এটা অসংগতিপূর্ণ ঠেকছে যে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) সমঝোতার কথা বলছেন। প্রধানমন্ত্রী বা সরকারি দলের কেউ বলছেন না। আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বধ হয়েছে। এবার মনে হচ্ছে, ইসির কাঁধে বন্দুক রেখে নির্বাচন বধ হবে।
শেখ হাসিনাই শুধু জানেন, কখন এবং ঠিক কোন ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে।
সে কারণেই গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর শীর্ষ শিরোনামের প্রতিপাদ্য ছিল, মন্ত্রীরা অন্ধকারে। তাঁরাও জানেন না, কখন নির্বাচন হবে।
১৩ অক্টোবর নির্বাচন ও সংসদ অধিবেশন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং সিইসির বক্তব্য থেকেও এটা পরিষ্কার যে, বিষয়টি কেবলই প্রধানমন্ত্রী জানেন। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চার দাবি অন্তত নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণে অনুপস্থিত। যদি ধরে নিই সংবিধান অনুযায়ী, মানে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে, তাহলে আওয়ামী লীগের দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ইতিমধ্যে শুধু একটি নয়, একাধিক বৈঠক হওয়ার কথা।
কিন্তু তা হয়নি। হচ্ছে না। বজ্রপাতের মতো নির্বাচনের তারিখ নেমে আসবে এ জাতির বুকে। রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায় থেকে একেক সময়ে একেক কথা বলা হচ্ছে। একটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই।
পরম্পরা নেই। এটি একান্তভাবেই সরকারদলীয় বা ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী তথা আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর সংকট। আবার এটাও স্পষ্ট যে, তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।
দেশে এই মুহূর্তে একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে, এ কথা বলা যাবে না। যদি সেটা চলতই, তাহলে সিইসি বলতেন না, ‘আমরা এখনো নিশ্চিত নই কোন ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে।
’ তিনি যে এখনো প্রস্তুত নন, তা তিনি স্বীকার করেন এই ভাষায়, ‘এমনভাবে নির্বাচনের কারিগরি প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি, যাতে “যেকোনো ধরনের সরকারের অধীনে” অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হয়। ’ বোঝা যাচ্ছে, সিইসি অন্তত জানতেন, প্রধানমন্ত্রী এর আগে সংসদে জাতিকে সঠিক ইঙ্গিত দেননি। প্রধানমন্ত্রী দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বলেছিলেন, প্রয়োজনে ২৪ অক্টোবর সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে। এক বছরের ব্যবধানে গত ১২ সেপ্টেম্বর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে সত্য—প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার নাকি সিইসি।
হয় সবাই সত্য বা কেউ নন। সিইসি ১৩ অক্টোবরে এসে বলছেন, ‘কমিশনের কাছে বর্তমানে যে আচরণবিধি আছে, তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আলোকে করা। ’ এটা ভালো যে, ইসি এখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুডে আছে।
