লেখক: ইস্ক্রা
আইন বিভাগ, সম্মান প্রথম বর্ষ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
কৃতজ্ঞতা: সেলিম রেজা নিউটন, সুস্মিতা চক্রবর্তী, লোকমান কবীর, তানিয়া পারভীন, তাওসীফ হামীম, মাসুম সরকার ও ফেসবুকের সকল বন্ধুরা।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ভর্তি হই একটা চুক্তির মাধ্যমে। এই চুক্তি অনুযায়ী যে শিক্ষার্থী তারা ভর্তি করে তাকে যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করে নেয়া হয়। আর স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষের শর্ত থাকে যে তারা শিক্ষার্থীকে "শেখাবেন।
" এমন কোনো শর্ত থাকে না যে তারা "কম্পিটিশন" তৈরি করবেন, শিক্ষার্থীদের মাঝে ডিসক্রিমিনেশন তৈরি করবেন। বরং, সকল শিক্ষার্থীকে তারা সমানভাবে দেখবেন এইটাই কন্ডিশনালি এবং মরালি তাদের কর্তব্য। অথচ, স্কুল-কলেজে প্রথম দিনটি থেকেই "রোল কল" এর মাধ্যমেই শুরু হয় ডিসক্রিমিনেশন। তথাকথিত এই "রোল কল প্রোফাইলিং" তা সে ভর্তিক্রম অনুযায়ীই হোক বা মেধাক্রম অনুযায়ীই হোক, যে ব্যাপারটি সকলের নজর এড়িয়ে যায় তা হল, এটি শিক্ষার্থীদের মনোজগতে প্রভাব ফেলে, কম্পিটিটিভ মনোভাব তৈরি করে, একে অপরের প্রতি সুপ্ত বা প্রকাশ্য শত্রুতা সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন একে “উচ্চাভিলাস” বা “স্বীকৃতি লাভের ইচ্ছা” বলে অভিহিত করেছেন।
“শিক্ষা প্রসঙ্গে” প্রবন্ধে তিনি বলেছেন-
“সহচরের কাছ থেকে স্বীকৃতির অভিলাষ নিশ্চিতরূপে সমাজের বন্ধন শক্তিগুলোর অন্যতম। অনুভূতির এই জটিলতায় ধ্বংসাত্মক এবং গঠনমূলক শক্তি পাশাপাশি বাস করে। অনুমোদন এবং স্বীকৃতিলাভের ইচ্ছা স্বাস্থ্যকর ইচ্ছা কিন্তু সঙ্গী অথবা গবেষক-ছাত্র অপেক্ষা নিজেকে অধিকতর উত্তম, বলশালী অথবা বুদ্ধিমানরূপে পরিচিতি লাভের ইচ্ছা অতিরিক্তমাত্রায় অহমিকাপূর্ণ মানসিক অবস্থানে চালিত করে যা ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের ক্ষতিকারক হয়ে দেখা দেয়। ” ১
সাফল্যকে যুবসমাজের কাছে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে প্রচার করার কাজটি বিদ্যালয় বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে এবং সঠিক ভেবে করে থাকে। আইনস্টাইন এই ব্যাপারে বিদ্যালয়গুলোকে সতর্ক হতে পরামর্শ দিয়েছেন।
তাঁর মতে, সফল মানুষ তিনিই যিনি তার সতীর্থদের কাছ থেকে অনেক পান। বিদ্যালয় এই “সতীর্থ” ধারণাটির জায়গায় “প্রতিযোগী” ধারণাটি বসিয়ে দিয়ে সতীর্থকে অচিরেই চিরশক্রু বানিয়ে দিতে বিশেষ পারদর্শী – তা আমাদের দেশের যেকোনো শিক্ষার্থীর মানসিকতা বিশ্লেষণ করলেই জানা যায়।
রোল নম্বর প্রোফাইলিং এর ক্ষেত্রে যুক্তিটা হল - এতে শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাসে আসছে কিনা তার হিসাব রাখা যায়; বেশ সহজ-সরল, নিরীহ একটা সিস্টেম। কিন্তু, আপাত নিরীহ, কার্যকর এই সিস্টেমটির আসলে দমনমূলক এবং বৈষম্যপূর্ণ চরিত্র আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যত বড় হয়, নিয়মিত ক্লাসে আসা না আসার এই বিষয়টি শিক্ষকদের কাছে একরকম ইগোতে পরিণত হয়।
রোল কলিং এর হিসাব রেখে শিক্ষার্থীকে ক্লাসমুখী করার জন্য আবার কখনো কখনো বেঁধে দেওয়া হয় বিশেষ নম্বর। অথচ, যে শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাসে আসে না সেইটার সবচেয়ে কমন কারণ হতে পারে সে ক্লাসকে বন্ধুত্বপূর্ণ, স্বস্তিদায়ক স্থান মনে করতে পারছে না, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান মনে করতে পারছে না। অথচ, এই সমস্যাটিও সকলের নজর এড়িয়ে যায়, কারণ, কর্তৃপক্ষ সবসময়ই দন্ডনীতির পূজারী। তাই, ক্লাস সিস্টেম সংস্কারের চেয়ে ঘাড় ধরে শিক্ষার্থীকে ক্লাসমুখী করার জন্য কর্তৃপক্ষের পীড়নমূলক নীতিকেই প্রয়োগ করতে দেখা যায়। বিজ্ঞানী এলবার্ট আইনস্টাইন বিদ্যালয়ের এই কর্তৃত্বপরায়ন চরিত্র সম্পর্কে বলেছেন –
