আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গরিবের গায়ে হরতালের আগুন

কাজের কারণে পরিবারকে তেমন সময় দিতে পারেন না কাভার্ড ভ্যানচালক রমজান আলী। কয়েক দিন তাই ছেলেকে নিজের কাছে রাখতে ভ্যান নিয়ে যেখানেই গেছেন, সঙ্গে দিয়ে গেছেন। গতকাল সকাল ১০টার দিকে হরতাল-সমর্থকেরা তাঁর ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দেন। পুড়ে যায় ভেতরে থাকা রমজানের ছেলে মনির হোসেনের (১৫) শরীর।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকেরা বলেছেন, মনির হোসেনের শরীরের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে।

বাঁচার সম্ভাবনা তেমন একটা নেই।
মনিরের মতো ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে গতকাল সোমবার যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখা গেছে এক শিশুসহ আরও পাঁচজনকে। আগুন আর পেট্রলবোমায় ঝলসে গেছে তাঁদের শরীর। বোমাসৃষ্ট আগুনে পুড়ে মারা গেছেন মোস্তাফিজুর রহমান নামের একজন।
হাসপাতালে উপস্থিত স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আহত ব্যক্তিদের প্রায় সবাই নিম্ন আয়ের পরিবারের সদস্য।

কেউ কেউ পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী।
বার্ন ইউনিটের দুই তলায় গিয়ে দেখা যায়, আহত মনিরের দিকে মলিন মুখে তাকিয়ে আছেন বাবা রমজান। মনিরের সারা শরীরে ব্যান্ডেজ। পুড়ে কালো হয়ে গেছে মুখ। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠলেই হাত চেপে ধরছেন বাবা।


রমজান প্রথম আলোকে বলেন, একটি প্রতিষ্ঠানের কাভার্ড ভ্যান চালান তিনি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় মালামাল বহন করে নিয়ে যাওয়াই তাঁর কাজ। গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বড় কাঞ্চনপুরে। ছেলে মনির সেখানে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে পড়ে। গত শনিবার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তিনি।

গতকাল সকালে সোয়ারীঘাট থেকে মালামাল নিয়ে গাজীপুর বাজারে যান। মালামাল নামানোর পর গাজীপুরে চান্দনা চৌরাস্তার এক পাশে ভ্যানটি রেখে গাড়ি থেকে নামেন তিনি। ভেতরে ছিল মনির। হঠাৎ কয়েকজন দুর্বৃত্ত ভ্যানটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

রমজান বলেন, ‘হঠাৎ পেছনে তাকাইয়া দেখি, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতেছে।

আমি দৌড়াইয়া গিয়া আমার ছেলেরে খুঁজতে থাকি। দেখি, আগুনে পুরা শরীর পুইড়া অজ্ঞান হয়ে পইড়া আছে। ছেলের প্যান্টের পকেটে ১৮ হাজার টাকা রাখছিলাম, তা-ও পুইড়া ছাই হয়ে গেছে। ’

বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল সাংবাদিকদের জানান, মনিরকে বাঁচাতে তাঁরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
রমজান জানান, তাঁর এক সন্তান জন্মের সময়ই মারা যায়।

তিন বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় আরেক সন্তান। শোক না কাটতেই এখন আরেক বিপদের মুখোমুখি তিনি।
মনিরের মতো কাভার্ড ভ্যানে দেওয়া আগুনে পুড়ে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানার কাভার্ড ভ্যান চালক রোকনুজ্জামান (৩২)। গাজীপুর চৌরাস্তা চৌধুরীবাড়ি এলাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন তিনি। গত রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে গাজীপুর চৌরাস্তায় কাভার্ড ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দিলে গুরুতরভাবে দগ্ধ হন তিনি।

আপাতত পোশাক কারখানা কর্তৃপক্ষ তার চিকিৎসার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন।
বার্ন ইউনিটের নিচতলার একটি বেডে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে নয় বছরের শিশু মোছাম্মৎ সুমি। আগুনে পুড়ে গেছে চোখের উপরিভাগ। পুড়ে গেছে মাথা, চুল। হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ।

পাশেই যন্ত্রণায় কাতর দাদি রহিমা বেগম (৪৫)। আগুনে পুড়ে গেছে তাঁর শরীরও।
পরিবারের সদস্যরা জানান, মা-বাবা, ভাইবোন ও দাদির সঙ্গে নেত্রকোনার দুর্গাপুরে থাকে সুমি। স্থানীয় একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। গত রোববার দাদির সঙ্গে বাসে চড়ে নেত্রকোনা থেকে রাজধানীর উত্তরায় ফুফুর বাসায় বেড়াতে আসছিল সে।

বাসটি জয়দেবপুর চৌরাস্তায় এলে কয়েকজন যুবক তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় সুমি ও তার দাদিকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল ও পরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়।

সুমির ফুফা কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সুমির বাবা গ্রামে কৃষিকাজ করেন। তারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল। আপাতত দুজনের চিকিৎসার খরচ তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন।

বার্ন ইউনিটের আরেক বেডে কাতরাচ্ছেন সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক আসাদুল গাজী (৩০) ও হাসু আহমেদ (৩৪)। রোববার রাতে সাভার ক্যান্টনমেন্ট-সংলগ্ন এলাকায় দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রল বোমায় তাঁদের শরীর পুড়ে যায়। একই ঘটনায় পুড়ে যাওয়া হাসুর সহকর্মী মোস্তাফিজুর রহমান মারা গেছেন গতকাল বেলা ১১টার দিকে।

আহত হাসু আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সাভারের বিশ্বাস সিনথেটিক লিমিটেডের কর্মচারী তিনি। নিহত মোস্তাফিজুর বিপণন কর্মকর্তা।

রোববার তাঁরা পুরান ঢাকা থেকে কিছু যন্ত্রপাতি কিনে সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগে সাভারে ফিরছিলেন। ক্যান্টনমেন্টের সামনে এলে চলন্ত সিএনজির সামনে পেট্রল বোমা ছুড়ে মারেন হরতাল-সমর্থকেরা। এতে তাঁরা তিনজনই গুরুতর দগ্ধ হন।
আসাদুলের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলে। থাকেন যাত্রাবাড়ীতে।

গ্রামের বাড়িতে দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে থাকেন তাঁর স্ত্রী মর্জিনা বেগম। হাসু আহমদ দুই শিশুসন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে সাভারের নবীনগরের কুরগাঁওয়ে থাকেন।
দগমশ এই দুজনই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এমন পরিণতিতে চোখে অন্ধকার দেখছে তাঁদের পরিবার।

 



সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।