স্পিকার কিন্তু সংবিধানমতে ঠিকই বলেছেন, ২৫ অক্টোবর (যদিও এটা ২৭ অক্টোবর হবে) থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচন হবে। নির্বাচনের প্রশ্নে সিইসি নীরবতা ভাঙলেন ঠিকই, কিন্তু তাতে বিভ্রান্তি কমল না।
তিনি জানাচ্ছেন, তাঁরা ২৭ অক্টোবরে বা ধারেকাছেও ভোট গ্রহণে প্রস্তুত নন। স্পিকার নিজেও ১১ অক্টোবর প্রথম আলোকে বলেন, ‘২৪ অক্টোবর অধিবেশন শেষ করা সম্ভব নয়। আরপিও সংশোধন বিলসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিল পাস হবে। সে জন্য সময়ের দরকার। ’ স্পিকারের এই ‘সময়ের দরকার’ কথাটি বড় গোলমেলে।
আমরা যদি তাঁদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করি, তাহলে বলতেই হবে ওই ‘সময়’ জানুয়ারিতেও গড়াতে পারে। সিইসি সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাঁরা বলবেন, সংবিধানে ২৭ অক্টোবরের পরই ভোট নিতে বললেই নেব কেন। জানুয়ারিতে নিলেও তো সংবিধান রক্ষা পাবে। ঠিক যুক্তি।
তবে কারও চালাকি থাকলে ধরা পড়বে, যদি এখনই সম্ভাব্য তারিখটি ইসি জানিয়ে দেয়। এখন তো দেখছি একতরফা নির্বাচনের তারিখটাও স্বচ্ছতার সঙ্গে ঠিক না-ও হতে পারে।
সিইসি বলেছেন, ‘সমঝোতার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করবে নির্বাচন কমিশন। এর পরও যদি সমঝোতা না হয়, তবে কমিশন সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন করবে। ’ এই বক্তব্য সম্পূর্ণ সদিচ্ছাপ্রসূত মনে করতে চাই।
কিন্তু কথা হচ্ছে, এই ‘শেষ মুহূর্ত’ গণনার প্রক্রিয়াটা কী হবে। এ সম্পর্কে তিনি যদি দেশবাসীকে কিছুই না জানাতে সক্ষম হন, তাহলে বেলা শেষে দেখা যাবে তিনি সমঝোতার নামে প্রকৃতপক্ষে সরকারি দলের ক্ষমতায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টিকে থাকার বাসনাকেই বৈধতা দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, তাতে একটি জাতির রাজনৈতিক নৈতিকতা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ১২ অক্টোবর তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগের দিন পর্যন্ত সংসদ অধিবেশন চলতে কোনো বাধা নেই। ২৪ অক্টোবরের পর সংসদ অধিবেশন চলতে পারবে না, তা সংবিধানের কোথাও লেখা নেই।
’
তফসিল ঘোষণার পরও সংসদ অধিবেশন চলতে পারবে না, তা-ও সংবিধানে লেখা নেই। বরং চলতি অধিবেশন বিরতি ছাড়াই ভোটের দিনগুলোতেও চলতে পারে। ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত বিরতি ছাড়াই চলতে পারে। প্রত্যেকে ভোট দিয়ে সংসদে এসে সুখের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও তো সংবিধান লঙ্ঘিত হবে না। প্রধানমন্ত্রী সেটা বলছেন না কেন? তিনি সংবিধানের দোহাই দিয়ে ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারে থাকার বৈধতাও দাবি করতে পারেন।
এমনকি তাঁদের পক্ষে এটাও সম্ভব সুবিধাজনক সময় বলা হবে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সরকারের ছিল না। ইসি তখন বলির পাঁঠা হবে। কারণ, মন্ত্রীদের মর্জি নয়, ইসির কাজ ২৭ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন করা। তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত সংসদ চালানো মানে তারা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে বিরোধী দল থেকে প্রচারণায় এগিয়ে থাকবে? তাহলে ইসিকে এখনই বলতে হবে, আচরণবিধি কখন থেকে কার্যকর হবে?