আইনস্টাইনের বক্তব্যের সবচেয়ে চমকপ্রদ শব্দগুচ্ছ হলো “কৃত্রিম কর্তৃত্বের পরিবেশ সৃষ্টি।
” এই কৃত্রিম কর্তৃত্ব বলতে স্পষ্টতই বিদ্যালয়ের রোল কল, ইউনিফর্ম, ডিসিপ্লিনের কঠোরতা, পড়াশোনার ক্ষেত্রে কঠোরতা, সবাইকে একরকম দেখতে চাওয়ার ইচ্ছা, সবার মেধাকে একই মানদণ্ডে বিচার করার চেষ্টা ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে। আইনস্টাইন এদের স্রেফ অপ্রয়োজনীয়, কৃত্রিম কর্তৃত্বতন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আমাদের জন্য একটি হুঁশিয়ারিও জানিয়ে দিচ্ছেন - এই কর্তৃত্বতন্ত্রের ফলাফল হলো দাসত্বকে বরণ করে নেওয়া। ক্লাসরুম থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থা, পরিবার থেকে সমাজ সর্বত্রই কর্তৃপক্ষের হুকুমদারীর এই যে শাসন- তা সবসময়ই ব্যক্তি স্বাধীনতার অন্তরায়।
ক্লাসরুম ভাল লাগে না, টিচারের বকবক ভাল লাগে না, পরীক্ষা ভাল লাগে না – এইরকম অভিযোগ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে কমন।
আমি এগুলোকে অভিযোগের চেয়ে একেকটি ছোট ছোট বিদ্রোহ বলব। এইসব বিদ্রোহের স্বরূপ প্রকাশ পায় আড়ালে টিচারকে গালিগালাজ করা, পরীক্ষা নিয়ে ভয়ে থাকা, রেজাল্টের জন্য বন্ধুর সঙ্গে প্রকাশ্য অথবা শীতল কম্পিটিশন ইত্যাদির মধ্যদিয়ে।
কম্পিটিশন কখনো বিদ্যাকে অর্জন করতে শেখায় না, গলধঃকরণ করতে শেখায়। এই কম্পিটিশন যুক্তি, বিজ্ঞানমনষ্কতা, দর্শন কোনোকিছুরই উন্মেষ ঘটায় না। বস্তুত, মানুষ যা কিছু শেখে এবং যতটুকু শেখে তা একদম স্বেচ্ছায়।
কারও সাথে তুলনা করা শেখার উদ্দেশ্য নয়, বস্তুত, কোনোকিছু শেখার পেছনে কোনো ধরণের উদ্দেশ্যই থাকে না। শিখন প্রক্রিয়ায় যখনই উদ্দেশ্য ঢুকে পড়ে তখনই তা গলধঃকরণ প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিখন প্রক্রিয়ার গলধঃকরণ করানোর এই প্রচেষ্টা সম্পর্কে বলেছেন -
“ভাণ্ডারঘর যেমন করিয়া আহার্য দ্রব্য সঞ্চয় করে আমরা তেমনি করিয়াই শিক্ষা সঞ্চয় করিতেছি, দেহ যেমন করিয়া আহার্য গ্রহণ করে তেমন করিয়া নহে। ভাণ্ডারঘর যাহা-কিছু পায় হিসাব মিলাইয়া সাবধানে তাহার প্রত্যেক কণাটিকে রাখিবার চেষ্টা করে। দেহ যাহা পায় তাহা রাখিবার জন্য নহে, তাহাকে অঙ্গীকৃত করিবার জন্য।
তাহা গোরুর গাড়ির মতো ভাড়া খাটিয়া বাহিরে বহন করিবার জন্য নহে, তাহাকে অন্তরে রূপান্তরিত করিয়া রক্তে মাংসে স্বাস্থ্যে শক্তিতে পরিণত করিবার জন্য। আজ আমাদের মুশকিল হইয়াছে এই যে, এই এত বছরের নোটবুকের বস্তা-ভরা শিক্ষার মাল লইয়া আজ আমাদের গোরুর গাড়িও বাহিরে তেমন করিয় ভাড়া খাটিতেছে না, অথচ সেটাকে মনের আনন্দে দিব্য পাক করিয়া ও পরিপাক করিয়া পেট ভরাই সে ব্যবস্থাও কোথাও নাই। তাই আমাদের বাহিরের থলিটাও রহিল ফাঁকা, অন্তরের পাকযন্ত্রটাও রহিল উপবাসী। ” ৩
প্রমথ চৌধুরী “বই পড়া” প্রবন্ধে বলেছিলেন-
"আমাদের ধারণা শিক্ষা আমাদের গায়ের জ্বালা চোখের জল দুই ই দূর কর করবে। এ আশা সম্ভবত দুরাশা।
তবুও আমরা সম্মুখে কোন সদুপায় খুঁজে পাইনা। " ৪
আবার, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের পড়াশোনায় “স্পেশালাইজেশন” কেমন করে আমাদের সীমাবদ্ধ করে ফেলছে সে ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ মত দিয়েছেন। সেটি এখানে তুলে দিচ্ছি -
“হুমায়ুন আজাদ: বাঙলাদেশে জ্ঞানচর্চার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনার ধারণা?
