আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রুপান্তর



ভ্যাপসা গরম, তাতে আবার সস্তা ফোমের ছিট। কিন্তু কোন উপায় নেই, টাকা বাচাতে হলে এই বাসেই আমাকে যেতে হবে। বাসের ছিট গুলো সব বুকড হয়ে গেছে , এখন যেসব যাত্রী উঠছে তারা সব দাঁড়িয়ে আছে । কিছুক্ষন পর দাঁড়ানো যাত্রী গুলো যখন ভিড়ের ঠেলায় হাঁসফাঁস শুরু করল তখন বাস গড়ানো শুরু করল। জানালার পাসের ছিটে আমার পা আটেনি তাই একরকম বাধ্য হয়েই করিডরের ছিটে বসেছি।

হঠাত খেয়াল করলাম আমার পাশে একজন ভদ্র মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। প্রচন্ড ভিড়ের কারনে রড ধরে থাকা সত্ত্বেও আমার দিকে ঝুকে আসছে । পোশাক আশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে আমাদের মত মধ্যবিত্ত, হয়ত কোন অফিসের ২য় শ্রেণীর কর্মচারী। তার এই কষ্ট দেখে আমার খুব খারাপ লাগল। ভাবলাম ছিট টা ছেড়েই দেই।

এখান থেকে নিউমার্কেট মাত্র তো ১ ঘন্টার পথ, কষ্ট করে না হয় একটু দাঁড়িয়েই গেলাম। কিন্তু আজ আমি এই ছিটটা নেওয়ার জন্য সেই সকাল আটটা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এত কষ্টের ছিট কিভাবে ছাড়ি! - আরে জীবনে তো আমি অনেক ছিট ছেড়েছি। রাজশাহী থেকে কুষ্টিয়া যাওয়ার পথে প্রায়ই মুরুব্বী অথবা মহিলা দেখে ছিট ছেড়ে দিয়ে নিজে ৩ ঘন্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করেছি। গ্রাম থেকে কুষ্টিয়া যাওয়ার পথে তো প্রায় প্রত্যেক দিনই মহিলা অথবা মুরুব্বী দেখে ছিট ছেড়ে দিয়েছি।

এই সেদিনও ঢাকা থেকে পাটুরিয়া যাওয়ার পথে এক আন্টিকে ছিট ছেড়ে দিয়ে ৩ ঘন্টার পথ রড ধরে ঝুলতে ঝুলতে গিয়েছি। - কিন্তু তাতে লাভটা হয়েছে কি? আমি ছিট ছেড়ে দেওয়ার পরেও তো দেখেছি অনেক মুরুব্বী এবং মহিলা দাঁড়িয়ে থাকে। এত সামর্থ্যবান মানুষ বসে থাকা সত্ত্বেও কই তাদেরকে তো কেউ ছিট ছেড়ে দেয়নি। আমি শুধু শুধু বোকার মত পাশের যাত্রীর ‘পাগল নাকি ’ টাইপের কটাক্ষ হাসি উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে পড়ি ! - আরে বাসে তো আরও অনেক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে, শুধু একজনকে ছিট দিয়ে কি লাভ। নাহ আমি ছিট ছাড়ছিনা।

আর দোষ তো তারও, সে ভিড় দেখে বাসে উঠল কেন! এরকম আক্কেল জ্ঞানহীন মহিলাদের ছিট দিতে নেই । বাস ছেড়ে দিয়েছে । আমি ছিট ছাড়িনি কিন্তু মনের মধ্যে খচ খচ করছে । টেকনিক্যাল চলে এসেছি । মনের মধ্যে খচখচানি এখন অনেক কম।

কিন্তু যাত্রী উঠা নামার সময় হুড়োহুড়ির কারনে মহিলার কষ্ট দেখে একটু খারাপ লাগল। তারপরও ছিট ছাড়লাম না । - আরে বাসে যেতে হলে এটুকু কষ্ট তো করতেই হবে। এতে তো খারাপ লাগার কিছু নেই । আশাকরি ভদ্রমহিলা শ্যামলি হতেই ছিট পেয়ে যাবে।

