পশ্চিমবঙ্গই পঞ্চায়েতে দেশের সামনে মডেল : জ্যোতি বসু
পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতই গোটা দেশের সামনে মডেল। প্রবীণ জননেতা জ্যোতি বসু একথা বলেছেন। রাজ্যে সপ্তম পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে গণশক্তিকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে জ্যোতি বসু বলেন, এটা অনেকেরই মনে নেই যে আমাদের রাজ্যে পঞ্চায়েত দেখেই সারা দেশে পঞ্চায়েত চালু করার জন্য আইন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। রাজীব গান্ধী তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। উনি নিজেই সেকথা বলেছিলেন।
আমাদের পঞ্চায়েতই দেশে মডেল, এটা আমাদের গর্ব। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন অজয় দাশগুপ্ত
এবারের নির্বাচনে বিশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্যোতি বসু বলেন, শুনছি, আমাদের বিরুদ্ধে সবাই নাকি একজোট হয়েছে - চরম দক্ষিণপন্হী সব শক্তি, তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে নিজেদের বামপন্হী বলে দাবি করে একটা দল। আর অস্ত্র নিয়ে যারা আমাদের পার্টিনেতা-কর্মীদের খুন করছে, তারা ওদের সাহায্য করছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চেতনার ওপর আমার পূর্ণ আস্হা আছে। তাঁরা নিশ্চয়ই কোনো সুবিধাবাদী জোট বা সুবিধাবাদী দলকে ভোট দেবেন না।
আমি বিশ্বাস করি, এরাজ্যের গ্রামের মানুষ প্রতিবারের মতো এবারেও পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্টকেই বিপুলভাবে জয়ী করবেন।
প্রশ্ন: আগামী ১১ই মে রাজ্যে সপ্তম পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রথম দফা ভোটগ্রহণ হতে চলেছে। প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই ১৯৭৮ সালে রাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতীব্যবস্থা চালু হয়, আপনি তখন মুখ্যমন্ত্রী। কোন্ প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতীব্যবস্থাকে সজীব ও সক্রিয় করার এই উদ্যোগ আপনারা নিলেন?
জ্যোতি বসু: কংগ্রেস আমলে একটা পঞ্চায়েত আইন ছিল, কিন্তু তার কোনও ক্ষমতা ছিল না। অল্পস্বল্প কিছু ছিল, তবে কোনও কাজ হতো না।
তাতেও দীর্ঘদিন কোনও নির্বাচন হয়নি। জোতদার-জমিদারদের হাতেই ছিল পঞ্চায়েত। আমরা চেয়েছিলাম গ্রামের গরিব মানুষ, ছোট ও মাঝারি কৃষক, ভূমিহীন ক্ষেতমজুর, ভাগচাষী- তাদের স্বার্থে কাজ হোক, তাদের উন্নতি হোক। আর প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ আমরা চেয়েছিলাম। তাই ১৯৭৭ সালের ২১ শে জুন প্রথম বামফ্রন্ট সরকার শপথ গ্রহণ করার পরই আমরা বলেছিলাম, আমাদের সরকার শুধু মহাকরণ থেকে চলবে না।
আমরা সেটা করেছি। এখন গ্রামের গরিব মানুষের হাতেই পঞ্চায়েতের ক্ষমতা।
প্রশ্ন: ত্রিস্তর পঞ্চায়েতীব্যবস্থা চালু করতে গিয়ে আপনাদের যে নানাভাবে বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, আজকের প্রজন্মের অনেকেই হয়তো তা জানেন না। সেই অভিজ্ঞতার কথা যদি বলেন।
জ্যোতি বসু: আমরা পঞ্চায়েতে যে নতুন আইন করলাম, তাতে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হলো।
আমরা চেয়েছিলাম বামফ্রন্ট সরকারের জনমুখী কর্মসূচীগুলো গ্রামে পঞ্চায়েতের মাধ্যমেই রূপায়িত হোক। শুধু তাই নয়, আমরাই দেশের মধ্যে প্রথম ১৮ বছর বয়সীদের ভোটাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, পঞ্চায়েতে এবং পৌরসভায়। কিন্তু কংগ্রেস, জনতা পার্টির পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হলো। তখন কংগ্রেসের নেতা ছিলেন অজিত পাঁজা। বিরোধীরা আদালতে মামলা করলন।
যাইহোক, সেই মামলা আমরা জিতেছিলাম।
প্রশ্ন: মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণও তো আমাদের রাজ্যেই প্রথম হয়।
জ্যোতি বসু: হ্যাঁ , মহিলাদের জন্য পঞ্চায়েত এবং পৌরসভায় এক তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ আমরাই প্রথম করি। লোকসভা ও বিধানসভাতেও যাতে এই সংরক্ষণ করা হয়, তারজন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি। বামপন্হীদের পক্ষ থেকে ইউ পি এ সরকারকেও বারবার বলছি।
সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচীতেও এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। যাইহোক, আশার কথা যে রাজ্যসভায় এই বিল পেশ হয়েছে। আমরা যখন মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ করি, তখন অনেকেরই সন্দেহ ছিল যে এত প্রার্থী পাওয়া যাবে কিনা। প্রার্থী পাওয়া গেলো শুধু তাই নয়, আমরা পরে যা রিপোর্ট পেলাম তা খুবই প্রশংসনীয়। মহিলারা ঘরের কাজও করছে, আবার পঞ্চায়েত অফিসেও যাচ্ছে।
তাছাড়া আমরা যে স্বনির্ভর গোষ্ঠী করেছি তার অধিকাংশই মহিলা। আমাদের মন্ত্রীর কাছে শুনলাম, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠনে আমরা এখন দেশে দ্বিতীয়। এখানে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে যুক্ত হয়েছেন ৭০ লক্ষের বেশি মহিলা। এটা একটা বিরাট সাফল্য। আর তফসিলী জাতি, তফসিলী উপজাতিদের জন্য আসন সংরক্ষণও আমরাই প্রথম করেছি।
পরে সারা দেশে হয়েছে।
প্রশ্ন: ১৯৭৮ সালে প্রথম পঞ্চায়েতের পর প্রায় ৩০ বছর হয়ে গেলো। আপনার মতে এই সময়ে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতীব্যবস্হায় প্রধান সাফল্যগুলো কি কি।
জ্যোতি বসু: ১৯৭৮ সালে প্রথম পঞ্চায়েত গঠনের পরই আমাদের বিধ্বংসী বন্যাি মোকাবিলা করতে হয়। ত্রাণ ও পুনর্গঠনে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে তখন যে অসাধারণ কাজ হয়েছিল, তাতেই মানুষ বুঝেছিলেন এই ব্যবস্হা আমাদের প্রয়োজন।
তখনই শুরু হয় জমি বিলি, অপারেশন বর্গা ইত্যাহদির কাজ। শুনছি, অনেকে এখন নাকি বলছে, বামফ্রন্ট সরকার কৃষকের জমি কেড়ে নিচ্ছে। এসব কথা মানুষ কখনও বিশ্বাস করবেন না। এরাজ্যে গ্রামের লক্ষ লক্ষ ভূমিহীন গরিব মানুষকে আমরাই জমি দিয়েছি । এরাজ্যে এখনও ১১ লক্ষ একর জমি বিলি হয়েছে, এখনও বিলির কাজ চলছে।
জমি পেয়েছেন ২৯ লক্ষ ৮১ হাজার ভূমিহীন কৃষক। সারা দেশে জমি বিলির ২২ শতাংশ, উপকৃতের ৫৪ শতাংশই এরাজ্যে। কংগ্রেস সেই সময় বাধা দিয়েছিল, অনেক মামলাও করেছিল। কিন্তু আমরা মাথা নিচু করিনি । অপারেশন বর্গার মাধ্যমে বর্গাদারদের নাম নথিভুক্ত করে তাঁদের জীবিকার নিরাপত্তাও দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন: গ্রামের গরিব মানুষের হাতে ক্ষমতা পৌঁছে দেওয়ার মতো কঠিন কাজও আপনাদের করতে হলো।
জ্যোতি বসু: হ্যাঁ । ১৯৭৭ সালে প্রথম দিন মহাকরণে এসেই আমরা ঘোষণা করেছিলাম, শুধু মহাকরণ থেকে এই বামফ্রন্ট সরকার চলবে না। আমরা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করবো। পঞ্চায়েত এবং পৌরসভার মাধ্যমে সেই কাজও করা হয়েছে।
আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে আমরা গ্রামের গরিব মানুষের হাতে ক্ষমতা পৌঁছে দিয়েছি। প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের সময়েই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম রাজ্য সরকারের পরিকল্পনাখাতে ব্যয়ের ৫০ শতাংশ পঞ্চায়েত ও পৌরসভার মাধ্যমে খরচ করা হবে। কিছুদিন আগে আমাদের অর্থমন্ত্রীকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সেটা এখনও চলছে। কৃষিতেও আমরা অনেক সাফল্য পেয়েছি, খাদ্যে স্বনির্ভর হয়েছি। কিন্তু আমাদের কৃষির আরো সম্ভাবনা আছে।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্য নিয়ে আমাদের কৃষির মান আরো উন্নত করতে হবে। কৃষিতে আমরা প্রথম হয়েছি । শিল্পেও আমাদের এগোতে হবে। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার সেই লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে । রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন আমাদের এই কাজ দেখে প্রশংসা করেছিলেন এবং সারা দেশে পশ্চিমবঙ্গকেই মডেল বলেছিলেন।
প্রশ্ন: এরাজ্যের পঞ্চায়েতকে অনুকরণ করেই তো কেন্দ্রীয় আইন তৈরি হলো?