আহমদ শরীফ: বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে একটি ক্ষতিকর ব্যাপার ঘটে গেছে। ছাত্র অবস্থা থেকেই শুরু। স্পেশিয়ালাইজেশন দিয়ে জ্ঞান হয় না, পটভূমি দরকার।
তাই পাঠ্যবিষয়ের বাইরের জ্ঞান দরকার। আমাদের এখানে এখন তার ব্যবস্থা নেই। ফলে জ্ঞানের ভিত্তি তৈরি হচ্ছে না, খাড়া হয়ে উঠছে। একটি ডক্টরেট করে জ্ঞানী হয়ে যাচ্ছে, আর কোনো লেখাপড়া করছে না। এমন মানুষের দ্বারা জ্ঞানের চর্চা হতে পারে না।
জ্ঞানী মানুষ হওয়ার পথে আমাদের দেশে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। ” ৫
ড. আহমদ শরীফ তাঁর বক্তব্যের সর্বশেষ লাইনে সম্পূর্ণ বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছেন। জ্ঞানী মানুষ, স্বাধীন মানুষ হওয়ার পথে আমাদের দেশে বাধা সৃষ্টি হয়েছে, অর্থ্যাৎ, জ্ঞানার্জনে শিক্ষার্থীর আগ্রহ নিজে নিজে কমে যায় নি, বরং, আগ্রহ কমিয়ে ফেলেছে রাষ্ট্রপ্রণীত দমনমূলক, ভুলভাল শিক্ষানীতি। এই দমনমূলক, ভুলভাল নীতি কেবলমাত্র আজকের সমাজেই নয়, সুদূর এবং অদূর- সকল অতীতেই ছিল।
পাঠ্য বিষয়ের বাইরের জ্ঞান দরকার একথা রবি ঠাকুরও উপলব্ধি করেছেন বহুকাল আগেই, তিনি এও বলেছেন, বাইরের জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রের শিক্ষানীতি অর্থ্যাৎ, খোদ রাষ্ট্র।
রবীন্দ্রনাথ প্রথমত শিক্ষানীতি প্রণয়নকারী কমিটির অসাড়তার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন -
“কমিটি দ্বারা দেশের অনেক ভালো হইতে পারে; তেলের কল, সুরকির কল, রাজনীতি এবং বারোয়ারি পূজা কমিটির দ্বারা চালিত হইতে দেখা গিয়াছে, কিন্তু এ পর্যন্ত এ দেশে সাহিত্য সম্পর্কীয় কোনো কাজ কমিটির দ্বারা সুসম্পন্ন হইতে দেখা যায় নাই। মা সরস্বতী যখন ভাগের মা হইয়া দাঁড়ান তখন তাঁহার সদ্গতি হয় না। অতএব কমিটি-নির্বাচিত গ্রন্থগুলি যখন সর্বপ্রকার সাহিত্যরসবর্জিত হইয়া দেখা দেয় তখন কাহার দোষ দিব। আখমাড়া কলের মধ্য দিয়া যে-সকল ইক্ষুদণ্ড বাহির হইয়া আসে তাহাতে কেহ রসের প্রত্যাশা করে না;’সুকুমারমতি’হীনবুদ্ধি শিশুরাও নহে। অতএব, কমিটিকে একটি অবশ্যম্ভাবী অদৃষ্টবিড়ম্বনাস্বরূপ জ্ঞান করিয়া তৎসম্বন্ধে কোনো প্রসঙ্গ উত্থাপন না করিলেও সাধারণত বিদ্যালয়ে ব্যবহার্য পুস্তকগুলিকে পাঠ্যপুস্তক-শ্রেণী হইতে বহির্ভূত করা যাইতে পারে।
ব্যাকরণ, অভিধান, ভূগোলবিবরণ এবং নীতিপাঠ পৃথিবীর পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে গণ্য হইতে পারে না, তাহারা কেবলমাত্র শিক্ষাপুস্তক। ” ৬
অতএব, কমিটিকে একটি অবশ্যম্ভাবী অদৃষ্টবিড়ম্বনাস্বরূপ জ্ঞান করিয়া তৎসম্বন্ধে কোনো প্রসঙ্গ উত্থাপন না করিলেও সাধারণত বিদ্যালয়ে ব্যবহার্য পুস্তকগুলিকে পাঠ্যপুস্তক-শ্রেণী হইতে বহির্ভূত করা যাইতে পারে। ব্যাকরণ, অভিধান, ভূগোলবিবরণ এবং নীতিপাঠ পৃথিবীর পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে গণ্য হইতে পারে না, তাহারা কেবলমাত্র শিক্ষাপুস্তক। ” ৬
রবি ঠাকুর আরও বলছেন-
“যতটুকু অত্যাবশ্যক কেবল তাহারই মধ্যে কারারুদ্ধ হইয়া থাকা মানবজীবনের ধর্ম নহে। আমরা কিয়ৎপরিমাণে আবশ্যকশৃঙ্খলে বন্ধ হইয়া থাকি এবং কিয়ৎপরিমাণ স্বাধীন।
আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সেই সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না। স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক, নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য এবং আনন্দের ব্যাঘাত হয়। শিক্ষা সম্বন্ধেও এই কথা খাটে। যতটুকু কেবলমাত্র শিক্ষা অর্থাৎ অত্যাবশ্যক তাহারই মধ্যে শিশুদিগকে একান্ত নিবদ্ধ রাখিলে কখনোই তাহাদের মন যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িতে পারে না। অত্যাবশ্যক শিক্ষার সহিত স্বাধীন পাঠ না মিশাইলে ছেলে ভালো করিয়া মানুষ হইতে পারে না—বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেও বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে সে অনেকটা পরিমাণে বালক থাকিয়াই যায়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের হাতে কিছুমাত্র সময় নাই। যত শীঘ্র পারি বিদেশীয় ভাষা শিক্ষা করিয়া পাস দিয়া কাজে প্রবিষ্ট হইতে হইবে। কাজেই শিশুকাল হইতে ঊর্ধ্বশ্বাসে দ্রুতবেগে, দক্ষিণে বামে দৃক্পাত না করিয়া পড়া মুখস্থ করিয়া যাওয়া ছাড়া আর কোনো কিছুর সময় পাওয়া যায় না। সুতরাং ছেলেদের হাতে কোনো শখের বই দেখিলেই সেটা তৎক্ষণাৎ ছিনাইয়া লইতে হয়। শখের বই জুটিবেই বা কোথা হইতে।
