রাজধানীর বাইরের সাভার উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, সেখানকার দেয়ালে দেওয়া আছে একটি মোবাইল ফোন নম্বর। ২৪ ঘণ্টা খোলা এই ফোন নম্বরের সঙ্গে যুক্ত আছেন একজন ডাক্তার। দিনে-রাতে যে কোনো সময় ওই অঞ্চলের লোকেরা তার কাছ থেকে জরুরি চিকিৎসাসেবা বা পরামর্শ নিতে পারেন। সবাই এখনো বিষয়টি জানে না। এর পরও প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০ জন ফোন করে সেবা নিচ্ছেন।
ফোনকলের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিনই। সরকারিভাবে এ ধরনের সেবা রাখা হয়েছে ৪১৮ উপজেলায়। পুরো স্বাস্থ্য খাতকে একটি অভিন্ন নেটওয়ার্কের আওতায় আনার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ এগিয়ে চলছে। প্রতিটি উপজেলায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সেবা পাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। এরই মধ্যে কিছু জেলা-উপজেলায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এটি চালু হয়েছে।
এতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো হাসপাতালের টেলিমেডিসিন কক্ষে থাকা রোগী ও ঢাকায় থাকা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক উভয়েই ওয়েবক্যামেরার মাধ্যমে পরস্পরকে দেখতে পান। ডাক্তার প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করেন এবং রোগীর চিকিৎসাসংক্রান্ত পরীক্ষার রিপোর্ট ইত্যাদি এই ক্যামেরার বা আগেই পাঠিয়ে দেওয়া ই-মেইলের মাধ্যমে অন্য প্রান্তের ডাক্তার দেখতে পারেন। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর পরবর্তী সেবাও নিশ্চিত করা হয়।
নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এভাবেই এগিয়ে চলছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজ। বিশাল জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন খাতের অভিন্ন নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ।
সময়ের চাহিদা অনুসারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ইশতেহারে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক এক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছিল। সে অনুসারেই ভিশন-২০২১ নামে ডিজিটাল বাংলাদেশের এক রূপকল্প নিয়ে চলছে কাজ। এরই মধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়নও হয়েছে। জনগণের সেবার ক্ষেত্রে লেগেছে ডিজিটালের ছোঁয়া। তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত প্রসার ঘটায় এবং হাতে হাতে মোবাইল ফোন পৌঁছে যাওয়ায় জনগণের মধ্যেও বাড়ছে এর চাহিদা।
উপকারও পাওয়া যাচ্ছে। এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার মতো জাতীয় পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে মোবাইল ফোনে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য মোবাইল ফোনের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করা যাচ্ছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারনেটে ফরম সংগ্রহ ও জমা দেওয়ার পদ্ধতি চালু করেছে। এতে দেশের এক প্রান্তের শিক্ষার্থীকে আরেক প্রান্তে গিয়ে 'ফরম' সংগ্রহ ও জমা দিতে হচ্ছে না।
হয়েছে আর্থিক সাশ্রয়, কমেছে পরিশ্রম এবং বেড়েছে প্রস্তুতির সময়। একই ধরনের সেবা চালু হয়েছে বিদেশে গমনে ইচ্ছুকদের ক্ষেত্রে। মোবাইল ফোন থেকে মাত্র ২ টাকা খরচ করে এসএমএসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করা যাচ্ছে। লটারিতে নাম এলে স্বল্প খরচে যাওয়া যাচ্ছে বিদেশে। এতে দালালদের হাত থেকে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ কমেছে।
