অবশেষে মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ক্ষমতা খর্ব করল সরকার। গতকাল রোববার জাতীয় সংসদে দুর্নীতি দমন কমিশন সংশোধন বিল ২০১৩ পাস হয়েছে। এর ফলে কমিশন সরকারের অনুমোদন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করতে পারবে না।
এই বিধানের মাধ্যমে সরকার আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সুপারিশও উপেক্ষা করল। সংসদীয় কমিটির সুপারিশে এ বিধান না রাখার সুপারিশ করা হয়েছিল।
এই সরকারের মেয়াদের শুরুতেই সরকার এ বিধানটি রাখার উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা হওয়ায় সরকার অনেক দিন বিষয়টি নিয়ে এগোয়নি। এমনকি দাতারাও আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করা হলো। তবে সূত্রগুলো বলছে, এর ফলে নির্বাচনের আগে সরকারি কর্মকর্তারা খুশি হবেন।
জানতে চাইলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি অন্যায্য, এটি সরকারের দুর্নীতি দমনের প্রক্রিয়াকেই বাধাগ্রস্ত করবে। এর মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একধরনের ‘সুরক্ষা’ প্রক্রিয়ার মধ্যে নেওয়া হলো। যেহেতু তাঁরা ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’ তাই অবশ্যই তাঁদের কাজের বিষয়ে অধিকতর জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া সরকারি বিভাগে কাজ করলেই যদি ‘সুরক্ষিত’ থাকেন, তবে বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেন ‘অরক্ষিত’ হবেন? আইনের ক্ষেত্রে এ ধরনের বৈষম্য রাখা ঠিক নয়। কারণ, সংবিধানেই বলা আছে, ‘আইনের চোখে সবাই সমান।
’
গতকাল সংসদকাজে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বিলটি উত্থাপন করলে সাতটি সংশোধনীসহ তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। সরকারি দলের সাংসদ র আ ম উবাদুল মোকতাদির চৌধুরীর দেওয়া সংশোধনী প্রস্তাবের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের ছাড় দেওয়ার বিধানটি অন্তর্ভুক্ত হয়। আড়াই বছর পর পাস হওয়া এই বিলে নতুন করে ৩২/ক ধারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা আবশ্যিকভাবে পালন করতে হবে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারায় বলা আছে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মকর্তা কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত হলে সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো আদালত সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নিতে পারবেন না।
কোন আদালতে এই মামলার বিচার হবে, তা সরকার নির্ধারণ করে দেবে।
এ-সংক্রান্ত আগের আইনে (৩২ ধারা) সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের একক ক্ষমতা ছিল। এই ধারাটি সংশোধন করে বলা হয়েছে, কমিশনের অনুমোদন ছাড়া কোনো আদালত এই আইনের অধীন কোনো মামলা আমলে নিতে পারবে না। সংসদকাজে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ২০১১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বিলটি সংসদে উত্থাপন করেছিলেন।
সংসদীয় কমিটি সূত্রে জানা গেছে, শুরু থেকেই সংসদীয় কমিটি এ বিধান না রাখার পক্ষে অবস্থান নেয়।
এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য সংসদীয় কমিটি অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া সফর করে দেশগুলোর এ-সংক্রান্ত আইন পর্যালোচনা করে। এ ছাড়া কমিটি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মতবিনিময় করে। খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও চিঠি দিয়ে দুদকের ক্ষমতা খর্ব না করার জন্য কমিটিকে অনুরোধ জানান। সবশেষে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর কমিশন এ বিষয়ে সংসদে প্রতিবেদন জমা দেয়। তাতে তারা সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা-সংক্রান্ত কমিশনের ক্ষমতা বহাল রাখার পক্ষে মত দেয়।
এরপর গত ২৮ অক্টোবর বিলটি পাসের জন্য সংসদের উত্থাপন করা হয়। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে সেদিন বিল পাস না করে প্রত্যাহার করা হয়। অবশেষে গতকাল সংশোধনীর মাধ্যমে কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করে বিলটি পাস হয়।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন যাতে স্বাধীনভাবে সরকারের মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনতে না পারে, সে জন্যই এই আইন করেছে। কিন্তু এর ফল সার্বিকভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে।
বিলে দুদক কমিশনারদের মেয়াদ চার বছরের জায়গায় পাঁচ বছর করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আদালতে অভিযোগ জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে দুদকের অনুমোদনপত্রের কপিও জমা দিতে হবে। দুর্নীতি-সংক্রান্ত অপরাধ আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য হবে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে কিংবা অনিশ্চিত তথ্য দিয়ে কোনো তদন্ত বা বিচার পরিচালনা করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সর্বনিম্ন দুই থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীর ক্ষেত্রেও একই দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
আইনে তথ্য প্রদানকারীর পরিচয় গোপন রাখার বিধান রয়েছে। বলা হয়েছে, তদন্ত কর্মকর্তাকে ১২০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। কোনো কর্মকর্তা তাতে ব্যর্থ হলে আবেদন সাপেক্ষে সর্বোচ্চ ৬০ কার্যদিবস বাড়ানো যাবে। এর পরও ওই কর্মকর্তা ব্যর্থ হলে নতুন করে অন্য কোনো কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়ে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। ব্যর্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিধান রাখা হয়েছে।
আইনে আরও বলা হয়েছে, কমিশন নিজ কর্মকর্তাদের অপরাধ তদন্ত করতে পারবে না। তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অপরাধ তদন্তের দায়িত্ব পুলিশ বা অন্য কোনো সংস্থাকে দিতে হবে। দুদক সরকারের কাছে তথ্য চেয়ে না পেলে নিজ উদ্যোগে তদন্ত করতে পারবে।
বিলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মতিয়া চৌধুরী বলেন, প্রস্তাবিত সংশোধনের মাধ্যমে দুদকের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।
এ ছাড়া গতকাল ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) বিল ২০১৩ পাস হয়েছে।
পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বিলটি উত্থাপন করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। এর বাইরে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সংশোধন বিল ২০১৩ ও বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড বিল ২০১৩ সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। বিল দুটি উত্থাপন করেন যথাক্রমে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। পরে বিল দুটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।
সবশেষে সংসদের অধিবেশন ১৮ নভেম্বর বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।