বাংলায় সেরূপ গ্রন্থ নাই। এক রামায়ণ মহাভারত আছে, কিন্তু ছেলেদের এমন করিয়া বাংলা শেখানো হয় না যাহাতে তাহারা আপন ইচ্ছায় ঘরে বসিয়া কোনো বাংলা কাব্যের যথার্থ স্বাদ গ্রহণ করিতে পারে। আবার দুর্ভাগারা ইংরেজিও এতটা জানে না যাহাতে ইংরেজি বাল্যগ্রন্থের মধ্যে প্রবেশ লাভ করে। “ ৬
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের হাতে কিছুমাত্র সময় নাই। যত শীঘ্র পারি বিদেশীয় ভাষা শিক্ষা করিয়া পাস দিয়া কাজে প্রবিষ্ট হইতে হইবে।
কাজেই শিশুকাল হইতে ঊর্ধ্বশ্বাসে দ্রুতবেগে, দক্ষিণে বামে দৃক্পাত না করিয়া পড়া মুখস্থ করিয়া যাওয়া ছাড়া আর কোনো কিছুর সময় পাওয়া যায় না। সুতরাং ছেলেদের হাতে কোনো শখের বই দেখিলেই সেটা তৎক্ষণাৎ ছিনাইয়া লইতে হয়।
শখের বই জুটিবেই বা কোথা হইতে। বাংলায় সেরূপ গ্রন্থ নাই। এক রামায়ণ মহাভারত আছে, কিন্তু ছেলেদের এমন করিয়া বাংলা শেখানো হয় না যাহাতে তাহারা আপন ইচ্ছায় ঘরে বসিয়া কোনো বাংলা কাব্যের যথার্থ স্বাদ গ্রহণ করিতে পারে।
আবার দুর্ভাগারা ইংরেজিও এতটা জানে না যাহাতে ইংরেজি বাল্যগ্রন্থের মধ্যে প্রবেশ লাভ করে। “ ৬
শিক্ষক কিংবা অভিভাবক, সকলের কাছেই বিদ্যার্জন মানেই হলো কিছু করে খাওয়ার শিক্ষা। অথচ, পথ মাত্রই অজানা। শিখন প্রক্রিয়া হলো অজানা পথকে আবিষ্কারের উপায়। অজানা পথে চলার নামই স্বাধীনতা।
শিখন প্রক্রিয়ার মধ্যে উদ্দেশ্য ঢুকিয়ে ক্লাসরুম স্বাধীনতার ঠিক বিপরীত কর্মটি করে, ক্লাসরুম দেখিয়ে দেয় একটি চেনাজানা পথ, যে পথে কোনোকিছু আবিষ্কারের আর কিছু নাই, আছে স্বাধীনতার চিন্তাকে পরিত্যাগ করে শুধু অভ্যাসের বশ হওয়ার প্রতিযোগীতা, একে অপরকে টপকে দ্রুত গোলামি বরণের হুড়োহুড়ি – আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যারিয়ার ক্লাব, ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড সীমাবদ্ধ শিক্ষাদান, কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের সাথে হ্যাবিচুয়েটেড হওয়ার জন্য কর্মশালা, ঘরের ভিতরে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়র হবার তাড়া - এইসবই হলো ক্লাসরুমের কুফল। এক্ষেত্রেও রবি ঠাকুর স্মর্তব্য:
“যাহার মধ্যে জীবন নাই, আনন্দ নাই, অবকাশ নাই, নবীনতা নাই, নড়িয়া বসিবার এক তিল স্থান নাই, তাহারই অতি শুষ্ক কঠিন সংকীর্ণতার মধ্যে। ইহাতে কি সে-ছেলের কখনো মানসিক পুষ্টি, চিত্তের প্রসার, চরিত্রের বলিষ্ঠতা লাভ হইতে পারে। সে কি একপ্রকার পাণ্ডুবর্ণ রক্তহীন শীর্ণ অসম্পূর্ণ হইয়া থাকে না। সে কি বয়ঃপ্রাপ্তিকালে নিজের বুদ্ধি খাটাইয়া কিছু বাহির করিতে পারে, নিজের বল খাটাইয়া বাধা অতিক্রম করিতে পারে, নিজের স্বাভাবিক তেজে মস্তক উন্নত করিয়া রাখিতে পারে।
সে কি কেবল মুখস্থ করিতে, নকল করি এবং গোলামি করিতে শেখে না। ” ৬
বলাই বাহুল্য, স্বাধীনতা হীনতাই গোলামি। কর্তৃপক্ষ খুব ভালোমতোই ওয়াকিবহাল যে, জানার স্পৃহাটুকু তথা স্বাধীনসত্তাটুকু কেড়ে নিলেই হুকুমদারি আসান হয়ে যায়। সিস্টেম্যাটিক গলধঃকরণ ফর্মুলাটি গেলাতে পারলেই একেকটি মগজ ধোলাইকৃত কামলা-রোবট তৈরি করা যায়। এদের চোখ-কান-মুখ থাকে বন্ধ এবং মন থাকে কর্তৃত্বতন্ত্রকে আবৃত করে রাখা চাকচিক্যের প্রতি মোহাবিষ্ট।
এতে কর্তৃপক্ষের মাতব্বরি আসান হয়ে যায় এবং অভিভাবকের চোখের জল দূর না হলেও গায়ের জ্বালাটুকু মেটে।
ক্লাসরুমে বুঝতে না পেরেও চক্ষুলজ্জায় বা ভয়ে তা প্রকাশ না করাও শিক্ষার্থীদের একটা অতি সাধারণ সমস্যা। এই প্রশ্ন করার হিম্মত যোগানোর ব্যর্থতার দায় ক্লাসরুমের, স্বাধীনতার এই বিপন্নতার দায়ও ক্লাসরুমেরই। এটা এমন একটা জড় স্থান যেখানে সবাই টিচার নামক কর্তৃপক্ষের হুকুম, ইচ্ছা-অনিচ্ছার অধীন ও দয়া প্রত্যাশী। পুরো বিষয়টি একদমই স্বাধীন নয়; চরমভাবে পরাধীন, অবন্ধুসুলভ এবং অস্বস্তিকর।
“শিক্ষার হেরফের” প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবেই এই বিষয়ে বলেছেন:
“বাঙালির ছেলের মতো এমন হতভাগ্য আর কেহ নাই। অন্য দেশের ছেলেরা যে-বয়সে নবোদগত দন্তে আনন্দমনে ইক্ষু চর্বণ করিতেছে, বাঙালির ছেলে তখন ইস্কুলের বেঞ্চির উপর কোঁচাসমেত দুইখানি শীর্ণ খর্ব চরণ দোদুল্যমান করিয়া শুদ্ধমাত্র বেত হজম করিতেছে, মাস্টারের কটু গালি ছাড়া তাহাতে আর কোনোরূপ মসলা মিশানো নাই”৬
বিজ্ঞানী এলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন -
