জনসেবার ভূত জীবনে কখনো মাথায় চাপেনি এইরকম লোক মনে হয় কমই আছে। সমস্যা হচ্ছে ভূতগুলা বেশীদিন মাথায় থাকেনা। সবাই মাদার তেরেসা না, এমনকি কেউ কেউ ও মাদার তেরেসা না, খুবই অল্প কেউও না, একেবারে পৃথিবীর বিলিয়নকে বিলিয়ন লোকের মধ্যে হাতে গোনা দুই একজন হয়তো। বাকিরা সবাই আমার মতোই। মাঝে মাঝে বাথরুম চাপার মতো জনসেবার তীব্র বেগ চাপে।
আবার দ্রুত সেটা কমেও যায়। সেরকমই ভূত আমার মধ্যেও চেপেছিল একবার। খুলে বলি।
সদ্য বিদেশ আগমন, সদ্য হাফসোল খাওয়া, এবং সদ্য টাকার বদলে মাসে মাসে ডলার হাতে পাওয়া এই তিনটির যে কোন একটিতেই মানুষ জনসেবক হয়ে যেতে পারে। আমার একবার তিনটা এক সাথেই হল।
তখন সদ্য আমেরিকা এসেছি। তাই দেশপ্রেম আচমকা বেড়ে একেবারে তুঙ্গে। আসার আগে ভালো করে একখানা হাফসোল খেয়ে এসেছি। তাই তীব্র ভালবাসা রাখার কোন পাত্র খুঁজে না পেয়ে পুরো দেশকেই একেবারে ভালোবেসে ফেললাম। স্কলারশিপের যা অর্থ পেতাম সেটা পরিমাণে খুবই স্বল্প হলেও সেটাকে ৭০ দিয়ে গুন দিতে পেরে ভালো লাগতো, মনে হতো অনেক টাকা।
এরই মাঝে পত্র পত্রিকায় দেশে মঙ্গার খবর শুনে মাথা আউলায়ে গেল। উত্তরবঙ্গের মানুষ কচুরিপানা খাচ্ছে, ভাত খেতে না পেয়ে কিশোরী মেয়ে অভিমানে আত্মহত্যা করছে এসব খবর শুনে দেশের প্রতি দরদ উথলে উঠলো। আবেগটুকু নিখাদ ছিল পেটে হাত দিয়ে বলতে পারি (বুকের চেয়ে ওটাই বেশী প্রিয় অঙ্গ আমার) , তবে স্থায়িত্ব বেশী ছিলনা। আমি স্বার্থপর মানুষ। এরকম আবেগ চাপলে সাধারণত কিছু অর্থ দান করে তৃপ্তির ঢেঁকুর ফেলি।
কিছু টাকার বিনিময়ে মহৎ হবার যে অনুভূতিটুকু পাওয়া যায় সেটা বিবেচনা করে টাকার দুঃখ হয়না। কিন্তু সেবার তিন সদ্যের অনুরণনে আবেগখানা একটু বেশীই চেপে গেল। প্রথমে মনে হল যুদ্ধ করে দেশটাকে স্বাধীন করে ফেলি। মাথা ঠাণ্ডা হলে মনে পড়ল সেটা আমার জন্মের আগেই হয়ে গেছে। তখন মনে হল দেশের সব মানুষের দারিদ্র্য দূর করে ফেলবো।
আর মাথা চুলকে মনে হল সেই কাজটিও ইতোমধ্যে ডক্টর ইউনুস করে ফেলেছেন। বিনিময়ে নোবেলও পেয়ে গেছেন। সবশেষে মনে হল, সব মানুষের না হলে কিছু মানুষের অন্তত কিছু একটা করার চেষ্টা করি। শুরু হল আমার জনসেবামূলক কার্যক্রম।
তখনও ফেসবুকের জন্ম হয়নি।
জুকারবার্গ নিজেই বিশাল একখানা হাফসোল খেয়ে খাবি খাচ্ছে। সে দুষ্টু লোক তাই এক নারীকে ধরতে না পেরে দুনিয়ার নারী ধরার সবচেয়ে বড় জাল যাকে আমরা পরবর্তীতে ফেসবুক নামে চিনব সেটি একটু একটু করে বুনছে। আমি মহৎ লোক তাই হাফসোল খেয়ে জগতের সকল নারীর প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে মানব কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছি। ফেসবুক না থাকায় তখন ইয়াহু গ্রুপ খুলে ফেললাম। এরপর শুরু হল মানুষ ধরা।
