আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নাটকীয় চ্যাম্বার ও মডেল রোগী



শহরের একটা ব্যস্ত ক্লিনিক। তাতে নতুন একজন ডাক্তার গত কয়েক মাস যাবৎ বসছে। ডাক্তার সাহেবের নাম আহমেদ নাসিফ। একদিন চ্যাম্বার শেষে বাসায় যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় বাবু এসে জানালো : স্যার, মৌসুমী নামের ওই মেয়েটা আজকে আবার আসছে। ওই যে আপনাকে মাঝে মাঝেই দেখাতে আসে।

নাম শুনেই নাসিফের বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে গেলো। বাবুকে বলল : গিয়ে বল আজকে আর দেখানো যাবে না। আজকে স্যারের রোগী দেখা শেষ। : বলেছি স্যার। কিন্তু মেয়েটা নাছোড়বান্দা।

বলছে খুব ইমার্জেন্সি। : ইমার্জেন্সি হলে হাসপাতালে যাক। আমার কাছে কী? কি যে এক যন্ত্রনা করে না মেয়েটা। : স্যার আপনি বুঝিয়ে বলেন। আমি পাঠিয়ে দিলাম।

অনেকক্ষন যাবৎ বসে আসে। : ঠিক আছে। বিরক্ত মুখে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল নাসিফ। কিছুক্ষন পর দরজায় একটা রিনরিনি কন্ঠ শোনা গেল। :স্যার, আসতে পারি।

: হুমম আসেন। : আপনাকে বোধহয় খুব বিরক্ত করলাম। এক্সট্রিমলি সরি। ভদ্রতার ধার না ধেরে নাসিফ বললো : তা তো করেছেনই। সারাদিন এত রোগী দেখে এত টায়ার্ড।

কোথায় বাসায় যাবার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। এর মাঝে এই ঝামেলা ভালো লাগে? : এত রোগী দেখলেন কোথায়? রোগীই তো দেখলেন মোটে ১৭ টা। আমাকে নিয়ে ১৮টা। আমি রেজিস্ট্রি খাতা দেখেছি। তার মাঝে আবার বেশিরভাগই মেয়ে।

আপনার তো সময় ভালোই কাটার কথা। এ যে খুবই ফিচেল টাইপের মেয়ে এই পরিচয় নাসিফ আগেই পেয়েছে। এক কথায় ডাবল অপমান। রোগী নাকি দেখছে মাত্র ১৭টা। তাও বেশির ভাগ মেয়ে।

কত্তবড় অপমান। এর সাথে বেশি কথা বলা যাবে না। তাড়াতাড়ি বিদায় দিয়ে দিতে হবে। আর ওকে তো বুঝতে দেয়া যাবে না এই ১৭ টা রোগীই এখন পর্যন্ত নাসিফের সর্বোচ্চ। : অবশ্য আপনার টায়ার্ড লাগতেই পারে।

আগে ত দেখলাম কোনদিন এত রোগী দেখেনই নাই। অভ্যাস থাকতে হয়তো। অপমানে কান লাল হয়ে গেল নাসিফের। : বেশি কথা না বলে আপনার সমস্যা বলেন। : জ্বী সেইটা বলতেই তো আসা।

বলেই চেয়ারটা একটু নাসিফের কাছাকাছি এগিয়ে নিয়ে আসতেই নাসিফ চেচিয়ে উঠলো :কি ব্যাপার চেয়ার এত কাছে টেনে নিয়ে আসতেছেন কেন? গায়ের উপর উঠে যাবেন নাকি? আপনাদের মত মেয়েদের নিয়ে এই এক সমস্যা। কেউ দেখলে কি ভাববে বলুন তো। অপমানে মৌসুমীর ফর্সা মুখটা ঝা করে লাল হয়ে গেল। তবে একটু আগে করা অপমানের শোধটা নিতে পেরে নাসিফের একটু ভালো লাগছে। চেয়ার টেনে আগের জায়গায় বসল মৌসুমী।