আমি আরাম করে ছিটে গা এলিয়ে দিলাম। মহিলাও একটু আরামের জন্য এক হাত দিয়ে রড আর এক হাত দিয়ে ছিট টা ধরে থাকল। মিনিট খানেক হয়ে গেল শ্যামলীতে এসেছি। বাস ছাড়ার কোন নামই নেই। চারিদিকে এত গালি গালাজ সত্ত্বেও হেল্পার যাত্রী তুলেই যাচ্ছে।

কিছু যাত্রী বাসের পেছনদিকে তাড়াহুড়ো করে আসতে যেয়ে মহিলার গায়ে ধাক্কা লাগাল । ছিটে রাখা মহিলার হাতটা ফস্কে গিয়ে আমার গায়ে লাগল। আমি খুব বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকালাম । সে থতমত খেয়ে ছিট থেকে হাত টা সরিয়ে নিয়ে আবার রড ধরল। ছিটে বসে নিজেকে কেন জানি খুব উচু শ্রেণীর মানুষ মনে হল।

- আচ্ছা , এসব মেয়েরা প্রতিদিন এভাবে বাস জার্নি করে অফিস করে খারাপ লাগেনা ! আমার পরিবারের কেউ হলে তো কবেই চাকরী ছেড়ে দিতে বলতাম। আসলে চাকরী বাকরি কিছু না , এদের প্রতিদিন ভিড় বাসে উঠে বিভিন্ন পুরুষের ধাক্কা খেতেই ভাল লাগে। নাকটা শিটকিয়ে কপালটা কুঁচকিয়ে জানালার দিকে মুখ দিলাম। কিন্তু মহিলাটার কথা মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছেনা । আড়চোখে তাকালাম।

- কি রকম বেহায়ার মত দুই হাত দিয়ে রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে ! ওকি জানেনা যে ওর ডান পাশের বুক থেকে ওড়না সরে গেছে ! আসলে জানে কিন্তু আমাদের বুক দেখানোর জন্যই এত কৌশল। ভালই যদি হত তাহলে দুই হাত দিয়ে আমার ছিটটা ধরে বুকের উপর সুন্দর করে ওড়নাটা দিত । আসাদগেট চলে এসেছি । ভিড় কমার কোন লক্ষণই নেই । এই গরমে আমার মাত্রাতিরিক্ত ঘর্মাক্ত শরীর কে গালি দিয়ে রুমাল্ টা বের করে ঘাম মুছলাম।

আবার আড় চোখে তাকালাম । - চেহেরা দেখে তো মনে হচ্ছে বয়স ৩৫-৪০ এর মধ্যে হবে । কিন্তু এই বয়সে বুকের গঠন এখনো এরকম রেখেছে কি করে! নিশ্চয় ভিতরে অনেক টাইট ব্রা পরেছে। অফিসে যেয়ে এই বুক বস কে দেখাবে , কলিগদের দেখাবে । নাহ, এদের চরিত্রের কোন ঠিক নেই ।

আচ্ছা আমার মোবাইল নাম্বারটা কি হাতে গুজে দেব! সঙ্গে লিখে দেই তোমার যদি কখনো একা লাগে অথবা সুড় সুড় করে আমাকে ফোন দিও । - ছি! ছি! আমি একজন ভদ্র মহিলা সম্পর্কে এ কি ধরনের চিন্তা করছি! হে আল্লাহ্‌ ! আমাকে ক্ষমা করে দিও । - আচ্ছা এখানে দোষের কি! আমি তো শুধু চিন্তা করছি, শারীরিক ভাবে তো কিছু করছিনা । আরে আমার কিছু বন্ধুরা তো বাসের ভিড়ে উঠে মেয়েদের পাছায় হাত দেয় , বুকে হাতের কনুই লাগায়। আর আমি তো শুধু চিন্তা করছি।