“শিক্ষকের ক্ষমতার পরিসরে কিছু বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক যাতে শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের শ্রদ্ধার একমাত্র উৎস হবে শিক্ষকের মানবিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিসংক্রান্ত গুণাবলী। ” ৭
কিন্তু, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কটি যুগ যুগ ধরে কর্তৃপক্ষ এমন একটা জায়গায় গিয়েছে যেখানে বন্ধুত্বের চেয়ে আবেগ বেশী, শেখানোর ইচ্ছার চেয়ে আদব-কেতা, সম্মান ও ভয় বেশী। এইসমস্ত “সম্মানীয় আবেগ” ও “মহামান্য ভয়” শিখন প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত দূরে ঠেলে দেয়। তার বদলে শিক্ষকের সম্মান, শিক্ষককে ভয় ইত্যাদি নীতিবাক্যমূলক বিষয়াদি অনেকটা শিক্ষার্থীর মনকে ব্লাকমেইল করে ফেলে।
ফলে, শিক্ষক হয়ে যান অত্যন্ত দূরের মানুষ নতুবা বিদ্রোহীদের কাছে অপ্রিয় ব্যক্তি যা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার।
আবার, কর্তৃত্বতন্ত্রের ভিতরেই থাকে ছোট ছোট কর্তৃত্বতন্ত্র। যেমন, রাষ্ট্রের ভিতরে থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও হয়ে ওঠে কর্তৃপক্ষ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটা ছোট্টক্লাসরুমও শিক্ষার্থীদের উপর কর্তৃত্বপরায়ন হয়ে উঠে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সেই ছোট্ট ক্লাসরুমেরই আরও ছোট বাসিন্দা ছাত্ররাও পর্যন্ত হয়ে ওঠে ছাত্রীদের কর্তৃপক্ষ।
আর, একচ্ছত্র কর্তৃপক্ষ শিক্ষক তো আছেনই ছাত্রীদের উপর "বিশেষ নির্যাতন" চালাতে, কিছুক্ষেত্রে তারা ছাত্রদের কর্তৃত্বপরায়ন, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবকে উস্কে দিতেও দ্বিধাবোধ করেন না।
আগাগোড়াই পুরুষতান্ত্রিকতায় নিমজ্জিত সমাজে ছাত্ররা অন্তরে পুরুষতান্ত্রিকতা লালন করে এবং ছাত্রীরা তার সঙ্গে আপোষ করে চলে, করতে হয়। এখানে বন্ধুত্ব ঠিক স্বাভাবিক সম্পর্ক নয়। এইদেশের মানুষ তাদের সাহিত্যেই লিখে রেখেছে – নারী ও পুরুষের কখনো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হতে পারে না, নারী ও পুরুষ কখনো একে অপরের বন্ধু হতে পারে না। অর্থ্যাৎ, নারী ও পুরুষের সম্পর্ক যৌনচাহিদা, ঘর-সংসার, সন্তান উৎপাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
এই বোধ এদেশের অধিকাংশ ঘরের সন্তান জন্মের পর থেকেই লাভ করে। সবে স্কুলে ভর্তি হওয়া কোনো বাচ্চা ছেলেকেও যদি জিজ্ঞেস করা হয় – তোমার স্কুলে বান্ধবী কয়জন? সে মুখ বেঁকিয়ে উত্তর দিবে তার কোনো বান্ধবী নাই। একইরকম উত্তর দিবে একটা বাচ্চা মেয়েও- তারও কোনো বন্ধু নাই।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে দেখেছি বন্ধুত্বের মুখোশের আড়ালে সেই কর্তৃত্বপরায়ন চেহারা। যারা তাদের সহপাঠিনীদের সাথে বন্ধুর মত মিশছে তারাই ক্লাসে বসে খাতার ভেতর সেই সহপাঠিনীরই বুক-স্তন-বসার ভঙ্গী আঁকছে এবং নিজেদের মধ্যে সেই ছবি চালাচালি করে হাসাহাসি করছে! আরও একটা অভিজ্ঞতার কথা বলছি -
গত পরশু (৭.৯.২০১৩) টিচার মুসলিম ল এর সাকসেশনের একটা চার্ট বুঝাচ্ছিলেন।
চার্টটা স্যার নিচের দিকে অনেক দীর্ঘ করে ফেলেছিলেন (না করলেও চলত)। চার্টটা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে দেখে আমাদেরই কয়েকজন বান্ধবী বলে উঠল, আর নিচে নামবেন না, স্যার। আর ওমনি ক্লাসের একাংশের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল।
স্কুল-কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, কোথাও বাদ নেই এমন ঘটনা। রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল এন্ড কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক ও বর্তমানে শেরপুর সরকারি কলেজের প্রভাষক লোকমান কবীর এই বিষয়ে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা আমাকে জানিয়েছেন ফেসবুকের মাধ্যমে।
সেগুলোই হুবহু তুলে দিলাম:
"আজ আমার ক্লাসে একটা সারিতে চারটি মেয়ে কথা বলছিল। আমার সমস্যা হল, কেউ কথা বললে আমি বলতে পারি না। তাই ওদের জিজ্ঞেস করলাম ওরা কি কথা বলছিল, কেন বলছিল? সাথে সাথে এক ছেলে, আামার কথা শেষ হতে না হতেই বলে ফেলল, স্যার ওদের বের করে দেন। মেয়ে বলেই ছেলেটার উৎসাহ অনেক বেশি ছিল। তখন আমি ছেলেটাকে বোঝালাম যে তার এটা বলা ঠিক হয়নি।
কারণ মেয়েরা যা করেছে, এটা তারাও করে, এবং এটা একটা ভুল, কিন্তু অন্যায় নয়। আমি বসে থাকলেও হয়তো করতাম। কিন্তু আমাকে সহযোগিতা করার জন্য অপ্রয়োজনীয় কথা বলা ঠিক না। এরকম কোন বিষয় নিয়ে কোন মেয়েকে যদি অপদস্ত করা যায়, তাহলে ছেলেরা সবাই একযোগে হইহই করে উঠে। "
