আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যমুনার ছাদ ধসে ব্যবসায়ী নিহত

যমুনা ফিউচার পার্কের নির্মাণাধীন ভবনের ১০ তলার ছাদ ধসে করুণ মৃত্যু ঘটেছে মো. শাহীন (৩০) নামে এক মোটরসাইকেল চালকের। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বাজার করে পার্ক-সংলগ্ন ক-১৮৬ কুড়িল ঘাটপাড়ায় নিজ বাসায় ফিরছিলেন তিনি। তার মাথার ওপর ছাদের বিশাল বড় স্টিল অ্যাঙ্গেল, কংক্রিট, ইট-কাঠ-পাথর ধসে পড়ার পরও রক্তাক্ত অবস্থায় ছটফট করছিলেন শাহীন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ লাঠিসোঁটা, কুড়াল আর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে তাকে উদ্ধারে বাধা দেন যমুনা ফিউচার পার্কের অর্ধশতাধিক নিরাপত্তাকর্মী। এ ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় অধিবাসীরা।

যমুনা গ্রুপ মালিকসহ দোষীদের তৎনগদ গ্রেফতারের দাবিতে প্রগতি সরণিতে জড়ো হন মহল্লার শত শত নারী, পুরুষ, শিশু। জনতার মিছিলে চড়াও হন এবং বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন যমুনা গ্রুপের নিরাপত্তাকর্মীরা। এতে কুড়িল, ঘাটপাড়, দক্ষিণপাড়া, কাজীবাড়ী, চৌরাস্তাসহ আশপাশের পাড়া-মহল্লা থেকে আরও কয়েক হাজার জনতা রাস্তায় নেমে ব্যারিকেড দেয়। এ সময় বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এলাকায় জনপ্রিয় সমাজসেবী যুবক শাহীনের মৃত্যুর খবরে আশপাশের সর্বত্র শোকের ছায়া নামে।

হাজার হাজার শোকার্ত মানুষের ভিড় জমে ওঠে তার মরদেহ আর বাড়ি ঘিরে। নিহত শাহীন দুই মেয়ে ও এক ছেলের জনক। তার সদ্য বিধবা স্ত্রী হাফিজা বেগমের (২৬) বুকফাটা কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে গোটা এলাকার পরিবেশ। স্বজনদের আহাজারিতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি উপস্থিত লোকজনের কেউ। নিহত শাহীনের বাবা মৃত হাছন উদ্দিন।

কুড়িল চৌরাস্তা-সংলগ্ন ক-১৮৬ ঘাটপাড় এলাকায় তার বাড়ি। শাহীন ছিলেন সুপরিচিত ঠিকাদার। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। শাহীনের বড় ভাই হযরত আলী ক্রন্দনরত অবস্থায় বারবার বলতে থাকেন, 'যমুনার সিকিউরিটিরা আমার ভাইটাকে বাঁচতে দিল না। ঘটনাস্থল থেকে তৎক্ষণাৎ উদ্ধার করে ২০০ গজ দূরেই এ্যাপোলো হাসপাতালে নেওয়া গেলেও বেঁচে যেত তার প্রাণ।

'

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ছাদের বিরাট অংশ ধসে চাপা পড়া শাহীন গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করে চোখের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেও শুধু বাধার কারণে বাঁচানো যায়নি তার জীবন। এ ঘটনায় স্থানীয় অধিবাসীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। যমুনা গ্রুপের মালিকসহ দোষীদের তৎনগদ গ্রেফতারের দাবিতে প্রগতি সরণিতে জড়ো হন মহল্লার শত শত নারী, পুরুষ, শিশু। এ সময় যমুনা গ্রুপের নিরাপত্তাকর্মীরা গুলি চালালে জনতা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। যমুনা ফিউচার পার্কের সীমানাপ্রাচীর ভাঙতে শুরু করে তারা।

খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে অতিরিক্ত পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শী প্রাইভেট কার চালক সাগর আলম (২৫) জানান, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ৩ ও ৪ নম্বর গেট-সংলগ্ন সড়ক দিয়ে তিনি উত্তর দিকে যাচ্ছিলেন। তার গাড়ির ঠিক ১০-১২ গজ পেছনে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন শাহীন। যমুনা ফিউচার পার্কের উত্তর-পূর্ব পাশ অতিক্রম করছিল শাহীনের মোটরসাইকেল। এ সময় বিকট শব্দে ধসে পড়ে ফিউচার পার্কের নির্মাণাধীন সাততারা হোটেল ভবনের ১০ তলার ছাদ।

৩০-৩৫ ফুট লম্বা বিশাল ওজনের একেকটি অ্যাঙ্গেল বিপজ্জনকভাবে ছুটে এসে আছড়ে পড়তে থাকে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি-ঘেঁষা রাস্তার ওপর। এ সময় আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে থাকেন আশপাশের লোকজন। প্রাইভেট কার চালক সাগর বলেন, 'আমি বিকট শব্দ শুনেই পেছন দিকে তাকিয়ে দেখি, শাহীনের মাথা ও কাঁধের ওপর স্টিলের অ্যাঙ্গেল, ইট-সুরকি ধসে পড়তেই তিনি তীব্র আর্তনাদ করে মোটরসাইকেলসহ রাস্তার ওপর আছড়ে পড়েন। আমি তৎক্ষণাৎ গাড়ি থামিয়ে রক্তাক্ত শাহীনকে উদ্ধারের জন্য ছুটে যাই। কিন্তু ততক্ষণে নির্মাণাধীন ভবনের ভেতর থেকে বাইরের ভাঙা টিনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে যমুনা ফিউচার পার্কের নিরাপত্তাকর্মীরা লাঠিসোঁটা, দা, কুড়াল নিয়ে ঘটনাস্থল ঘিরে দাঁড়ায়।

আমাকেও তারা ধাওয়া দিলে আত্দরক্ষার্থে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে হয়। এ সময় স্টিলের অ্যাঙ্গেলসহ ধসে যাওয়া ছাদের চাপায় শাহীনের সারা দেহ থেঁতলে যায়। রক্ত ছুটতে থাকে ফিনকি দিয়ে। গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করতে থাকেন তিনি। ১৫ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে মৃত্যুপথযাত্রী একজন তরতাজা যুবকের কাতরানোর মর্মস্পর্শী দৃশ্য শুধু চেয়ে চেয়েই দেখলাম।

কিন্তু ব্যর্থ হলাম তাকে বাঁচানোর জন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে। এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে...। ' বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন প্রাইভেট কার চালক সাগর। ভাটারা থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ আলী জানান, খবর পাওয়ামাত্র ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়। তারা রক্তাক্ত শাহীনের নিথর দেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

ঘটনার পরপরই মিছিলযোগে রাস্তায় নেমে আসে উত্তেজিত জনতা। যমুনা ফিউচার পার্কের সীমানাপ্রাচীর ভাঙার চেষ্টা চালায় তারা। এ সময় প্রগতি সরণিতে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে বেশ কয়েকটি গাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধরা। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।

নিরাপত্তা-বেষ্টনী নেই : ঘটনাস্থল-ঘেঁষা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ৩ ও ৪ নম্বর গেটে দায়িত্ব পালনকারী নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, যমুনা ফিউচার পার্ক আন্তর্জাতিক মানের হোটেলটির নির্মাণকাজ চালালেও সেখানে দেওয়া হয়নি কোনো নিরাপত্তা-বেষ্টনী।

যে সড়কটি ঘেঁষে এ মৃত্যুফাঁদ গড়ে তোলা হচ্ছিল সেখানেই হরদম জমে থাকে ভার্সিটির কয়েকশ শিক্ষার্থীর ভিড়। ইউনিভার্সিটির ক্লাস বন্ধ থাকায় বাঁচা গেছে বড় দুর্ঘটনা থেকে। নিরাপত্তাকর্মীরা আরও জানান, বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও কোনো রকম পাত্তা দেয়নি ভবন নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষ। একটি চটের ছাউনি পর্যন্ত দেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেনি তারা।