স্বভাবতই বন্ধুরা অনেকে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল। নতুন মুসুল্লির যেমন ঈমানের তেজে পাবলিক একটু ভয় খেয়ে যায় তেমনি নতুন সমাজসেবী অথবা দেশপ্রেমিকদেরকেও সবাই এড়িয়ে চলে।
আমাদের আম্রিকান মহল্লার এক ছোকরা একবার করে বিরাট হুজুর হয়ে গেল। দুই সপ্তাহে এক সাঈদ আনোয়ার পরিমাণে দাড়ি গজিয়ে ফেলল। আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, তোমারে তো বেশ মাকুন্দা বলেই জানতাম, এত দ্রুত ক্যামনে কি? নতুন হুজুররা অমায়িক হয়।
মান অপমান গায়ে মাখে না। অমায়িক হাসি দিয়ে বলল, সবই তার ইচ্ছা। দুইদিন আগে যেই ছেলে বাড়িতে ডিস্কো লাইট লাগিয়ে নাচত (তাও আবার একা একা না) সে ইংরেজি ছবিতে হালকা চুম্বন দৃশ্য দেখে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে ইন্নালিল্লাহে পড়ে। সে যাই হোক, সেই ছোকরাকে তাবলীগের দাওয়াত পাবার ভয়ে সবাই এড়িয়ে চলে। সেই ছোকরা একদিন সাথে ফিনফিনে দাড়ির এক পাকিকে সাথে নিয়ে আমার উপর হামলা করলো।
আমাকে আটলান্টায় নিয়ে যেতে চায়, এক মিনি চিল্লায়। এক সপ্তাহ ঐখানে গিয়ে ধর্ম আলোচনা হবে, সাথে বিস্তর খানাদানা ফ্রি। পাকি এসে আমার হাত ধরে বলে, ভাই কি আছে দুনিয়ায়। আমি দুনিয়াতে অনেক কিছুই আছে, সানি লিওন আছে, পুনম পাণ্ডে আছে, এমনকি জাস্টিন বিবারও আছে - এই বলে চোখ টিপ দেই। সে যাই হোক, আবারও কোন থেকে কোন কোথায় চলে আসলাম।
সেই পাকি আমাকে শোধনের অযোগ্য মনে করে আমাকে ফেলে আটলান্টা চলে গেল। আমিও বরং চিল্লার গল্প ফেলে রেখে জনসেবার গল্পে ফিরে আসি।
তো জনসেবার ভূত চাপার পর ওই তাবলীগের দাওয়াত দেয়ে হুজুরের মতো করেই লোকজন জনসেবার দাওয়াত পাবার ভয়ে আমাকেও এড়িয়ে চলতে লাগলো। রাস্তাঘাটে মানুষের সাথে দেখা হলে তারা চোখ নামিয়ে না দেখার ভান করে। কখন আবার চান্দা চেয়ে বসি এই ভয়ে।
কয়েকজনকে নিয়ে এরপর আমাদের ছোট শহরে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করলাম। উদ্দেশ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সবাইকে আমাদের জনসেবামূলক কার্যক্রম সম্পর্কে জানানো ও চান্দা তোলা। এখানের লোকজন বেশ দানশীল। কয়দিন আগে পাকিস্তানের ভূমিকম্প হবার পর মসজিদে ইমাম সাহেব সাহায্যের আবেদন জানানো মাত্র পনের বিশ মিনিটে ত্রিশ চল্লিশ হাজার ডলার উঠে গেল। আমার পরিচিত এক বাঙ্গালী ভদ্রলোকই পাঁচ হাজার দিলেন।
সে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। খালি পেটে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ভালো লাগেনা বলে আমরা হালকা খাওয়া দাওয়ারও আয়োজন করেছিলাম। ফ্রাইড রাইস আর KFC এর ফ্রাইড চিকেন। সাথে যারা হালাল চিকেন ছাড়া খেতে চায়না তাদের জন্য ঘরে বানানো ফ্রাইড চিকেন। সবাই এসে দেখি হালাল চিকেন এর খোঁজ করে।