: বলুন আপনার কি সমস্যা? : ডাক্তার সাহেব, আমার বুকে ব্যথা; কিছু ভালো লাগে না; রাতে ঘুম হয় না। : খাবার দাবারে রুচি হয় না; কেমন যেন একা একা লাগে। তাই না??? :জ্বী জ্বী ডাক্তার সাহেব। আপনি ঠিক ধরেছেন। কেমন যেন খুশী হয়ে যায় মৌসুমী।

: হুমম। এই বয়সে মেয়েদের কমন সমস্যা। শুনেন আপনাকে Traditional Treatment না দিয়ে Evidence Based Medicine-এ ট্রিটম্যান্ট দিতে হবে। : Evidence Based Medicine কী ? : এ আপনি বুঝবেন না। সহজ ভাষায় বলতে গেলে এইটা হলো এক ধরনের অফ ট্রাক চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে অনেকের উপর চিকিৎসা দিয়ে ভালো ফল পাওয়া গেছে এই ধরনের Evidence-এর উপর ভিত্তি করে দেয়া চিকিৎসা পদ্ধতি।

: এত Evidence আপনি কোথায় পেয়েছেন? আপনার কাছে কি এই ধরনের রোগীই বেশি আসে???? নাসিফকে এই সময় কেমন যেন একটু বিব্রত দেখায়। : নাহ। মানে আসে আর কি? আসে মাঝে মাঝে আসে। :ঠিক আছে তাই দেন। আপনার অনেক অভিজ্ঞতা বোঝা যাচ্ছে।

নাহ মেয়েটার সাথে কথা বলাই বিপদ। কখন কোন প্যাচে ফেলে দেয় ঠিক নাই। তাই কিছু না বলে নাসিফ খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখতে লাগলো। নাসিফ অবশ্য খেয়াল করে নাই যে মৌসুমী তাকে কি মনোযোগ দিয়ে দেখছে। মৌসুমী তার সমস্ত মনোযোগ দিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তখন নাসিফের প্রেসক্রিপশন লেখা দেখছে।

কি সুন্দর মাথা নাড়িয়ে নিচের ঠোট কামড়ে ধরে প্রেসক্রিপশন লিখছে। নিচের ঠোট কামড়ে আছে দেখলে মনে হয় ছোট বাবুরা যেমন পড়া ভুলে গেলে নিচের ঠোট কামরে পড়া মনে করতে চায় মৌসুমীর কাছে সেই রকম মনে হচ্ছে। আবার কি একটা বস্তাপচা হিন্দি গানের সুরও ভাজছে। মৌসুমীর এত মায়া লাগলো নাসিফের উপর বলার মত না। চোখে পানি চলে আসলো।

তাড়াতাড়ি উড়না দিয়ে চোখটা মুছল। প্রেসক্রিপশন লেখা শেষ করে মৌসুমীর দিকে এগিয়ে দিলো নাসিফ। মৌসুমী মাথা নিচু করে প্রেসক্রিপশনটা পড়তে লাগলো ১। ভালোবাসার মানুষের আদর দৈনিক সকালে একবার রাতে একবার - ৭ দিন ২। রোমান্টিক ম্যাসেজ আদানপ্রদান প্রতিবেলা ১ টা করে দৈনিক ৩ বার - ৭ দিন ৩।

হাতে হাত রেখে ব্যাকগ্রাউন্ডে রবীন্দ্র সংগীতসহ কফি পান প্রতিদিন সন্ধ্যায় একবার - ৭ দিন ৪। ভালোবাসার মানুষের সাথে বাহিরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া এবং বাহিরের কোন রেস্তোরায় রাতের ডিনার প্রতি সপ্তাহে ১ বার - ১ মাস। ৫। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আই লাভ ইউ- ৭ বার - ৭ দিন। সাতদিন পর দেখা করতে আসবেন।

মৌসুমী প্রেসক্রিপশন খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ল। পড়ে বলল :কোন পরীক্ষা লাগবে না ডাক্তার সাহেব? : সাত দিন পর আসেন। তখন লাগলে দিবো। : ঠিক আছে ডাক্তার সাহেব। তবে আপনি প্রেসক্রিপশন-এ একটু কষ্ট করে ৭ দিন, ১ মাস কেটে 'চলবে' লিখে দিন।