আশপাশের বাসিন্দারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, নিরাপত্তা-বেষ্টনী ছাড়া ১০ তলা উঁচু বিশাল ভবনের নির্মাণকাজ চলা অবস্থায় রাজউকের গুলশান জোনে দায়িত্বরত অথরাইজড অফিসার সুকুমার বড়ুয়াকে বারবার জানানো হয়েছে।

তিনি নিজেও একবার এসে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে অভিযোগের সত্যতা দেখতে পান। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রহস্যজনক কারণে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি তাকে।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে অথরাইজড অফিসার সুকুমার বড়ুয়া বলেন, 'যমুনা গ্রুপের মালিক একজন বড় মাপের গডফাদার। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সাধ্য আমার নেই। আমি পুরো বিষয়টি লিখিত প্রতিবেদন আকারে রাজউকের মেম্বার (এস্টেট)-কে জানিয়েছি।

কিন্তু তিন মাস পার হলেও নির্দেশনা পাইনি ব্যবস্থা নেওয়ার। '

বাবাকে হারিয়ে দুই শিশুর কান্নায় ভিজে ওঠে সবার চোখ : যমুনা ফিউচার পার্কের ১০ তলার ছাদ ধসে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় মো. শাহীনের। তার শিশুকন্যা আনিকা আক্তারের (১০) গড়াগড়ি আর কান্না যেন থামছেই না। কারও সান্ত্বনাও তার কানে যাচ্ছিল না। অঝোর ধারায় চোখের পানি আর বুকফাটা আহাজারিতে মুহূর্তেই ভারী হয়ে ওঠে কুড়িলের পরিবেশ।

বারবার আনিকার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় 'আব্বু আমাকে প্রাইমারিতে পাস করালো- ভর্তি করে যেতেও পারলো না। ' নিহত শাহীনের বড় মেয়ে আনিকা প্রাথমিক সমাপনী (পিএসসি) পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট নিয়ে গত সোমবারই পাস করে। খবরটি পেয়েই শাহীন ১০ কেজি মিষ্টি নিয়ে প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে পেঁৗছে দেয়। গতকালই যোগাযোগ করে বসুন্ধরাস্থ ভিকারুননিসা নূন স্কুলের পরিচিত শিক্ষকদের সঙ্গে। সারা বিকাল মেয়েকে মোটরসাইকেলে চড়িয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে।

কিন্তু রাত পোহানোর পরই সেই প্রিয় বাবাকে হারাতে হবে আনিকা তা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। বারবার বাবার কাছে ছুটে যেতে চায়। মাটিতে আছড়ে পড়ে গড়াগড়ি দিতে থাকে। আর এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত লোকজনেরও চোখ ভিজে ওঠে। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলে অনেকেই।

আনিকার ছোট বোন দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী অনিমা (৭) এগিয়ে যায় বোনের কাছে, দু হাতে চোখের পানি মুছে দেয়। এরপর দুই বোনই জড়াজড়ি করে কাঁদতে থাকে।

এ দৃশ্য দেখে একমাত্র ছোট ভাই অয়নও (২) হামাগুড়ি দিয়ে বোনদের কাছে যায়। অয়নের বোঝার ক্ষমতা নেই কি ঘটেছে। এদিকে শাহীনের সদ্য বিধবা স্ত্রী হাফিজা বেগমের কান্না থামানোর সাধ্য যেন কারওরই নেই।

কখনো তিনি বুক চাপড়ানো বিলাপে বাড়িজুড়ে হৈচৈ করছেন। পরক্ষণেই সম্বিত হারিয়ে নীরব নিথর হয়ে পড়ছেন। তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহত শাহীনের বড় ভাই হযরত আলী (৪৫)। তিনি বলেন, তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ও আদরের ভাই ছিল শাহীন। তাকে ঘিরেই ছিল পুরো পরিবারের আনন্দ।

দুই কাঠা জমি দান করার মাধ্যমে মসজিদ গড়ে তুলছিল শাহীন। অথচ সেই মসজিদে এক ওয়াক্ত নামাজও পড়ার সুযোগ পেল না।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।