চোখের নিমিষে লোকজন হালাল চিকেন শেষ করে। যারা পেলোনা তারা মন খারাপ করে হারাম চিকেন এর প্যাক বাসায় নিয়ে গেল। যাহোক লোকজন মুরগীর ঠ্যাঙ চিবুতে চিবুতে দীপালির গল্প শুনল। দীপালি সেই মেয়ে যে আর তার ছোটভাই পালা করে ভাত খেত। একেকজন একেক বেলায়।
দীপালি সেই মেয়ে যে দুপুরে বাসায় এসে তার ভাত ছোটভাই খেয়ে ফেলেছে শুনে অভিমানে আত্মহত্যা করে। দীপালি গল্প, মঙ্গার গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে চলল রবীন্দ্রসঙ্গীত। আমরা ঘন্টাখানেক একঘণ্টা প্যাঁ পো করে হারমোনিয়াম বাজিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে, আবৃত্তি আর নাটক করে গোটা চল্লিশেক লোকের কাছ থেকে চান্দা উঠালাম দুইশ আশি ডলার। তার মধ্যে আড়াইশো আমার তিন রুমমেট এর কাছ থেকে জোরপূর্বক আদায়। বাকি ত্রিশ ডলার অন্যান্য।
আমাদের অনুষ্ঠানের খরচ ছিল তিনশ ডলার। সুতরাং লাভের পরিমাণ মাইনাস বিশ ডলার।
ফলাফল গুরুতর শিক্ষালাভ। মসজিদের মাইক আর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার মাইক এক জিনিস না। প্রথমটা দিয়ে হাঁক দিয়ে স্বর্গের টিকেট দেখিয়ে লাখ লাখ ডলার চান্দা উঠানো থেকে শুরু করে মানুষ খুন করানো পর্যন্ত সম্ভব অনায়াসে।
দ্বিতীয়টায় চার আনা আটআনা টাইপের কিছু ভিক্ষা মিলতে পারে বড়োজোর। ঠিক যেমন আমি জ্ঞান বিতরণ করলে বড় সত্য কথা বলেছেন মাইরি বলে আহা উঁহু প্রশংসা করবে লোকে। কিন্তু আমার ডাকে আন্দোলনে বেড়িয়ে পরবে না। তবে বাঁশের কেল্লার ডাকে দুই চারটা জবাই টবাই করে ফেলা অনায়াসে সম্ভব। আমি মুগ্ধ হয়ে মাঝেমাঝে আমার জ্ঞানী বন্ধুদের আলোচনা শুনি।
কে কোরআনের কোন সুরার বাজে ব্যাখ্যা করেছে, আমাদের নবীকে নিয়ে কে বাজে কথা বলেছে সেটা বলতে বলতে উত্তেজনায় তাদের হাত আপনাআপনি মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়, মাথার দুপাশের শিরা দপদপ করতে থাকে, কেউ কেউ আবেগে কেঁদে ফেলে। অথচ আমি এখন পর্যন্ত এক বালকের পুড়ে কিমা হয়ে যাওয়া দেহ দেখে কাউকে কাঁদতে দেখিনি। মাইক হাতে নিয়ে আজকে যদি পনের বছরের ঝলসানো বালকের কথা বলি, তবে কেউ আমার ডাকে বের হয়ে আসবে না। উল্টোদিক থেকে মাইক হাতে ধরে বিশ্বজিৎ এর কথা বলবে, ফেলানির কথা বলবে, বলতেই থাকবে বলতেই থাকবে। অথচ মাইক হাতে নিয়ে যদি কেউ ডাক দেয় আমাদের নবীর অবমাননা করা হয়েছে তাহলে শতসহস্র ক্রোধান্মত্ত মানুষ বের হয়ে আসবে।
কেউ বলবেনা ওই যে রামকে নিয়ে যে বাজে কথা বলা হল, ঐযে বৌদ্ধ বিহারের অপমান করা হল। বছরখানেক আগে কিলিং মিলনের ভিডিওটি দেখে বাথরুমে দাড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম, এতদিন পর পনের বছরের বালকের ঝলসানো শরীর দেখে শাওয়ারে দাড়িয়ে কাঁদি। বালকের জন্য না, অন্ধ মানুষদের জন্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।