অনলাইনে দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে পাসপোর্টের ফরম গ্রহণ ও জমা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। সরকারের সব সেবা সংস্থার ফরম নিয়ে তৈরি করা হয়েছে ওয়েবসাইট। সেখান থেকে মুহূর্তেই সংগ্রহ করা যাচ্ছে যে কোনো ফরম। মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে জনগণের প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা কমে এসেছে। মারামারি-হানাহানির টেন্ডারের ক্ষেত্রে ই-টেন্ডারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এটি এখনো স্বল্পমাত্রায় পরিচালিত হলেও শীঘ্রই পূর্ণাঙ্গ পরিসরে চালু করার বিষয়ে আশাবাদী সরকার। অনলাইনে হওয়ায় সময় ও পরিশ্রম কমেছে সরকারকে কর দেওয়ার ক্ষেত্রেও। আয়করের হিসাব নির্ণয় ও রিটার্ন দাখিল করতে অনলাইন ট্যাঙ্ ক্যালকুলেটর হিসাবের জটিলতা কমিয়ে এনেছে। দেশের ব্যাংকিং-সেবার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে ইন্টারনেটব্যবস্থা চালু হওয়ায়। ব্যাপক হারে এটিএম চালু হওয়ায় জনগণ সপ্তাহে যে কোনো দিন যে কোনো সময় প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে পারছে।
অনলাইনভিত্তিক হওয়ায় মুহূর্তেই যে কোনো সেবা দিতে পারছে ব্যাংকের শাখাগুলোও। আগে যেখানে একটি চেক জমা হওয়ার জন্য কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হতো এখন তা সম্ভব হচ্ছে কয়েক মিনিটেই। নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ঘরে বসে কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে। এ ছাড়া দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে টাকা লেনদেন সম্ভব হচ্ছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। মাত্র কয়েক টাকা খরচ করেই নিমিষে টাকা পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং ও অন্যান্য মোবাইলভিত্তিক সেবার মাধ্যমে।
দেশের ৮ হাজার গ্রামীণ ডাকঘর এবং ৫০০ উপজেলা ডাকঘরকে ই-সেন্টারে রূপান্তরের পাশপাশি ২ হাজার ৭৫০টি পোস্ট অফিসে মোবাইল মানি অর্ডার সার্ভিস চালু এবং নিরাপদে অর্থ পরিবহনের লক্ষ্যে পোস্টাল ক্যাশ কার্ড নামে নতুন সেবা প্রবর্তন করা হয়েছে। এখন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিল জমা দেওয়া যাচ্ছে মোবাইলের কয়েকটি বোতাম টিপেই। অনলাইনের মাধ্যমে যে কোনো ধরনের পণ্য কেনাকাটার সুযোগ তৈরি হয়েছে ঘরে বসেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্ষেত্রেও ডিজিটাল সেবার ছোঁয়া লেগেছে। ইন্টারনেটে সাধারণ ডায়েরি করার সুযোগ চালু হয়েছে।
এ ছাড়া কম গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ এসএমএসের মাধ্যমে থানায় পাঠানো এবং প্রাথমিক তদন্ত সম্পাদনের পদ্ধতিও চালু হয়েছে। দুর্নীতি কমাতে ভূমিসংক্রান্ত খাতের মতো অন্যান্য খাতকে ডিজিটাল করা হচ্ছে। এর ফলে ভূমির পর্চাসহ মাটি পরীক্ষা, সারের সুপারিশ, জীবন বীমার মতো সেবা জেলা প্রশাসনে বসে নিমিষেই গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। দেশব্যাপী জেলা ই-সেবাকেন্দ্র থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৪০ হাজার হিসেবে অনলাইন পদ্ধতিতে এ পর্যন্ত প্রায় ১১ লাখ জমির পর্চা বিতরণ সম্ভব হয়েছে। অতিরিক্ত অর্থ ও হয়রানি বন্ধ হয়ে গ্রাহকদের ঘরে বসে পর্চাপ্রাপ্তির সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশের জীবন-জীবিকা ভিত্তিক তথ্য এক জায়গায় পেতে বাংলায় প্রথম জাতীয় ই-তথ্য কোষ চালু হয়েছে। পুরো দেশকে ডিজিটাল সেবার আওতায় আনতে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে তথ্য ও সেবা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এসব তথ্যকেন্দ্র থেকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সরকারি ফরম, নোটিস, পাসপোর্ট ও ভিসা সংক্রান্ত তথ্য এবং জাতীয় ই-তথ্যকোষ থেকে তথ্য সংগ্রহ, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিভিন্ন সেবা বিষয়ক তথ্য, চাকরির খবর, নাগরিক সনদপত্র, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল, বিদেশে চাকরি রেজিস্ট্রেশনসহ ২২০টি সেবা গ্রহণ করতে পারবে। ধাপে ধাপে এ সেবার সংখ্যা বেড়ে হবে ৭০০-তে। শিক্ষা ক্ষেত্রে অনলাইনে ই-বুক পদ্ধতি চালু হয়েছে।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ৩২৫টি পাঠ্যপুস্তক ই-বুক তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি পাঠদান পদ্ধতি সহজ ও আনন্দদায়ক করতে দেশব্যাপী ২০ হাজার ৫০০ মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ৩ হাজার ১৭২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করে ৫ হাজার শিক্ষককে মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট তৈরির প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এ বিষয়ে ২৪ হাজার পোর্টাল নির্মাণ প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত ও কাজের স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে চলছে দেশের প্রশাসনিক সব কার্যালয়কে একক নেটওয়ার্কে আনার কাজ।