জ্যোতি বসু: হ্যাঁ । রাজীব গান্ধী পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটা মিটিং ডেকেছিলেন সল্টলেকে। সেখানে উনি অফিসারদের বললেন, পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতে সবচেয়ে ভালো কাজ হয়েছে। এটা দেখে আপনারা একটা কেন্দ্রীয় আইন করুন। আমিও ছিলাম সেই মিটিং-এ।
আমি রাজীব গান্ধীকে বললাম, আপনার দলেরও তো সরকার রয়েছে অনেক রাজ্যে, কংগ্রেসের সরকার। সেসব জায়গায় আপনারা পঞ্চায়েত করছেন না কেন? উনি আমাকে বললেন, আমাদের দলকে তো জানেন, ওরা এমনিতে করবে না, বাধ্য করতে হবে। তাই আমি একটা কেন্দ্রীয় আইন করার কথা ভাবছি। যাইহোক, আমি শুনলাম রাজীবের স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী আমাদের বিরুদ্ধে প্রচারে এসেছিলেন কিছুদিন আগে। উনি বোধহয় জানেন না ওঁর স্বামী আমাদের পঞ্চায়েত দেখে কি বলেছিলেন।
ওঁকে এখানকার কংগ্রেস নেতারা বোধহয় তা বলেননি।
প্রশ্ন: এবারের নির্বাচনে তো বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে মহাজোট হয়েছে। এসম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
জ্যোতি বসু: এবার চরম দক্ষিণপন্হী শক্তির সঙ্গে যারা নিজেদের বামপন্হী বলে, তারাও আমাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে। আর অস্ত্র নিয়ে যারা আমাদের পার্টির নেতা-কর্মীদের খুন করছে, তারা এদের সাহায্য করছে। আর অত্যন্ত দূর্ভাগ্যজনক যে কংগ্রেসও খোলাখুলি বলছে এদের ভোট দিতে।
এমন একটা জোট, যার কোনও নীতি-নৈতিকতা নেই, কোনও কর্মসূচী নেই, খালি বামফ্রন্ট এবং বিশেষকরে সি পি আই (এম) বিরোধিতাই যার একমাত্র লক্ষ্য। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চেতনা আছে, তাঁরা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে উপলব্ধি করেছেন কে শত্রু, কে মিত্র। আমার বিশ্বাস আছে, রাজ্যের মানুষ কখনই কোনও সুবিধাবাদী জোট বা সুবিধাবাদী দলকে ভোট দেবেন না। তাঁরা প্রতিবারের মতো সপ্তম পঞ্চায়েত নির্বাচনেও বামফ্রন্টকেই বিপুলভাবে জয়ী করবেন।
প্রশ্ন: নন্দীগ্রামকে ঘিরে তো আবার উত্তেজনা শুরু হয়েছে।
জ্যোতি বসু: হ্যাঁ , নন্দীগ্রামে ওরা আবার গোলমাল শুরু করেছে। আর অস্ত্র নিয়ে যারা আমাদের পার্টিনেতা-কর্মীদের খুন করছে, তারা ওদের সাহায্য করছে। যাইহোক, আমার কথা হলো,নন্দীগ্রামসহ রাজ্যের সর্বত্র শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হোক, আমরা সেটা চাই। ওরা অশান্তি করার চেষ্টা করছে, তাই আমাদের কর্মীদের সতর্ক থাকতে হবে। সাবধানতা অবলম্বন করে মানুষ যাতে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে পারেন তৎপর হয়ে তার ব্যবস্হা করতে হবে।
প্রশ্ন: কিন্তু বামফ্রন্টেরও তো সব জায়গায় ঐক্য হয়নি?
জ্যোতি বসু: হ্যাঁ , সেটা নিয়েই আমি একটু চিন্তিত। গতবারও আমাদের সব জায়গায় ঐক্য হয়নি। আর এস পি-র সঙ্গে কিছু জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। এবারেও আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে ইশতেহার প্রকাশ করেছি। আমরা চেষ্টা করছি যতখানি সম্ভব বেশি আসনে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে।
আমাদের পার্টির কথা বলতে পারি, আমরা আগেও ত্যারগ স্বীকার করেছি, এখনও রাজি আছি। আমরা এবারেও অনেক আসন ছেড়ে ঐক্য করার চেষ্টা করেছি। আমার কথা হলো, আমরা এরাজ্যে বামফ্রন্টের যে নজির সৃষ্টি করেছি, তার উদাহরণ গোটা দেশে কোথাও নেই। একে রক্ষা করতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।