যমুনার অধিক অ্যালকোহলের বিষময় হান্টার বিয়ার বাজারজাতের ক্ষেত্রে শত শত কোটি টাকা সরকারি শুল্ক ফাঁকির মহোৎসব চলছে। প্রতিদিন দেশে লক্ষাধিক ক্যান হান্টার বিক্রি হলেও শুল্ক পরিশোধ করা হয় মাত্র ৫ হাজার ক্যানের। বাকি ৯৫ হাজার ক্যানই শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ফেনসিডিলের মতো চোরাচালান স্টাইলে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সারা দেশে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কোনোভাবেই তা বন্ধ করতে পারছে না। বরং গোপন পথে পাচার হওয়া হান্টার বিয়ার আটক করতে গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পড়েন চরম বিপাকে।
শুল্ক ফাঁকি দিয়ে হান্টার বিয়ারের বড় বড় চালান পাচারকালে সিরাজগঞ্জ, কালিয়াকৈর ও টাঙ্গাইলে পৃথক অভিযানে সেসব আটক করা হয়। কিন্তু হান্টারবিরোধী অভিযান পরিচালনাকারী পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের অলৌকিক ক্ষমতাবলে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। তাদের কেউ কেউ চাকরি ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিড়ম্বনা পোহাচ্ছেন এখনো। এসব কারণে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পারতপক্ষে হান্টার বিয়ারবিরোধী অভিযান এড়িয়ে চলাকেই নিরাপদ মনে করেন। এসব কারণে একদিকে হান্টারের আগ্রাসী থাবায় যুবসমাজ যেমন ব্যাপক হারে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে সরকারের গচ্চা যাচ্ছে শত শত কোটি টাকার শুল্ক।
শুধু রাজধানীতেই মদের বার রয়েছে ১৪টি। ক্লাব রয়েছে অর্ধশতাধিক। এসব বার আর ক্লাবে যমুনা গ্রুপের ক্রাউন বেভারেজ কোম্পানির উচ্চমাত্রার অ্যালকোহলিক বিয়ার হান্টার বিক্রি হচ্ছে প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজার ক্যান। সারা দেশে বিক্রি হচ্ছে ১ লাখেরও বেশি ক্যান বিয়ার। অথচ যমুনা গ্রুপ সরকারকে শুল্ক প্রদান করছে গড়ে মাত্র ৫ হাজার ক্যান বিয়ারের।
কারখানায় উৎপাদন সংখ্যা ও চালানের পরিমাণ কম দেখিয়ে যমুনা গ্রুপ প্রতি বছর এভাবেই শত শত কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আসছে। হান্টার উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে যে ২৬টি শর্ত দেওয়া হয়েছিল, যমুনা গ্রুপ এর অধিকাংশ শর্ত কখনো মানে না। কিন্তু এ অপরাধে ওই মাদক কারখানার বিরুদ্ধে কোনোরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর এবং রাজস্ব বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে শুল্ক ফাঁকির মহোৎসব চালিয়ে যাচ্ছে নুরুল ইসলাম বাবুলের যমুনা গ্রুপ। লাইসেন্স প্রদানের শর্ত না মানলে তা বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যমুনা গ্রুপের ক্রাউন বেভারেজ কোম্পানি হান্টার বিয়ার উৎপাদনের অনুমোদন পায় ২০০৯ সালে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে হান্টার বিয়ার রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি বারে সরবরাহ শুরু করে। ক্রাউন বেভারেজ কোম্পানি প্রতিটি হান্টার বিয়ার ৬০ টাকা দরে বাজারে বিক্রি করছে। আর সরকারকে শুল্ক প্রদান করে আসছে প্রতিটি ক্যানের জন্য ৯ টাকা ৫৫ পয়সা করে। ২০০৯-১০ অর্থবছরের শেষ ৯ মাসে ক্রাউন বেভারেজ কোম্পানি সরকারকে শুল্ক প্রদান করেছে ১ কোটি ১০ লাখ ১৬ হাজার ২৭১ টাকা।
