বছরে দুইবার মামাবাড়ি যেতাম। বৈশাখ মাসে মামা বাড়ীর পাশে ইয়া বড় বৈশাখী মেলায় আর কার্ত্তিক মাসে কালীপূজোয়। তখন ঐদিকে কারেন্ট ছিল না। কালিপ্রতিমা কিনে নৌকায় করে নিয়ে যেতাম, সাথে মাইক, ক্যাসেট আর ব্যাটারি। সারা পথ মাইক বাজত আর খালের দু ধার দিয়ে বাচ্চা ছেলে মেয়েরা আমাদের সাথে সাথে ছুটত।
কি সব গান... 'জানে জিগার জানে মান’, ‘মুঝে নিঁদ না আয়ে’ এখনো কানে লেগে আছে...
সারা রাত আমরা অনেক মজা করতাম, তারাবাজি, ঘটবাজি, হাতুরি-বোমা সারারাত ই চলত। প্রতিবছর এই একটা দিনের জন্য চেয়ে থাকতাম... কবে কালী পুজোর দিন আসবে আর মজা করবো! ভুমিকা বেশী হয়ে যাচ্ছে। ঐ সময় থেকেই কালী মা কিংবা কালী পুজা জিনিসটাই অনেক আনন্দের বিষয় ছিলো আমার কাছে।
এইচ এস সি পরীক্ষার আগে বছর খানেক আমাকে রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্রাবাসে রাখা হয়েছিল বাসায় ঠিকমতো পড়াশুনা করতাম না বলে। মিশনের তত্ত্বাবধায়ক কে আমরা মহারাজ স্যার বলতাম।
আমার দেখা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ এই লোকটি পুজা অর্চনার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ব্রাহ্মন দের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তার যুক্তি ছিল ঈশ্বরের কাছে সবাই সমান। একজন ব্রাহ্মন যেমন, একজন মুচিও তেমন। মিশনে একজন ঠাকুর নির্দিষ্ট করে রাখা থাকলেও সপ্তাহে একদিন করে পালাক্রমে সব ছাত্রকে মন্দিরের যাবতীয় কাজ করতে হতো।
সকাল পাঁচটায় উঠে মন্দির ঝাড়ু দেয়া, মোছা, মন্দির খুলে দেয়া, ফুল তোলা, সকালের প্রার্থনা, সন্ধায় প্রার্থনা, আরতি, প্রসাদ বিতরন, রাতে মন্দির বন্ধ করা সবকিছুই করতে হতো আমাদের।
প্রথম প্রথম আমার অনেক বিরক্ত লাগতো। একঘেয়ে কাজ। একটা সময় এ কাজগুলো আমার ভালো লাগতে শুরু করলো।
সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় ছিল রাতে যখন কালী মন্দিরের দরজা বন্ধ করে একমনে কালী প্রতিমার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কি যেন এক অদৃশ্য আকর্ষণে বসে থাকতাম প্রতিমার সামনে।
অত বড় মূর্তির সামনে যেতে সচরাচর ভয় লাগার কথা তাও দরজা জানালা বন্ধ করে। অদ্ভুত ব্যাপার আমার একটুও ভয় করতো না। মায়ের কাছে আছি, ভয় কিসের। কি অদ্ভুত মধুমাখা হাসি মায়ের মুখে! অদ্ভুত এক আবেশে আমি তন্ময় হয়ে থাকতাম...
নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর নতুন প্রতিমা আনার সময় পুরনো প্রতিমা বিসর্জন দিতে হয়। যেদিন মায়ের প্রতিমা বিসর্জন দিলাম আমরা, আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিলো, কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো।
জানি এ বিগ্রহ মাটির এটা মাটি, কাঠের কাঠামো আর খড় কুটা দিয়ে বানানো তবুও বার বার মনে হচ্ছিলো আমরা যেন রক্ত মাংসের বিগ্রহ কে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছি... এ অনুভূতি বুঝিয়ে বলা যায় না...
শেষ কবে মামাবাড়ি গিয়েছি মনে নাই...
এখন আমার যুক্তিবাদী মন কংক্রিট প্রমান ছাড়া কোন কিছু মানতে চায় না। যত বেশী জানার চেস্টা করেছি, জেনেছি, ততই দূরে সরে গিয়েছি বিশ্বাসের সারল্য থেকে।
‘সংস অফ ইনোসেন্স’ অবিশ্বাসের ভিড়ে ‘সংস অফ এক্সপেরিএন্স’ হয়ে গেছে। এখন আর মা তার পাপী সন্তানের কাছে আসেন না। মন্দিরেও যাই না অনেকদিন।
শেষ যেবার গিয়েছিলাম মা আমার সাথে কথা বলেননি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।