কোন সমস্য নাই তো। নাসিফ তখন মেয়েটাকে বিদায় করতে পারলে বাঁচে। : অবশ্যই। কোন সমস্যা নাই। আমাকে তো আর দিতে হচ্ছে না।

: কিছু বললেন ডাক্তার সাহেব? : নাহ। কিছু না। প্রেসক্রিপশনটা মৌসুমীর হাতে দিয়ে নাসিফ মৌসুমীর দিকে অনেকটা এগিয়ে অনেকটা ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে বলল :শুনেন এই প্রেসক্রিপশন কিন্তু কাউকে দেখাবেন না। এমনকি আপনার স্বামীকেও না। আপনার স্বামী জানতে পারলে কিন্তু অন্য কিছু ভাবতে পারে।

ভাবতে পারে আপনার আর আমার মাঝে ইয়ে আছে। : 'ইয়ে' কী ডাক্তার সাহেব? : 'ইয়ে' মানে 'ইয়ে'; মানে কিছু না। : আর আপনার এই ইয়ে মার্কা কথাটা তো আপনি আপনার জায়গায় বসেও বলতে পারতেন। একদম গায়ের উপড় উঠে এসে বলার কি আছে? মানুষ দেখলে কি ভাববে বলুন তো। নাসিফের কথাটা হুবুহু ফিরিয়ে দিতে পেরে মৌসুমীর খুব ভালো লাগলো।

নাসিফের পুরা মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। পদে পদে মেয়েটার কাছে অপদস্থ হচ্ছে। নাসিফ এবার অন্য দিক থেকে আক্রমন করলো- : শুনুন, এরপর আমার চ্যাম্বারে কখনো একা একা আসবেন না। আপনার বয়সী একটা মেয়ে একা একা আসলে এখানে নানা কথা উঠতে পারে। এরপর এখানে আসলে আপনার স্বামী অথবা অন্য কাউকে নিয়ে আসবেন।

বুজতে পারছেন??? : আমার তো সাথে আনার মত কেউ নাই। ও ওর বাসার অমতে আমাকে বিয়ে করেছে। বাসায় কেউ মেনে নেয়নি। তাই আমরা এখন একাই থাকি। ও ওর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

তাই সাথে নিয়ে আসতে পারি না। : সো স্যাড। কেন যে আপনারা এই কাজগুলো করেন বুঝি না। বাসার অমতে বিয়ে করা কি ঠিক? ঠিক আছে আপনি আজ আসেন। অনেক রাত হয়ে গেল।

বাসায় আবার আমার ম্যাডাম না রেগে ফায়ার হয়ে আছ কে জানে?? :ঠিক আছে ডাক্তার সাহেব। আসি। আসসালামু আলাইকুম। : ওয়ালাইকুম সালাম। চ্যাম্বারের ভিতর ছোট্ট নাটকটা শেষ করে মৌসুমী যখন তার ভ্যানিটি ব্যাগে প্রায় একই রকম ৪৪ নাম্বার প্রেসক্রিপশনটা রেখে ক্লিনিক থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল তখন অনেক দিন যেই কাজটা করার সাহস করে নাই তাই করে বসলো।

নাসিফের হাত ধরে বসলো। নাসিফ কিছু বললো না। ততক্ষনে ক্লিনিকের সবার চোখ ছানাবড়া অবস্থা। বাবু তার পাশের ছেলেটাকে বললো : স্যারকে আমার আগেই সন্দেহ হইছিল। মেয়েটা আসলে স্যার যতই রাগ করার ভান করুক না কেন মনে মনেই খুশীই হয়।

নাহ স্যারকে তো আমার ভালোই লাগতো। কিন্তু স্যারের ক্যারেক্টার যে এত খারাপ বুঝি নাই। বাবুর সব কথাই ঠিক। কিন্তু রেজিস্ট্রি খাতায় মৌসুমী নামের মেয়েটার স্বামীর নামের জায়গাটা যদি বাবু আরেকটু মনোযোগ দিয়ে দেখে তার স্যারের নামটা দেখতো তাহলে হয়তো তাকে তার স্যারের ক্যারেক্টার নিয়ে এত চিন্তা করতে হতো না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.