এ হিসাবে সারা দেশে যমুনা গ্রুপের হান্টার বিয়ার বিক্রি হয়েছে দিনে ৪ হাজার ২৭২ ক্যান। একইভাবে ২০১০-১১ অর্থবছরে বিক্রি দেখিয়েছে ৪ হাজার ৩৩৬ ক্যান। ২০১১-১২ অর্থবছরে কোম্পানিটি শুল্ক দিয়েছে ৪ হাজার ৫০৩ ক্যান বিয়ারের। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৮২৬ ক্যান বিয়ার বিক্রি হয়েছে বলে কাগজ-কলমে দেখিয়েছে যমুনা গ্রুপ। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের তিন মাসে শুল্ক প্রদান করেছে তারা ৫ হাজার ৫৫৩ ক্যান বিয়ারের।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি বারে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, অনুমতি না থাকলেও আগে বারগুলোতে বিদেশি মদ ও বিয়ার বিক্রি হতো। কিন্তু যমুনার হান্টার বিয়ার বাজারজাতকরণের পর তারা আর বিদেশি মদ বিয়ার বিক্রি করতে পারছে না। যমুনা গ্রুপ প্রভাব বিস্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে অভিযান চালায়। একটি বারের মালিক জানান, তার বারে হান্টার বিয়ার ছাড়া অন্য কিছু বিক্রি হয় না। প্রথম দিকে হান্টার বিয়ারের খুব একটা কাস্টমার ছিল না।
পরে ক্রাউন বেভারেজ কোম্পানির হান্টার বিয়ারে অতিরিক্ত অ্যালকোহল দেওয়ায় কাস্টমাররা এই বিয়ারের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। তিনি জানান, ৩৩০ মিলিলিটারের বিয়ারের ক্যানে ১৩ শতাংশ অ্যালকোহল পর্যন্ত দেওয়া হয় বলে জানান বারের ওই মালিক। যে কারণে হান্টারের প্রতি ঝুঁকছে কাস্টমাররা। রাজধানী ঢাকার উত্তর এলাকায় অবস্থিত ওই বারের মালিক আরও জানান, প্রতিদিন তার বারেই হান্টার বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৩ হাজার ক্যান। রাজধানীর এমন কোনো বার নেই যেখানে কমপক্ষে ২ হাজার ক্যান হান্টার বিয়ার বিক্রি হয় না।
সর্বোচ্চ ৪ হাজার ক্যান বিয়ারও কোনো কোনো বারে বিক্রি হয়ে থাকে।
বাংলামোটর এলাকার একটি বারের মালিক জানান, দিনে একাধিকবার অভিযান চালায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও পুলিশ। হান্টার বিয়ার উৎপাদনে আসার পর থেকে আমাদের ওপর অনেক ঝক্কি ঝামেলা গেছে। হান্টার ছাড়া অন্য কিছু বিক্রি হয় কি না, তা দেখার জন্য পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর অভিযান চালাত। হান্টার বিক্রি না করে অন্য কোনো বিয়ার বিক্রি হচ্ছে কি না, অভিযানে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা এটি শুধু পরীক্ষা করতেন।
অন্য কোনো কাজ তারা করতেন না। যমুনা গ্রুপের নুরুল ইসলাম বাবুলের নির্দেশেই হতো এসব অভিযান। এক দিনে তিন থেকে চারবারও অভিযান চালিয়েছে। এখন শুধু বারগুলোতে হান্টার ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যায় না। এ ছাড়া রাজধানীর যেসব ক্লাবে বিদেশি মদ ও বিয়ার বিক্রি হতো, সেখানেও এখন হান্টার।
হান্টার বিক্রি না হলে ক্লাব চালানোই কঠিন হয়ে পড়ে বলে সূত্র জানায়।
হান্টার সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন এমন একজন কর্মকর্তা জানান, ঢাকার অদূরে কালিয়াকৈরের কারখানা থেকে সারা দেশে হান্টার সরবরাহ করা হয়ে থাকে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ লাখ ক্যান বিয়ার এ কারখানা থেকে সরবরাহ করা হয়। সূত্রে জানা গেছে, সরকার অনুমোদিত বিশেষ কিছু বার ও রেস্টুরেন্ট ছাড়া খোলা বাজারে সাধারণ মানুষের কাছে বিয়ার বিক্রির কোনো সরকারি অনুমতি নেই। এরই মধ্যে যমুনা গ্রুপ প্রত্যন্ত অঞ্চলে হান্টার বিয়ারের অবৈধ বিপণনের সুবিধার্থে সারা দেশে গোডাউন/স্টকিস্ট সৃষ্টি করার মাধ্যমে এক বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে হান্টার বিয়ার ব্যাপকভাবে খোলা বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে।
এতে একদিকে অধিক অ্যালকোহলযুক্ত বিয়ার পানে আসক্ত হয়ে পড়ছে ছাত্রছাত্রী ও যুবসমাজ, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। এরই মধ্যে হান্টার বিয়ার শহরের গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্রামগঞ্জের আনাচে-কানাচে এমনকি মুদি দোকানেও প্রসার ঘটিয়েছে। উল্লেখ্য, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত মদ ও মদ-জাতীয় পণ্য তথা বিয়ারের ওপর যেখানে ৪০০ থেকে ৫০০% শুল্ক নির্ধারিত, সে ক্ষেত্রে হান্টার বিয়ার অত্যন্ত সুলভ মূল্যে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।