আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফিরে দেখা : নজরুলের কিছু পরিচিত গান , পর্ব-১

কি আর হবে অঙ্গে ধরে নকল রুপের বায়না.... ও রুপ দেখে চোখ ভোলে গো, মন ভোলানো যায় না

১। চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে ছুটে তরঙ্গ বাসনা ভঙ্গ সে অঙ্গ পরশিতে। । হেরিছে রজনী__রজনী জাগিয়া চকোর উতলা চাঁদের লাগিয়া কাহাঁ পিউ কাহাঁ ডাকিছে পাপিয়া কুমুদীরে কাঁদাইতে। ।

না জানি সজনী কত সে রজনী কেঁদেছে চকোরী পাপিয়া হেরেছে শশীরে সরসী-মুকুরে ভীরু ছায়া-তরু কাঁপিয়া। কেঁদেছে আকাশে চাঁদের ঘরণী চির-বিরহিণী রোহিণী ধরণী কাঁদানিয়া চাঁদনীতে । । চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে ছুটে তরঙ্গ বাসনা ভঙ্গ সে অঙ্গ পরশিতে। ।

এবার দেখা যাক গানটি কি বলছে... চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার সরসীর আরশিতে ছুটে তরঙ্গ বাসনা ভঙ্গ সে অঙ্গ পরশিতে। । অর্থাৎ, আকাশের চাঁদ তার সুন্দর চাঁদমুখ-খানা সরোবরের জলে দেখতে পাচ্ছে। আর সরোবরের জলের তরঙ্গ চাঁদের সেই সুন্দর চাঁদমুখটিকে স্পর্শ করতে যেয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। গানের প্রথম লাইনেই কি তুমুল রোমান্টিকতা।

কি মর্মস্পর্শী বিরহ। চাঁদ এবং পৃথিবীর সরোবরের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব বর্তমান, যাকে অতিক্রম করে চাঁদের সাথে পৃথিবীর বা পৃথিবীর সাথে চাঁদের মিলন অসম্ভব। আর তাই সরোবরের জল-তরঙ্গ যতোই উতলা হোক তার পক্ষে দূর থেকে চাঁদের ছবি নিজের ভিতরে ধারণ করা ছাড়া যেমন দ্বিতীয় কোন প্রাপ্তি নেই তেমনি চাঁদের পক্ষেও শুধু সরোবরের জলে নিজের চাঁদমুখ খানা দেখা ছাড়া করার আর কিছুই নেই। শুধুই বিরহ...শুধুই বিরহ। আর এই বিরহকে আরো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য নজরুল তারপরই লিখলেন- হেরিছে রজনী__রজনী জাগিয়া চকোর উতলা চাঁদের লাগিয়া কাহাঁ পিউ কাহাঁ ডাকিছে পাপিয়া কুমুদীরে কাঁদাইতে।

। ‘হেরিছে রজনী__রজনী জাগিয়া’ আহা! কি চমৎকার কথা। রজনী সারারাত জেগে ‘রজনী’ অর্থাৎ, নিজেকেই দেখছে । দেখছে চকোর উতলা চাঁদের লাগিয়া। চকোর(যে পাখি চাঁদকে দেখে তৃপ্ত হয়) আজ চাঁদের জন্য উতলা হয়ে উঠছে।

আজ যেন কাহাঁ পিউ কাহাঁ রবে অবিশ্রাম ডেকে ডেকে পাপিয়া কুমুদীর তথা শাপলা-শালুকের ঘুম ভাঙাতে চাচ্ছে, তাকে কাঁদাতে চাচ্ছে। এই চাঁদনীতে যেন সকল বিরহ উথলে উঠছে। না পাওয়ার বেদনা গভীর হচ্ছে। নদীর জোয়ারের মতো হৃদয়ের দুকূল যেন প্রিয়জনের প্রতীক্ষায় প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তরঙ্গ যেমন চাঁদকে ছুঁতে পারে না তেমনি সকল আহবান যেন অচরিতার্থ প্রেমের মতো ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছে হৃদয়ে।

আর এমনি করেই তো অনন্তকাল থেকে চলে আসছে। আর তাই নজরুল লিখছেন... না জানি সজনী কত সে রজনী কেঁদেছে চকোরী পাপিয়া হেরেছে শশীরে সরসী-মুকুরে ভীরু ছায়া-তরু কাঁপিয়া। এতো আজ নতুন নয়। এমনি করে প্রত্যেক চাঁদনী রাতে চকোরী পাপিয়া কেঁদেই চলে। এমনি করেই ভীরু ছায়া-তরু তার প্রিয়তম চাঁদকে কম্পিত হৃদয় নিয়ে সরোবরের জলের মুকুরে ভাসতে দ্যাখে।

এমনি করেই তো নিরবে অশ্রু বিসর্জন করে। এভাবেই... কেঁদেছে আকাশে চাঁদের ঘরণী চির-বিরহিণী রোহিণী ধরণী কাঁদানিয়া চাঁদনীতে । । কাঁদানিয়া চাঁদনীতে আকাশে মহাশূন্যের বুকে এভাবেই চাঁদের ঘরণী পৃথিবী কেঁদে আকুল হয় তার প্রিয় চাঁদকে কাছে পাবার নিষ্ফল আকাঙ্ক্ষায়। কেননা এই চাঁদনী যে কাঁদানিয়া।

এ যে বিরহ জাগানিয়া। এমন চাঁদনীতে প্রিয়জনের অনুপস্থিতিতে তার ছায়ামূর্তি কল্পনা করে, হৃদয়ে ধারণ করে প্রত্যেক অনুভূতিশীল মনে যে শুধুই বেদনা জেগে ওঠে! তাকে তো কাঁদতেই হয়। তরঙ্গ বয়ে যায় অতৃপ্ত বাসনায়। চাঁদ আর পৃথিবীর মিলন তবু তো ঘটে না। সরোবরের স্বচ্ছ মুকুরে তাই নিজেকে দেখা ছাড়া চাঁদেরও আর কিছুই করার থাকে না।

বাংলা গান ছাড়া এমন মর্মভেদী ক্রন্দন, এমন সুতীব্র বেদনাবোধ, এমন প্রগাঢ় বিরহ, এমন চির প্রেম-আকাঙ্ক্ষা আর নিষ্ফল কামনার সংমিশ্রণ আর কোথায় কোন দেশের কোন গানে এমনি সাবলীলতায় প্রকাশিত হয়__ আমার জানা নেই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.