আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভদ্র লোকের অপরাধ

মোঃ জাহিদ হোসেন
আমরা আমাদের চারপাশে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরণের অপরাধ সংঘটিত হতে দেখি। এই অপরাধগুলো হল চুরি, ডাকাতি, হত্যা, ছিনতাই, ধর্ষণ, প্রতারণা, অপহরণ, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, আক্রমণ, মানহানি ইত্যাদি। এই ধরণের অপকর্মগুলোকেই আমরা সাধারণত নিকৃষ্ট অপরাধ বলে জেনে থাকি। কিন্তু গতানুগতিক এই ধরণের অপরাধগুলো ছাড়াও দৈনন্দিন আমাদের সমাজে এমন কতগুলো অপরাধ ঘটে যেগুলো ওই ধরণের অপরাধের চেয়ে আরও বেশি নিকৃষ্ট এবং এর প্রভাবও কম নয়। এইসব অপরাধ আপাত দৃষ্টিতে আমাদের কাছে খারাপ বা মন্দ বলে মনে হয় না।

অনেক ক্ষেত্রে এমন সব অপরাধ আমাদের সরাসরি কোন ক্ষতি না করলেও দেশ কিংবা সমাজের অনেক ক্ষতি করে ফেলে। এইসব অপরাধ এমন ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে যারা সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পেশাগত ভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং যাদেরকে আমরা সমাজে প্রভাবশালী বলেই জানি। মোটকথা এইসব অপরাধগুলো গতানুগতিক অপরাধ প্রবণতা থেকে ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। ইতিহাসে নাম করা এক অপরাধবিজ্ঞানী সাদারল্যান্ড এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে হোয়াইট কালার অপরাধ(White collar Crime) নাম দেন। বাংলায় যার প্রতিশব্দ বলা যেতে পারে ভদ্রবেশী অপরাধ।

তিনি তাঁর বিভিন্ন লিখায় তুলে ধরেছিলেন কিভাবে প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজে এসব ভদ্রবেশী অপরাধ সাধারণ মানুষের ব্যাপক ক্ষতি করছে। তিনিই সর্বপ্রথম এমন কর্মকাণ্ডকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনার জন্য সুপারিশ করেন। এরপর এই ধারণাটি ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে পরিচিত হতে থাকে। প্রচলিত সাধারণ শ্রেণীর অপরাধ যে কোন শ্রেণীর ব্যক্তি দ্বারা সংঘটিত হতে পারে। তবে হোয়াইট কালার অপরাধ চতুর ও উচ্চবিত্ত লোকদের দ্বারায় বেশি সংঘটিত হয়ে থাকে।

সকল শ্রেণীর মানুষের হোয়াইট কালার অপরাধ করার মত সুযোগ থাকে না। সাধারণ মানুষ সহজে তা বুঝতে পারে না। অনেক সময় বুঝলেও তাদের কিছু করার উপায় থাকে না। অপরাধীরা এইক্ষেত্রে নিজেদের কর্মকাণ্ডগুলোকে অপরাধ হিসেবে মানতে রাজী নন। এখন প্রশ্ন হল কোন কোন কাজগুলো হোয়াইট কালার অপরাধ হতে পারে? সমাজের উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা নিজেদের স্বার্থের জন্য বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য এমন সব অনৈতিক ও অমানবিক কাজ করে থাকে যা সাধারণ মানুষের ও দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়।

আবার প্রত্যক্ষভাবে তা ক্ষতি না করলেও পরোক্ষভাবে সাধারণ মানুষ ও দেশের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। যেমনঃ বিজ্ঞাপনে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করা, অন্যের সৃষ্ট কর্ম নিজের বলে চালিয়ে দেওয়া, কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য নিজের প্রকৃত আয় গোপন করা, কারো সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অপরকে ভুল বুঝানো, কারো দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিশ্বাস ভঙ্গ করা, শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার থেকে কৌশলে বঞ্চিত করা, শেয়ার বাজারে কারসাজি করা, ফান্ডের টাকার অপব্যবহার করা, দাম বাড়াবার জন্য মজুতদারি, ইন্সুরেন্স প্রতারণা, বিদেশে দেশের অর্থ পাচার করা, করো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে তাঁর গোপনীয় বিষয় ফাঁস করা, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে কথা অনুযায়ী কাজ না করা বা নিম্ম মানের কাজ করে দেওয়া, এক প্রকারের চাকরী দেওয়ার নামে অন্য প্রকারের চাকরী করাতে কাউকে বাধ্য করা কিংবা চাকরীর নামে টাকা জমা নিয়ে তা আর ফেরত না দেওয়া, ঘুষ নেওয়া ও দিতে বাধ্য করা, সরকারি অফিসে দ্রুত কাজ করে দেওয়ার নামে অবৈধভাবে অর্থ নেওয়া, অবৈধ কাজকে বৈধ বলে চালিয়ে দেওয়া, উন্নয়নখাতের অর্থ আত্মসাৎ করা, রোগীর শরীরে বিনা প্রয়োজনে অস্ত্রপচার, সরকারি হাসপাতালে সঠিকভাবে রোগী না দেখে প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখার প্রবণতা, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানী থেকে পারসেন্টিজ নেওয়ার জন্য ডাক্তার কর্তৃক রোগীকে নিম্ম মানের ওষুধ প্রেস্ক্রাইভ করা, ডাক্তার তাঁর নিজের লাভের জন্য রোগীকে অপ্রয়োজনে মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ প্রেস্ক্রাইভ করা। প্রকৌশলী কর্তৃক অর্থ আত্মসাৎ পূর্বক নিম্নমানের ব্রিজ ও রাস্তাঘাট তৈরি, দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তা কর্তৃক প্রতিপক্ষ থেকে ঘুষ নিয়ে রিমান্ডে কাউকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা, পুলিশ রিমান্ডে দাগী আসামীকে কোন কথা বের করতে কোন প্রকার নির্যাতন করবেনা বলে সংশ্লিষ্ট অপরাধী পক্ষ থেকে মোটা অংকের ঘুষ নেওয়া, পুলিশ কর্তৃক ৫৪ ধারায় ধৃত নিষ্পাপ ব্যক্তিকে প্রভাবশালী মহলের চাপে বিভিন্ন মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া, আইনজীবীর মক্কেলের সাথে অসধাচারণ ও হয়রানি করা, মক্কেলের গোপন তথ্য অপর পক্ষের কাছে সরবরাহ করা ইত্যাদি। ভাবছেন এমন সব অপরাধের প্রতিকার বা শাস্তি কি? হোয়াইট কালার অপরাধের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন অপরাধের জন্য বিভিন্ন আইনে বিভিন্ন ধরণের শাস্তি রয়েছে। মূলত তা নির্ভর করে কোন দেশের প্রচলিত আইন ব্যবস্থার উপর।

