যতক্ষণ আছ হেথা স্থিরদীপ্তি থাকো, তারার মতন।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : জাহিদ রুমান
আ ব ম ফারুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল শিক্ষক ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তিনি। শিক্ষাবিদ, ওষুধবিশেষজ্ঞ আ ব ম ফারুক বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ।
বোতলজাত পানীয়ের উৎপাদন, জনস্বাস্থ্যে এই পানীয়ের ক্ষতিকর প্রভাব এবং জনগণ, সরকার ও গণমাধ্যমের করণীয়সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি সম্প্রতি বিবার্তা টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর সঙ্গে আলাপনের চুম্বক অংশ পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হল:
কোমল পানীয়ের কথা
সাধারণ কোমল পানীয়তে সোডিয়াম বাই-কার্বনেট, টারটারিক এসিড, সাইট্রিক এসিড জাতীয় উপাদান থাকায় গ্যাসের বুদবুদ ওঠে, এগুলো পান করতে ভাল লাগে। আর চিনি জাতীয় উপাদান থেকে কিছুটা ক্যালরি পাওয়া যায়। বিশুদ্ধ পানির অভাব তো আছেই। আর বাংলাদেশ এমন একটি অদ্ভুত দেশ যেখানে এক বোতল পানির দাম ১৫ টাকা।
সমপরিমাণ টাকায় এক বোতল সফট ড্রিংকসও পাওয়া যায়। ফলে তৃষ্ণায় পানির বদলে সফট ড্রিংকস পানের প্রবণতাই বেশি দেখা যায় মানুষের মধ্যে।
পণ্যমূল্য ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক
পানির মূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি দেখার কেউ না থাকায় কোমল পানীয়ের বিক্রি দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে। এসব পানীয় শরীরের জন্য উপকারী মোটেও নয়, তবু মানুষ এগুলো খাচ্ছে এর কারণ বিজ্ঞাপন। সফট ড্রিংকস খেলে শরীরের শক্তি বেড়ে যায়- বিজ্ঞাপনে এমন ভুলবার্তা দিয়েও মানুষকে প্রভাবিত করা হচ্ছে।
ম্যাগি নুডলস কিংবা হরলিক্সের বিজ্ঞাপনের কথাও বলা যায়। বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা না থাকায় এটি হচ্ছে। উন্নত দেশে যেখানে জনস্বার্থে বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সেখানে এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে অসত্য তথ্য পরিবেশন করে, ভুলবার্তা দিয়ে ভোক্তাকে প্রলুব্ধ করার প্রবণতা দেখা যায়। স্বল্পশিক্ষিত শ্রেণি ও তরুণরাই এসব পানীয়ের প্রধান গ্রাহক।
দেখা যাচ্ছে যে, বিজ্ঞাপন, পানির অধিক দাম, মানুষের অসচেতনতা-সব মিলিয়ে সফট ও এনার্জি ড্রিংকসের পক্ষে একটি পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে।
পানীয় গ্রহণে মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা
এসব সফট ও এনার্জি ড্রিংকস নিয়মিত ও অতিরিক্ত পান শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। কিন্তু এটা বলা হচ্ছে না। আমি মনে করি- পানীয়ের মোড়কেই এই সতর্কবার্তা লেখা থাকা উচিৎ। আর এনার্জি ড্রিংকসে সফট ড্রিংকসের সকল উপাদান ছাড়াও অতিরিক্ত যেটা থাকে তা হল- ক্যাফেইন।
চা-কফিতেও এটা থাকে। চা-কফিতে যে পরিমাণ ক্যাফেইন থাকে তা পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য স্বাভাবিক হলেও শিশুদের জন্য ক্ষতিকর।
অন্যদিকে, কোলাজাতীয় পানীয়তে চায়ের চেয়ে ১২-২০ গুণেরও বেশি ক্যাফেইন থাকে। অজ্ঞতার কারণে এমনটা হয়ে থাকে যে- শিশুদের আমরা চা না-দিয়ে পানীয় কিনে দেই। যা শিশুর জন্য বেশি ক্ষতিকর হতে পারে।
পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাম্প্রতিক পরীক্ষায় দেশের এনার্জি ড্রিংকসগুলোতে অতিরিক্ত মাত্রার ক্যাফেইনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অতিরিক্ত পরিমাণ ক্যাফেইন কিডনির মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। গর্ভবতী মায়ের শিশুটি বিকলাঙ্গ, অস্বাভাবিক হতে পারে। তাই আমি মনে করি আমাদের দেশে গর্ভবতী মায়েদের কফি খাওয়া থেকেই বিরত থাকা উচিৎ, এসব পানীয় তো কিছুতেই নয়।
ছোট নেশা থেকে বড় নেশায় আসক্তি
ক্যাফেইনের উপস্থিতি নিদ্রাভাব দূর ও অতি সাময়িক স্নায়ুকে উদ্দীপ্ত করলেও তা আসলে শরীরের ক্ষতিই করে।
কৃত্রিমভাবে স্নায়ুকে উদ্দীপ্ত করার ফলে তা স্নায়ুর স্বাভাবিক তাড়না বাধাগ্রস্ত করে। ফলে ব্যবহারকারী এর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। এভাবে ড্রিংকস মানুষকে নেশার দিকে ধাবিত করে। আমার আশঙ্কা, নিয়মিত এনার্জি ড্রিংকস গ্রহণকারীরা একসময় প্যাথেডিন, ফেন্সিডিল, কোকেন বা হেরোইনের মতো নেশাদ্রব্য গ্রহণ করবে। অর্থাৎ ছোট থেকে বড় নেশার পথে ধাবিত হবে।
ড্রিংকসে সিলডেনাফিলের সঙ্গে টাডালাফিল নামক পদার্থও ব্যবহৃত হতে পারে, যা সমান ক্ষতিকর।
আছে যৌনক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি
সিলডেনাফিলজাতীয় যৌন উত্তেজক পদার্থ যারা ব্যবহার করছে তাদের জন্য সতর্কবাণী হল- সাময়িকভাবে তৃপ্তি পেলেও কিছুদিন ব্যবহারের ফলে যৌন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এটা ছাড়া আর উত্তেজনা হবে না। ফলে ক্রমাগত এতে আরো বেশি আসক্ত হয়ে পড়বে, যা ধীরে ধীরে ব্যবহারকারীকে পুরুষত্বহীনতার দিকে নিয়ে যাবে। এ বার্তাটি তরুণপ্রজন্মের কাছে জোরেশোরে পৌঁছানো দরকার।
ক্ষতিকর পানীয়ের উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করতে হবে
সাম্প্রতিক পরীক্ষায় এনার্জি ড্রিংকসে ক্যাফেইন ছাড়াও যৌন উত্তেজক পদার্থ সিলডেনাফিলসহ আরো কিছু ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে। যেটা আমাদের জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক উদ্বেগের কারণ। তাই আমাদের জনস্বাস্থ্য ও তরুণপ্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে কোনো রকমের কালক্ষেপণ না করে অবিলম্বে এসব ক্ষতিকর পানীয় বন্ধ এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। বর্তমান সরকার জনস্বাস্থ্যগত বিষয়ে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ব্যাপারেও আমরা সরকারের কাছে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।
এনার্জি ড্রিংকসে অ্যালকোহল
এনার্জি ড্রিংকসের মধ্যে অ্যালকোহল থাকতেও পারে। অ্যালকোহলসহ কোনো পণ্য বাজারে ছাড়া যাবে না, আমি সেটা বলছি না। বাজারে যদি অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়ের চাহিদা থাকে তা বিক্রি করা যেতে পারে। কিন্তু অ্যালকোহলের পরিমাণ মোড়কে লিখে দিতে হবে। অ্যালকোহলমুক্ত এ কথা লিখে বিক্রি করা যাবে না।
ফলে যারা খাবে তারা জেনেশুনে খাবে। আরেকটি হল সরকার রাজস্ব পাবে। আমার ধারণা এ খাতে সরকার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। আমাদের সন্দেহ বাজারের পানীয়তে অ্যালকোহল আছে। সেটা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া দরকার।
এ বিষয়টিতে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর আরো সক্রিয় হওয়া জরুরি।
ঘটছে সামাজিক অবক্ষয়
বাংলাদেশে হঠাৎ করে ধর্ষণসহ নারী নিপীড়নের হার বেড়ে গেছে। এদিকে এনার্জি ড্রিংকসে সিলডেনাফিলের মতো যৌন উত্তেজক পদার্থের উপস্থিতির কথা জানা গেছে। এছাড়া, কিছু ইউনানী-আয়ুর্বেদিক কোম্পানি সিলডেনাফিল দিয়ে কিছু ওষুধ বাজারজাত করছে বলে অভিযোগ এসেছে। সাম্প্রতিক ধর্ষণের মত অপরাধ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সিলডেনাফিলযুক্ত পানীয়ের একটা যোগসূত্র থাকতে পারে।
কঠোর পদক্ষেপ না নিলে এ ধরনের অপরাধ, অবক্ষয়, নৈতিক বিচ্যূতির ঘটনা ঘটতেই থাকবে। যা জাতিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে। তাই সরকারের উচিৎ জনস্বার্থে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা।
খাদ্য ও ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন একক কর্তৃপক্ষ
খাদ্য ও ওষুধের মান দেখভালে কার্যকর ও উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে নেই। আমেরিকা থেকে শুরু করে সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান সব দেশে ওষুধ, খাদ্য, প্রসাধনী, গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য রাসায়নিক একটিমাত্র কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়।
কারণ, এগুলো আন্তঃসম্পর্কিত, পরীক্ষার পদ্ধতি একই এবং একই ল্যাবরেটরি, যন্ত্রপাতি ও জনবল দ্বারা নিয়ন্ত্রণযোগ্য। তাই আমেরিকার যেমন এফডিএ (খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন) রয়েছে, তেমনি আমাদেরও একটি প্রতিষ্ঠান দরকার। বহুদিন ধরে বলার পরও কোনো সরকারই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়নি। জনস্বার্থে এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় একক কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য অতীব জরুরি।
জনসচেতনতা সৃষ্টিতে চাই গণমাধ্যমের অগ্রণী ভূমিকা
এ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যম অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
১৯৩৮ সালের আগে আমেরিকাতেও আমাদের দেশের মতোই অবস্থা ছিল। খাদ্য ও ওষুধে ভেজাল ছিল মারাত্মক। ১৯৩৮ সালে আমেরিকার কংগ্রেসে এফডিএ অ্যাক্ট অনুমোদিত হয়। এর পেছনে মূল ভূমিকাটা ছিল মিডিয়ার। খাদ্য ও ওষুধে ভেজালের কারণে গোটা আমরিকায় কোথায় কী অঘটন ঘটছে মিডিয়া সেটাই তুলে ধরেছিল।
এতে জনগণ সচেতন হয়ে উঠল এবং জোর দাবি উঠল কঠোর আইন প্রণয়নের। তারপর থেকে অবস্থা পাল্টাতে থাকে। আজকে আমেরিকাতে সবকিছু কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রিত। আমাদের দেশেও মিডিয়া একই ভূমিকা রাখতে পারে। এ আন্দোলনের সহযোগী শক্তি হিসেবে মিডিয়াকে আমরা অগ্রণী ভূমিকায় দেখতে চাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।