বিদ্যালয় যদি স্বাধীনতাকামী প্রতিষ্ঠান হতো তাহলে শিক্ষার্থীদের এ থেকে মুক্তি দিতে পারত।
কিন্তু, আদতে বিদ্যালয় কোনো মুক্তিকামী প্রতিষ্ঠান নয়, বরং, কর্তৃত্বপরায়ন চরিত্রের অধিকারী। সুতরাং, পাঠাশালার সেই শিক্ষকেরাও অন্তরে লালন করেন পুরুষতান্ত্রিকতা। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তারা ছাত্রদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবকে উস্কে দিয়ে থাকেন। এইরকম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উদাহরণ ভরী ভরী, কিন্তু, পরিসংখ্যান অতি অল্পই।
রবীন্দ্রনাথের কথাটির উল্টো চিত্রই তো যুগে যুগে চিত্রিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে এখনও নারীকে শুনতে হয় ঘর-সংসারে সুখ আনার জন্যই পড়াশোনা করতে হবে, শিক্ষিত পুরুষের সংসারে গিয়ে তাকে বোঝার জন্যই শিক্ষিত হতে হবে। সন্তান মানুষ করার জন্য শিক্ষিত হতে হবে। খোদ শিক্ষকের মুখেই এমন কথা শুনতে হয়, বন্ধু-বান্ধবের কাছে শুনতে হয়, পরিবারের কাছে শুনতে হয় - প্রতিদিন শুনতে হয়। অথচ, নারীর যে পুরুষের মতোই ব্যক্তিত্ব আছে, মেধা আছে, সামর্থ্য আছে সেই বোধটি জাগ্রত করার দায়িত্ব ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। কিন্তু খোদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তারাই পুরুষতান্ত্রিকতায় নিমজ্জিত।
যাদের সেই বোধটিই নাই তারা কেমন করে মুক্তিকামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন?
ভারতবর্ষের সুপ্রাচীনকালের ইতিহাসে শিক্ষার বহুমাত্রিক বিস্তার দেখা যায়। ভারতবর্ষে ছিল টোল-পাঠশালা-মক্তব ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠদানের উৎস ছিল ধর্মশাস্ত্রের অন্তর্গত নীতিশাস্ত্র শিক্ষা এবং মাধ্যম ছিল পুরোপুরিই ব্যবহারিক। শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আল-মুতী রচিত “আমাদের শিক্ষা কোন পথে” গ্রন্থ হতে উদ্বৃতি করছি-
“এদেশে প্রাচীনকালে ও মধ্যযুগে দেশীয় সনাতন শিক্ষার বিস্তৃত ধারা ছিল; মূলত একদিকে ছিল টোল ও পাঠশালা এবং অন্যদিকে মক্তব-মাদরাসার শিক্ষা। এদেশের সব প্রধান ধর্মমতেও বিদ্যা শিক্ষার উপর ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
তবে এই সনাতন শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তার সম্বন্ধে কোন বিস্তারিত পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে ম্যাক্স ম্যুলার নামে বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ ও ইতিহাসবিদ সরকারি নথিপত্র ও মিশনারিদের বিবরণ থেকে দাবি করেছেন যে, ইংরেজরা যখন এদেশে প্রথম উপনিবেশ স্থাপন করে তখন বাংলায় ৮০,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব ছিল। ”
এইসব বিদ্যালয়ে বিদ্যাশিক্ষার জন্য মাসোয়ারাভিত্তিক কোনো অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা ছিল না। গুরুদক্ষিণার যে চলটি ছিল তা ছিল এককালীন এবং বিদ্যাশিক্ষা সমাপ্ত হবার পর। সাধারণত শিক্ষার্থীরা গুরুগৃহেই অবস্থান করত, নানান কাজকর্ম করত এবং বিদ্যার্জন করত।
ব্রিটিশ শাসন কায়েম হওয়ার পূর্বপর্যন্ত মোটামুটি এই ছিল ভারতবর্ষের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা। আবদুল্লাহ আল-মুতী রচিত গ্রন্থে উইলিয়াম এডামের ৯ রিপোর্টের বর্ণনা হতে আমরা এদেশের সনাতন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো তার একটা বর্ণনা পাই।
অ্যাডামের প্রথম রিপোর্টে বলা হয় বাংলা ও বিহারে প্রতি ৪০০ জন লোকের জন্য একটি পাঠশালা অর্থ্যাৎ, মোট এক লক্ষ পাঠশালা ছিল। এসব পাঠশালা মূলত গৃহকেন্দ্রিক ছিল বলে মনে হয়। এছাড়া ছিল পারিবারিক প্রাথমিক বিদ্যালয়।
শিক্ষাকাল ছিল ৮ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত। শিক্ষকদের গড় বেতন মাসিক পাঁচ টাকা; শিক্ষার্থীদের কোন বেতন দিতে হত না। তবে এসময়ে নারী-শিক্ষার কোন ব্যবস্থার কথা জানা যায় না।
অ্যাডামের তৃতীয় রিপোর্টে বলা হয়- সাধারণত বিদ্যালয় বলতে বোঝাত কারো উঠান বা মন্দির বা মসজিদ সংলগ্ন খানিকটা জায়গা। ছাপা বই ছিল না; লেখা হত শ্লেট বা ধুলোয়, কখনো খাগ, ভুসোকালি বা চকখড়ি দিয়ে।
স্কুল বসত সময়-সুযোগ মতো কখনো সকালে, কখনো বিকালে। কড়া বেতের শাসন চলত। উঁচু ক্লাসের ছাত্রকে দিয়ে নিচু ক্লাসের ছাত্রদের পড়াবার রেওয়াজ ছিল। উচ্চ শ্রেণীর বা জমিদার-ব্যবসায়ীদের সন্তানদের জন্য পারিবারিক শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল।