সেই তুলনায় তো আমি অনেক ভাল। - আরে আমি তো ইচ্ছা করলেই এই মহিলার শরীর স্পর্শ করতে পারি ! কোন ব্যাপারই না । বাস তো এদিক ওদিক দুলছেই । একটু ব্রেক কষলেই মাথাটা জোরে নিয়ে যেয়ে মহিলার বুকে ঠেকালাম ! ভাবতেই শরীরে শিহরণ খেলে গেল। কপাল আরও জোরে ঘামতে লাগল।

নিজের ভিতর যৌনতার তাড়না অনুভব করলাম। নিজেকে প্রস্তুত করলাম স্পর্শের জন্য। এখন শুধু ব্রেক কষলেই হল। সামনেই তো কলাবাগান, ওখানে তো ব্রেক কষবেই। কলাবাগান চলে এসেছি।

শেষ মুহূর্তে কেন যে নিজেকে ধরে রাখলাম জানিনা । মহিলা কলাবাগানেই নেমে পড়ল। আমার এই অপরাগতায় নিজেকেই কাপুরুষ বলে গালি দিলাম। রাগে চুল ছিড়তে ইচ্ছা করছে । বাসের প্রতিটা মেয়ের প্রতি একধরনের অন্ধ আক্রোশ জন্মাল ।

- মহিলা ছিটে যে আন্টি বোরখা পরে বসে আছে তার তো বোরখার উপর দিয়েই স্তনের সাইজ বোঝা যাচ্ছে ! এসব মহিলাদের বোরখা পরার কি দরকার ! - আর স্কার্ফ পরে দাঁড়িয়ে আছে ঐ মেয়েটা । পরেছিস তো ফাড়া জামা । তোর জামার ফাকা দিয়ে যে তোর টাইটসে জড়ানো পাছার সাইজ বোঝা যাচ্ছে তা কি জানিস না! মনে তো হচ্ছে পাছা পেতে দাঁড়িয়ে আছিস। - আর ঐ মাগীটা কিভাবে ঠোটে লিপস্টিক দিয়েছে ! মন বলছে এখনই ঠোঁট কামড়িয়ে ধরি । - বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছে যে মা টা তার ফর্সা কাঁধ ঢাকতে কি হয় ! এরা সবাই খারাপ! এমনকি ঐ ৭ম-৮ম শ্রেণীর বাচ্চা মেয়েটাও খারাপ ।

দ্যাখোগা এই বয়সেই ৩-৪ টা প্রেম করে নিজেকে পাকিয়ে ফেলেছে ! নিউমার্কেট চলে এসেছে । বাস থেকে নেমে যেদিকে তাকায় শুধু মেয়ে আর মেয়ে । সবারই কোন না কোন অঙ্গ আমাকে শিহরিত করছে । - সব বেহায়া, সব হারামি । নিষ্ফল আক্রোশে গজ গজ করতে করতে সেলুনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অভ্যাস বশত আয়নার দিকে তাকালাম ।

চমকে উঠলাম । আয়নায় এটা কার চেহারা ! মাথায় বড় বড় শিং, নাকের দুই পাশে বড় বড় লোম, কুকুরের মত শ্বদন্ত বের হয়ে আছে , বড় একটা জিহ্বা বাইরে ঝুলে পড়ে সেখান থেকে লালা ঝরছে । হাতের নখের দিকে তাকাতেই দেখলাম সেগুলো আস্তে আস্তে বড় হয়ে নেকড়ের মত হয়ে যাচ্ছে । - আরে এটা তো আমিই ! তাহলে আমার উপর শয়তান ভর করেছে ! নাহ ! শয়তান ভর করেনি আসলে আমিই শয়তান ! আমিই জানোয়ার ! আমি যখন বাসে উঠি তখন মানুষই ছিলাম কিন্তু বাসে ছিট ছেড়ে না দেওয়ার মত ছোট্ট একটা পাপ আমাকে জানোয়ারে রুপান্তরিত করেছে । আমি এখন জানোয়ার!


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.