কিছুদিন আগে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, সরকারের মেয়াদ ২০ থেকে ২২ দিন আছে। তিনি এটা ২৫ অক্টোবরের দিকে তাকিয়েই বলেছিলেন।
তাঁর এ কথার একটি জোর আছে। সেটা হলো, সংবিধান আশা করছে, কোনো একটি সরকার সংসদের সর্বোচ্চ মেয়াদ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু তা শর্তহীন নয়। তাকে একটি শর্ত পূরণ করতেই হবে। আর তা হলো, ২৪ জানুয়ারির মধ্যে তাদের ৩০০ আসনে ৩০০ নতুন নির্বাচিত প্রতিনিধি উপহার দিতে হবে। অকারণে এতে ব্যর্থ হলে ২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের কার্যক্রমের বৈধতা সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জযোগ্য হবে বলে মনে করি।
সেদিক থেকে ওবায়দুল কাদের সংবিধানের যথার্থ ব্যাখ্যা করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়।
১৪ অক্টোবরের প্রথম আলোতে প্রবীণ আইনজীবী রফিক-উল হকের একটি মন্তব্য ছাপা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনের সময় স্পষ্ট করার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর। ’ আমি তাঁর সঙ্গে শর্ত সাপেক্ষে একমত। ২৭ অক্টোবরের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে স্পষ্ট করতে হবে।
এরপর সিইসি তাঁকে অগ্রাহ্য করতে পারেন। সংবিধান অন্তত বাধা দেবে না। একজন নির্বাচন কমিশনার বিষয়টি চমৎকার বুঝেছেন। তিনি আমাকে বলেন, ওয়াক্ত হলে আজান হবে।
আমি মনে করি, ২৭ অক্টোবরের পর ওয়াক্ত হবে।
মুসল্লিরা আসবে কি আসবে না, সেটা দেখা মুয়াজ্জিনের কাজ নয়। সিইসি কারও দিকে তাকিয়ে কালক্ষেপণ করবেন না। এটা হলো সংবিধানের আক্ষরিক ব্যাখ্যা। রফিক-উল হকের আরেকটি অভিমতের সঙ্গে আমি বিনয়ের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করি। তিনি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যদি ১০ জানুয়ারি বা ২০ জানুয়ারি সংসদ ভেঙে দেন, তাহলে নির্বাচন হবে পরের তিন মাসের মধ্যে।
সুতরাং, প্রধানমন্ত্রীকেই নির্বাচনের সময় স্পষ্ট করতে হবে। ’ তাঁর এই ব্যাখ্যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। সরকারি দল এতে লাইসেন্স পাবে। সিইসি বলবেন, হাত গুটিয়ে বসে না থেকে কী করব। আমি কী করে বুঝব প্রধানমন্ত্রী কখন সংসদ ভাঙবেন।
তিনি ভাঙবেন কি না, সেটা দেখতে আমাকে অন্তত ২৪ জানুয়ারির দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে দিন।
প্রধানমন্ত্রী গত রোববার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিলেও জরুরি প্রয়োজনে তিনি সংসদ অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন। ’ এটি সংবিধানের সঠিক ব্যাখ্যা নয়। জরুরি প্রয়োজন বলে কোনো কথা সংবিধানে লেখা নেই। সংবিধান বলেছে, ভেঙে দেওয়া সংসদ ডাকতে হলে দেশে একটা ‘যুদ্ধ’ লাগবে।
ভেঙে দেওয়া সংসদের সদস্যদের দিয়ে রাষ্ট্রপতি চাইলে কেবল মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করতে পারেন। ২৪ জানুয়ারির পর তিনি নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে পারেন।
এখন নির্বাচন কমিশনের উচিত অবিলম্বে নির্বাচনের একটি প্রাথমিক তফসিল ঘোষণা করা। প্রয়োজনে তিন-চারবার তফসিল পরিবর্তনেও বাধা নেই। এই প্রক্রিয়ায় সমঝোতা না একতরফা, তা পরিষ্কার হবে।
আমি আগের লেখায় যেমনটা বলেছি, তার সমর্থন মিলেছে সাবেক সিইসি এ টি এম শামসুল হুদার কথায়। ১৩ অক্টাবরের প্রথম আলোয় তিনি নির্বাচন কখন হবে, সে বিষয়টি স্পষ্ট করার তাগিদ দিয়ে সরকারকে চিঠি দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা নিশ্চয় সমঝোতা চাইব। তবে সিইসির বর্ণিত ‘শেষ মুহূর্ত’ পেতে চাইলে ‘প্রথম মুহূর্ত’ জানা চাই। আমার এ সন্দেহ অমূলক হলে স্বস্তি পাব যে এই সরকার ২৪ জানুয়ারির পরও নির্বাচন ছাড়াই ক্ষমতায় টিকে থাকবে।
তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অহমিকা চূর্ণের শেষ মুহূর্তে আরও তিনটা মাস ক্ষমতার স্বাদ তারা নেবেই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।