সরকারি পর্যায়ে ই-ফাইলিং, ই-সার্ভিসসহ দেশব্যাপী দফতরগুলোর মধ্যে নেটওয়ার্ক স্থাপন ও অ্যাপ্লিকেশন উন্নয়ন করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক অফিসের ভিডিও কনফারেন্সিং এবং ই-সার্ভিস চালু হয়েছে। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন, সেনাবাহিনীসহ বহু প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে চাকরির দরখাস্ত গ্রহণ, প্রবেশপত্র প্রদান ও ফলাফল প্রকাশের কাজ সম্পন্ন। দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় এলাকায় দুর্যোগের পূর্বাভাস মোবাইল ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেওয়া শুরু হয়েছে।
অন্যদিকে, অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি সরকারি পর্যায়ে 'লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং' কর্মসূচির আওতায় শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ প্রদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে।
এরই মধ্যে ১২ জেলার ১ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থীকে অনলাইন আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। দেশের তরুণদের উদ্বুদ্ধকরণ ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এশিয়ার সবচেয়ে বড় আইসিটি ইভেন্ট ই-এশিয়া ঢাকায় আয়োজন করা হয়েছে।
ইন্টারনেটে নিজ ভাষা বাংলা ব্যবহারের ব্যাপক সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। প্রমিত বাংলা ব্যবহারের জন্য ইউনিকোড সুবিধাসংবলিত নতুন বাংলা ফন্ট 'আমার বর্ণমালা' প্রস্তুত ও বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। নিজ ভাষায় মোবাইল ফোন ব্যবহারেরও সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।
মোবাইল ফোনে ব্যবহারোপযোগী বাংলা কি-প্যাড ছাড়া মোবাইল ফোনসেট আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। বাংলায় এসএমএস পাঠানো ও পড়ার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। দেশব্যাপী ইন্টারনেট সেবা সহজলভ্য করতে মোবাইল ফোনের গ্রাহকসংখ্যা বৃদ্ধি ও ইন্টারনেটের মূল্য নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চার দফায় কমিয়ে ১ এমবিপিএস ব্যান্ডউইডথের মূল্য ২৭ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের প্রতিটি উপজেলা মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে।
টেলিযোগাযোগ সেবার মাধ্যমে জীবনযাপনের মান উন্নত করতে বিভিন্ন ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস চালু হয়েছে। লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে থ্রি-জি সার্ভিসের। এর মাধ্যমে মোবাইল ফোনে ভিডিও কল এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশন দেখা সম্ভব হবে। দ্রুত ডেটা পরিবহনও করবে থ্রি-জি, যা টেলিমেডিসিনসহ অন্যান্য সেবার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। পাশাপাশি দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলে বাংলাদেশের সংযুক্তির প্রক্রিয়াও দ্রুত এগিয়ে চলছে।
জনগণের কাছে তথ্যপ্রযুক্তির যন্ত্রাদি পৌঁছে দিতে দেশেই তৈরি করা হচ্ছে স্বল্পমূল্যের ল্যাপটপ। স্থাপন করা হয়েছে হাইটেক পার্ক। তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি নিম্নমাধ্যমিকে আইসিটি শিক্ষা চালু এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে আইটি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।