প্রাচীন এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সবচেয়ে চমকপ্রদ দিকটি হলো, এগুলো রাজার গোলাম বানাবার কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না।
রাজার সঙ্গে এর সরাসরি কোনো সংযোগও ছিল না। এইসব বিদ্যালয় যদিও পরবর্তীতে কোনো প্রগতিশীলতার সাক্ষর রাখতে পারে নাই এবং ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা এদের প্রতি দমনমূলক নীতি গ্রহণের ফলে এরা একসময় বিলুপ্ত হয়ে যায়, তথাপি, এই বিদ্যালয়গুলো রাজ কর্মচারী তৈরির কারখানা ছিল না। শিক্ষার্থীকে স্রেফ জীবন সম্পর্কে জ্ঞানদানই ছিল এর উদ্দেশ্য।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন কায়েমের পর থেকে এইসব টোল-পাঠশালা-মক্তব দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এর একমাত্র কারণ হলো, এসময় কোম্পানীর মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের নিজেদের মুনাফার স্বার্থে একটি দক্ষ প্রশাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং সেজন্য স্থানীয় কর্মকর্তা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
ইংরেজদের বশ্যতা বহুকাল আগেই মেনে নিয়েছিল তৎকালীন নেতৃস্থানীয়, বনেদী ও অভিজাত শ্রেনী। এই অভিজাত শ্রেণী বরাবরের মতোই ইংরেজদের সাথে রাজকার্যে অংশগ্রহণের জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল। সরকারি চাকরী করে এরা একটা নিশ্চিত, শহুরে, প্রভাবশালী ও অভিজাত জীবনযাপনের স্বপ্নে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এদের সমর্থনেই কোম্পানীর শাসক এবং পরবর্তীতিতে ব্রিটিশ শাসকেরা ইংরেজী শিক্ষার বিস্তারে অগ্রসর হয়। এছাড়া, পরবর্তীতে সনাতন পাঠশালার শিক্ষকশ্রেণীরও ব্যাপকভাবে আদর্শবিচ্যুতি ঘটেছিল এবং অত্যন্ত গোঁড়া এইসব শিক্ষাগুরুগণ প্রবল একগুঁয়েমী, প্রাচীনকে আঁকড়ে থাকার আকাঙ্খা নিয়ে সকল প্রকার প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন।
বিশেষত মুসলমান শ্রেণীর মধ্যে এই একরোখা জেদ তাদেরকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে এবং তাদেরকে প্রায় একশো বছর পিছিয়ে দেয়।
ইংরেজ সরকারের কর্তৃত্ব কায়েমের বন্দোবস্তে সরাসরি হাত মেলায় অভিজাত শ্রেণী। মূলত, এদেশের নেতৃস্থানীয় অর্থ্যাৎ নবাব-রাজা-জমিদার প্রভৃতি বনেদি পরিবারের সন্তানদের জন্যই কলকাতা মাদ্রাসা (১৮৭০) এবং কাশী (১৭৯১) ও কলকাতায় (১৮২৪) সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। কোম্পানীর মূল উদ্দেশ্যই যে অনুগত কর্মচারী সৃষ্টি করা সেটি পরিষ্কার হয়ে যায় কোম্পানীর শিক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান টমাস র্যা বিংটন মেকলে’র বক্তব্যে। মেকলে বললেন, কোম্পানির মূল উদ্দেশ্য হল ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে শাসনকাজ পরিচালনার জন্য উপযুক্ত কর্মচারি সৃষ্টি করা; দেশীয় ভাষা বা দেশীয় শিক্ষা দিয়ে সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না।
গভর্নর জেনালের বেন্টিঙ্ক মেকলের এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। এই নীতি অনুসারেই ১৮৩৭ সালে ফার্সির বদলে ইংরেজিকে সব ধরণের কাজকর্ম ও আইন-আদালতের মাধ্যম হিসেবে চালু করা হল এবং ইংরেজি জানা লোকদের চাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়া শুরু হলো। এতে কর্তৃত্বকামী, কর্তৃত্ববাদের মোহাবিষ্ট অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার আগ্রহ বেড়ে গেল। অভিজাত শ্রেণী ছাড়া বঞ্চিত হতে শুরু করল বাকি জনগণ। ফলে কর্তৃত্বপরায়ন ইংরেজদের শাসন আরও আসান হয়ে গেল।
লেখাটির এই অংশের খসড়া পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুস্মিতা চক্রবর্তী ফেসবুকে একটি মন্তব্য করেছেন। তাঁর মন্তব্যটি উদ্বৃতি করার বিশেষ প্রয়োজন মনে করছি -
অথচ, সনাতন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছিল স্বাধীন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এদের পাঠদান, ভাষা, বিষয় এবং পদ্ধতি ছিল বিভিন্ন এবং বৈচিত্রপূর্ণ। ব্যবহারিক জ্ঞানের প্রতি ছিল বিশেষ গুরুত্ব। ফলে, শিক্ষার্থী নিজেকে আবিষ্কার করতে পারত, আত্মশক্তিকে চিনতে পারত এবং স্বাধীনতাকামী হয়ে উঠত।
শাসকের কোনো প্রভাব এখানে ছিল না। ফলে, শিক্ষার্থীও রাজ কর্মচারী হবার বাসনায় বিদ্যার্জন করত না।
