ করে আছে বলে শব্দটার প্রতিধ্বনিও শোনা গেল, স্পষ্ট। সাহিত্যের ভাষায়, মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি।
মজার ব্যাপার হল, নিজের মৃত্যুর ঘণ্টা নিজের কানে শোনার ভাগ্য একমাত্র ফাঁসির আসামীদেরই হয়।
লোকটা তখন একটা জড়বস্তুর মতোই দাঁড়িয়ে আছে, একটুও নড়ছে না।
ম্যাজিস্ট্রেটের হাত থেকে রুমাল পড়ে গেল। খুব নাটকীয় একটা ব্যাপার মৃত্যুর মতো ভয়ংকর একটা জিনিসের সাথে যুক্ত করে রাখা হয়েছে। আমি সাথে সাথেই কাঠের ডাণ্ডাটা টেনে দিলাম।
ঘড়াং শব্দ করে লোকটার পায়ের নিচের মাটি দু’ফাঁক হয়ে গেল, আর আমার সবচেয়ে অপ্রিয় ব্যাপারটা ঘটলো।
মট!
লোকটার ঘাড় ভাঙার আওয়াজ আমার মাথার ভেতরে সজোরে আঘাত করল।
লোকটা মরে গেছে তাতে কিছু যায় আসে না। কত লোকই তো রোজ মরছে, কে খবর রাখে? কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ হল ঐ ঘাড় ভাঙার আওয়াজটা। কি কুৎসিত! আগামী দিনসাতেক এই বিচ্ছিরি আওয়াজটা আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাবে, চাইলেও দূর করতে পারবো না।
পরের কাজগুলো দ্রুত শেষ করা হল। লোকটার মৃতদেহ একটা সাদা কাপড়ে মুড়ে নিয়ে যাওয়া হল। সেই দুই সেন্ট্রিই বহন করে নিয়ে গেল। দেখলাম, তাদের দুজনেরই মুখ ঘামে ভিজে সপসপ করছে। মৃত্যু বস্তুটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখাও খুব পরিশ্রমের কাজ।
আমি ফিরে এলাম আমার সংকীর্ণ সেলে। খুব ক্লান্ত লাগছে আমার। রাতের শেষ ভাগে এমনিতেই ঘুম খুব গভীর হয়। কিন্তু এইমাত্র মস্তিষ্কে চাপ ফেলার মতো যে ঘটনাটা ঘটলো, সেটা আমাকে ঘুমোতে না-ও দিতে পারে।
আমার সেলে কোন আলো জ্বলছে না।
জ্বলবার কথাও নয়। ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার। আমি একপাশ ফিরে শুয়েই দেখতে পেলাম লোকটাকে। গুঁড়ি মেরে বসে আছে সেলের কোণে। ঘোর অন্ধকারে মানুষ কিছু দেখতে পায় না, তবে আমি দেখতে পাচ্ছি।
লোকটা আরও কালো, আরও অন্ধকার বলেই কি? অন্ধকারে অন্ধকার কিন্তু ঠিকই দেখা যায়।
ভয় পেলাম না আমি। আগেও ঘটেছে। যার জন্য কাঠের ডাণ্ডাটা আমি টেনে দিই, সে-ই এসে আমাকে দর্শন দিয়ে যায়। অবশ্য বলে না কিছু।
চুপচাপ গুঁড়ি মেরে বসে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর চলে যায়। কে জানে, আমাকে তারা কিছু বলতে চায় হয়তো, অভয় দিলে হয়তো বলতো।
আমি চুপচাপ চেয়ে থাকি অন্ধকারে নিজেকে মিশিয়ে বসে থাকা ছায়াটার দিকে। কিছুক্ষণ পরই প্রত্যাশিত একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল।
ছায়ামূর্তিটা উঠে দাঁড়ায়।
তারপর ছোট্ট ঘুলঘুলিটা দিয়ে ধোঁয়ার মতোই বেরিয়ে যায়।
আমার সংকীর্ণ কামরায় আমি আবার একা হয়ে যাই। লোকটার মতো করেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আমার বুক চিরে।
(৩১ আগস্ট, ২০১৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।