অর্থাৎ উল্লিখিত কর্মকাণ্ডগুলোর মধ্যে কোন কাজটা অপরাধ বলে গণ্য করা হবে আর কোন কাজটা অপরাধ বলে গণ্য করা হবে না তা নির্ভর করে মূলত সংশ্লিষ্ট দেশের প্রচলিত আইনগুলোর উপর। আমাদের দেশে চারপাশে প্রতিনিয়ত এমন অনেক হোয়াইট কালার অপরাধ ঘটছে যার কম বেশি শিকার আমরাও হচ্ছি। বিভিন্ন আইনে উপরে উল্লিখিত অপরাধগুলোর কিছু কিছুর প্রতিকার থাকলেও আমরা খুব কমই তার সুফল পাচ্ছি। যেহেতু এই সব অপরাধগুলো সমাজের প্রভাবশালী কিংবা সম্মনিত ব্যক্তিরাই বেশি করে থাকে তাই সরকারী সংস্থারও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেনা। আইনের আশ্রয় নেওয়ার পর তাদের সাথে মামলা মোকদ্দমা করে টিকে থাকাও খুব কম সম্ভব হয়।

উচ্চবিত্ত ও প্রভাবশালীদের মধ্যে যারা এসব অপরাধে লিপ্ত তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার ও বিচার এড়িয়ে চলতে সক্ষম। আর্থসামাজিক অবস্থা ও সম্মানজনক অবস্থানের কারণে অপরাধ করেও তারা অপরাধী হিসেবে সনাক্ত হয় না। এমনকি তারা তাদের অপরাধের কোন প্রমাণ রাখেনা। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা আইনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য হিসেবে সমাজে স্বীকৃত।

কিন্তু যখন সমাজের প্রতিষ্ঠিত কিংবা প্রভাবশালী লোকদের অবহেলা ও অসতর্কতার জন্য গার্মেন্টস, শিল্পকারখানা বা অন্য কোন স্থাপনায় শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটে তখন বিষয়টিকে উপরের উল্লিখিত অপরাধের মত জঘন্য অপরাধ বলে মনে করা হয় না। বছরের পর বছর গেলেও এইসব অপরাধীদের কোন বিচার হয় না। হোয়াইট কালার অপরাধীরা ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি যে আসলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তা তাকে বুঝতে দিতে চায়না। তারা মনে করেন তাদের এসব কর্মকাণ্ডের জন্য তেমন কোন মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয় না। সামান্য কিছু মানুষ তাদের কাজের জন্য প্রতিক্রিয়া জানালেও তাতে তারা গুরুত্ত দেয় না।

তারা অন্য ব্যক্তির অসতর্কতার সুযোগটিই বেশি নিয়ে থাকে। সমাজে তাদের কৃত অপরাধগুলো হালকা বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় অন্যান্য নিকৃষ্ট শ্রেণীর অপরাধীর চেয়ে হোয়াইট কালার অপরাধীরা কতটা বেশি মাত্রায় অপরাধপ্রবণ। তাছাড়া হোয়াইট কালার অপরাধ বিষয়ে প্রচলিত আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগের গণদাবীও তেমন জোরালো নয়। প্রকাশ্যে এইসব অপরাধীরা প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দেখালেও ভেতরে পেশাগত স্বার্থে তাদের মনোভাব অনেকটা দস্যুদের মত।

উপযুক্ত শাস্তি না হওয়ার কারণে তারা অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। ব্যাপারটি এমন যে রাষ্ট্রে কিছু কিছু আইন প্রণয়ন করা হয় প্রভাবশালীদের রক্ষার জন্য অপরদিকে সমাজের দুর্বল শ্রেণীকে শোষণ করার জন্য। লেখকঃ মোঃ জাহিদ হোসেন, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, স্টুডেন্ট কাউন্সিল, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন, চট্রগ্রাম। Click This Link
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।