জ্ঞান-বিজ্ঞানকে গ্রহণ করা ও কর্তৃত্ববাদকে গ্রহণ করার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। জ্ঞান সর্বদাই উন্মুক্ত, তাকে শাসক কখনো লুকিয়ে রাখতে পারবে না। কিন্তু, শাসক জ্ঞানের প্যাকেজ বিক্রি করে সহজেই কর্তৃত্বতন্ত্র কায়েম করতে পারবে।
শুধুমাত্র, সনাতন এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যদি তাদের একগুয়েমী ধরে না রেখে স্বপ্রণোদিত হয়ে পাশ্চাত্যের সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতির উন্নত দিকগুলো গ্রহণ করত, বিভিন্ন গবেষণাকর্মে নিয়োজিত হয়ে প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের মিলন ঘটাতো এবং শিক্ষকশ্রেণীর কর্তৃপক্ষ হবার বাসনা মাথাচাড়া দিয়ে না উঠত তাহলেই হয়তো শাসক প্রদত্ত ইংরেজি শিক্ষার প্যাকেজটির মত গোলামীর শিক্ষা এদেশে কায়েম হতো না।
সবশেষে এবার আসি পরীক্ষা ও মূ্ল্যায়ন নিয়ে। এইদেশের শিক্ষায় পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের কাছে একটা ভীতির নাম, অভিভাবকের কাছে সকল আশা-আকাঙ্খার উৎস, শিক্ষকদের কাছে নিতান্তই দায়িত্ব এবং সরকারের কাছে একটি বিরাট রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগ। মূলত, সরকারই নিয়ন্ত্রণ করে শিক্ষার্থী পরীক্ষাকে কতটা ভয় পাবে, অভিভাবক কতুটুকু আশা করবে এবং শিক্ষক কোন ভূমিকা পালন করবেন এবং এই সমস্ত প্রক্রিয়াটি থেকে তারা কতটুকু লভ্যাংশ গুণবেন। পরীক্ষাকে রাজনৈতিক বিনিয়োগ বলার পেছনে যুক্তিটা হলো, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক স্তরে এবং অধুনা প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ প্রতিবছর কতটুকু বৃদ্ধি পাবে তা যেন পূর্ব নির্ধারিত।
এইদেশের যেকোনো স্কুল শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করলেই এইসব পরীক্ষার মূল্যায়ন প্রক্রিয়া কতখানি সরকার নিয়ন্ত্রিত তা জানা যাবে। প্রতি বছর আগবছরের তুলনায় বিভিন্ন হারে এইদেশে জিপিএ ফাইভের হার বৃদ্ধি পায়। এই হারবৃদ্ধি দ্বারা সরকার এটাই বুঝাতে চায় তাদের বিতরিত “জ্ঞান প্যাকেজ” সেবন করে কত্ত ভালো রেজাল্ট হচ্ছে! এতে সরকারের শিক্ষাখাতে উন্নয়নের গ্রাফটা উঁচু হয়, ফলে পপুলারিটি বাড়ে। আর ঐ পপুলারিটি বেচে আগামী নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দেওয়া যায়। আমরাও ঐ জ্ঞান প্যাকেজ খেয়ে এবং জিপিএ ফাইভের গর্বিত মালিক হয়ে খুশী হই।
আসলে এই জিপিএ বৃদ্ধি, পাসের হারবৃদ্ধি আদৌ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করে কিনা তা বলা অনিশ্চিত। পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে কোচিং সেন্টার। শৈশব কেড়ে নেওয়া কোচিং সেন্টারগুলোর বিনিয়োগ শুধুই টাকার অঙ্কে। এ হলো পরীক্ষার অর্থনৈতিক বিনিয়োগ। কোচিং সেন্টারগুলোর মধ্যে প্রাচীন পাঠশালার সেই বৈচিত্র না পাওয়া গেলেও যত্নটা পাওয়া যায়।
তাই, আমাদের দেশের কোচিং সেন্টারগুলো পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য একটা আস্থার নাম।
অর্থ্যাৎ, বিদ্যার্জনের জন্য এই যত্নআত্তি নয়, গলধঃকরণ করানোর জন্য এই আয়োজন। এই শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য পরীক্ষা নামক পুলসিরাত পার করিয়ে দেওয়া। সুতরাং, আমরা দেখতে পাচ্ছি, পরীক্ষা নামক এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটি শিক্ষার্থীর জানার গন্ডী এবং শিক্ষকের জানানোর স্পৃহাকে নষ্ট করার জন্য দায়ী। এটা আসলে শিক্ষর্থীর দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে।
ফলে, মাথা থাকে নিচের দিকে, চোখে লাগে ভারী চশমা, কাঁধে ঝোলে পাঠ্যবই। পরীক্ষা মানেই সিলেবাস, পরীক্ষা মানেই কমন-সাজেশন-মুখস্থ এবং কোচিং সেন্টারে দুর্দান্ত চাপ নিয়ে বারবার অনুশীলন। পরীক্ষা মানেই কম্পিটিশন। আর, আগেই বলেছি, কম্পিটিশন কক্ষনো বিদ্যাকে অর্জন করতে শেখায় না, গলধঃকরণ করতে শেখায়। এতে শিক্ষার্থী শুধু ঐটুকুই জানার অবকাশ পায় যেটুকু তাকে কর্তৃপক্ষ জানার জন্য অনুমতি দিয়েছেন।
“জ্ঞান-প্যাকেজ” গলধঃকরণ ও তা হুবহু উগড়ানোর নামই পরীক্ষা। এই পরীক্ষা আবার বাই প্রোডাক্টের মত সৃষ্টি করে কোচিং সেন্টার, গাইড বই, সাজেশন ইত্যাদি। আর, সৃষ্টি করে দুর্নীতির বিরাট সুযোগ। মাঝখান থেকে শিক্ষার্থী বঞ্চিত হয় অবারিত প্রকৃতির কাছ থেকে হাতে কলমে শিখতে, অসীমের দিকে তাকাতে। এই বঞ্চনার দায়ও কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।