আরও একটি ‘ধবলধোলাই’য়ের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ব্যাটিংটা কী অসাধারণই না হলো! বোলারদের ব্যর্থতার দিনে একসঙ্গে জ্বলে উঠলেন বাংলাদেশের প্রায় সব ব্যাটসম্যান। প্রথমে শামসুর রহমান পরে নাঈম ইসলাম। শেষটা করলেন নাসির হোসেন। এঁদের পাশাপাশি জিয়াউর রহমান, মুমিনুল হক, মাহমুদউল্লাহ আর সোহাগ গাজীও কম যান কিসে! সাড়ে তিন বছর পর বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘বদলে যাওয়া’র সাক্ষী হয়ে থাকল কিউই বাহিনী। টানা সাতটি ওয়ানডেতে বাংলাদেশের কাছে পরাজয়ের এই অভিজ্ঞতা থেকে টেলর-মিলস-অ্যান্ডারসনরা হয়তো খুব ভালোভাবেই বুঝে গেছেন, নাহ, সত্যিই এ এক অন্য বাংলাদেশ।
একটা সময় ছিল যখন আগে ব্যাটিং করে প্রতিপক্ষের বড় সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গেই হেরে বসত বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ আড়াই শ করুক আর ২৭০ করুক, বাংলাদেশ সম্মানজনক পরাজয়ের আপ্রাণ চেষ্টা করে যেত। প্রতিপক্ষের তিন শর ওপর স্কোর অতিক্রম করার কথা তো ছিল এক কথায় অভাবনীয়। কিন্তু আজ ফতুল্লায় সেই সব অতীতের গ্লানিগুলো কী অসাধারণ মুগ্ধতা জাগিয়েই না পেছনে ফেলল টাইগারের দল। এ দেশের ক্রিকেটের নতুন দিনের শুরুটা আগেই হয়েছিল।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টানা দ্বিতীয় ‘ধবলধোলাই’য়ের পর নতুন দিন শুরুর ব্যাপারটা সত্যিই পেয়ে গেল পরিপূর্ণতা।
ফতুল্লায় আজ তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডের সকালটা একেবারেই বাংলাদেশের ছিল না। টসে জিতেও সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিখাদ ব্যাটিং উইকেটে অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম যখন ফিল্ডিং বেছে নিলেন, তখনই অনেকে ছিলেন তাঁর প্রতি খড়্গহস্ত। বাংলাদেশের বোলারদের এলোমেলো বোলিং মুশফিকের সিদ্ধান্তের পক্ষে সমার্থক না হওয়ায় অনেকেই আক্ষেপে পুড়ছিলেন, ‘নাহ, হোয়াটওয়াশটা আর হলো না। ’ কিউই ব্যাটসম্যান রস টেলর যেভাবে আজ জ্বলে উঠলেন, ব্যাটের আগুনে ছারখার করে দিলেন বাংলাদেশের বোলিংকে, সেখান থেকে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী যে খুব বেশি মানুষ ছিলেন না, সেটা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কালো মেঘে ঢাকা পড়ে যাওয়া স্বপ্নটার মুখে যেভাবে হাসি ফোটালেন, তাতেই জড়িয়ে রইল বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন দিনের কাব্য। এখন আর হারার আগেই হেরে যায় না বাংলাদেশ। বরং হারকে জয়ে অনুবাদ করার মতো সব অস্ত্রই এ দেশের ক্রিকেটে আছে।
মাত্র দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশের জার্সি পরে খেলতে নেমেছিলেন শামসুর রহমান। অসুস্থতাজনিত কারণে তামিম দলে ছিলেন না।
সাকিব আল হাসান তো সিরিজের শুরু থেকেই শয্যাশায়ী। কিন্তু তাতে কী, শামসুর রহমান কিংবা জিয়াউর রহমান কিংবা মুমিনুল-নাসিররা যে এ দেশের ক্রিকেটের নবযুগের কান্ডারি, ওই কান্ডারিরাই আজ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ তরিকে নিয়ে গেলেন জয়ের বন্দরে। শামসুর রহমান-জিয়াউর রহমানের অনন্য উদ্বোধনী জুটির ওপর ভর করে বাংলাদেশ ৩০৮ রানের চ্যালেঞ্জের দিকে এগিয়ে গেল দৃপ্ত পদক্ষেপে। শামসুর তাঁর দ্বিতীয় ওয়ানডেতে খেললেন ৯৬ রানের স্বপ্নীল এক ইনিংস। মাত্র ৪ রানের জন্য জন্য সেঞ্চুরিটা মিস করার আক্ষেপটা হয়তো তিনি ভুলে যাবেন দিন শেষে বাংলাদেশের জয়ের আনন্দে।
কিন্তু এটা ঠিক, এই তরুণের ব্যাট আজ যেভাবে কিউই বোলারদের ‘খুন’ করে গেছে নিরন্তর হিংস্রতায়, সেখানে এই ইনিংসকে বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস বললেও খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যায় না।
তামিমের বদলে দলে সুযোগ পাওয়া জিয়াউর রহমানকে আজ নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটের মারকুটে জিয়া প্রমাণ করেছেন, তিনি উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবেও কম যান না। শামসুর রহমানের সঙ্গে জুটি গড়ে তিনি ভিত গড়ে দিয়ে যান অনন্য এই জয়ের। জিয়ার বিদায়ের পর যাঁরাই উইকেটে এসেছেন, দলের জন্য কিছু না কিছু অবদান রাখার চেষ্টা করেছেন।
প্রথমে মুমিনুল। তাঁর ৩২ রানের ইনিংসটি ছোট্ট হলেও তা নিউজিল্যান্ডের বোলারদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরাতে যথেষ্ট ছিল। অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম দুর্ভাগ্যজনকভাবে আউট হয়ে গেলেও নাঈম ইসলাম ৬৩ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলে দলকে নিয়ে গেছেন জয়ের কাছাকাছি। শেষ দিকে নাসির হোসেনের ৪৪ রান যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেটা বোধ হয় আলাদাভাবে না বললেও চলে।
মাহমুদউল্লাহ কিংবা সোহাগ গাজীর কথা ভুলে যাওয়া চলবে না।
অমন শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তে মাহমুদউল্লাহ আর সোহাগের ছোট্ট ইনিংস দুটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেটা খুব ভালোভাবে টের পেয়েছে বরং নিউজিল্যান্ড। ওই সময় মাহমুদউল্লাহ ও সোহাগ যদি দ্রুত আউট হয়ে যেতেন, তা হলে কাছাকাছি এসেও জয় হাতের মুঠোয় না নিতে পারার আক্ষেপে হয়তো পুড়তে হতো বাংলাদেশকে।
এতকিছুর পরও এটি বাংলাদেশের সেরা রান তাড়া নয়। এর চেয়েও বড় অঙ্কের রান তাড়া করে বাংলাদেশ এর আগে জয় পেয়েছে। ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩১৩ রান করে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ।
কিন্তু আজ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩০৮ রান তাড়া করে জয়ের এই কীর্তি হয়তো গুণে-মানে ছাড়িয়ে যাবে বুলাওয়ের ওই মাহেন্দ্রক্ষণটিকেও। ওটা ছিল জিম্বাবুয়ে আর এটা নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। আচার-বিচারে নিউজিল্যান্ড তো ক্রিকেটের এলিট শক্তিই!
ঘুরে-ফিরে সেই কথাটিই আসছে। এটা তো নতুন দিনের বাংলাদেশ। বদলে যাওয়া এই বাংলাদেশ হয়তো এমন বিজয়েও ঠিক ‘সন্তুষ্ট’ নয়!!
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।