আমৃত্যু সাধারন হয়ে সাধারনের মাঝেই থাকতে চাই।
স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরছিল সে। খালপাড়ের কাছাকাছি আসতেই পেছন থেকে দুটি শক্ত হাত জাপটে ধরল তাকে। সাদা রঙের একটি রুমাল দিয়ে নাক চেপে ধরল তার। তারপর আর কিছু মনে নেই।
এখন সে চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের করতে পারল না। পারল না, কারন-তার মুখ বাঁধা। শুধু যে মুখ বাঁধা তা নয়, তার হাত এবং পা দুটিও বাঁধা। তাই সে ঠিকভাবে নড়াচড়াও করতে পারছে না। মুখ, হাত ও পা বাঁধা হলেও তার চোখ বাঁধা হয়নি।
যে নরপশু তাকে এখানে নিয়ে এসেছে সে তার চোখ বাঁধার প্রয়োজন মনে করেনি। তাই সে দেখতে পাচ্ছে সবকিছুই। ছোট্ট একটা ঘর। তার এক কোনায় একটা টেবিল। এক পাশে একটা খাট আছে।
আর কোন আসবাবপত্র নেই। টেবিলের উপর একটা মোমবাতি জ্বলছে। ওটা প্রায় নিভু নিভু। আর কিছুক্ষণের মধ্যে সারা ঘর অন্ধকার হয়ে যাবে। ঘরের একটি মাত্র জানালা।
সেটা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। দরজাও বন্ধ বাইরে থেকে। ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে কোন আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে না। তাই সে বুঝে নিল এখন রাত। কিন্তু কতটা রাত? ঘরে কোন ঘড়ি নেই।
ঘড়ি থাকলে দেখতে পারত কটা বেজেছে। অবশ্য সময়ের হিসেব সে রাখতে চায় না। সময়ের হিসেব রেখে কী হবে এখন?
বাইরে কয়েকটি গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। কথা শুনে মনে হল তিন জন লোক আছে। তিনটি গলার স্বর পাওয়া গেল।
একটি স্বর বলল, ‘জ্ঞান ফিরলে বড় ভাইরে খবর দিতে হবে। আজকে শালীর বিষ নামানো হবে। কত বড় সাহস, আমাগো বড় ভাইরে পাত্তা দেয় না!’
দ্বিতীয় স্বরটি বলল, ‘চল, জ্ঞান ফিরল কিনা দেখে আসি। ’
প্রথম স্বরঃ ফিরে নাই এখনো। একটু আগেই দেইখা আসছি।
তৃতীয় স্বরঃ এখন হয়তো জ্ঞান ফিরছে। চল, আরেকবার দেইখা আসি। বাইন্ধা রাখা মানুষ দেখতেই মজা, এইটা তো আরো মাইয়া মানুষ।
প্রথম স্বরঃ দেইখাই মজা নিতে হইব। ঐটা বড় ভাই এর খাবার।
জানোয়ারগুলোর কথা শুনে ঘৃণায় সারা শরীর রি রি করে উঠল মেয়েটির। সে মনে মনে বলল, ‘মৃত্যু দাও, খোদা। ’ তখন খুট করে দরজা খুলে গেল। মেয়েটি সাথে সাথে অজ্ঞান হবার ভান করে পড়ে রইল। সে বুঝতে পেরেছে, জ্ঞান ফেরার আগ পর্যন্তই তার বেঁচে থাকা।
ছেলেগুলো কিছুক্ষন চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে, চুল টেনে, পায়ের তালুতে সুড়সুড়ি দিয়ে পরীক্ষা করল। চোখের উপর পানি ঢেলে দিল। কিন্তু মেয়েটি কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। ধৈর্য ধরে চুপ করে পড়ে রইল। একটা স্বর বলল, ‘চল যাই।
তাস খেলি। আশ্চর্য! জাগনা হয় নাই এখনো। ’
আরেকটি স্বর বলল, ‘এমনওতো হইতে পারে, ইচ্ছা করে পইড়া আছে। ’
অন্য একটি স্বর বলল, ‘আরেহ না, মাইয়া মাইনষের এত বুদ্ধি নাই। জ্ঞান ফিরা আসলে এখন ট্যাগট্যাগাইয়া চাইয়া ভেগভেগাইয়া কান্দন শুরু করত।
’
তারপর খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে বাইরে থেকে দরজা আটকে চলে গেল সবাই।
এক সময় মোমবাতিটি নিভে গেল। সারা ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। মেয়েটি চোখ বন্ধ করে সেভাবেই পড়ে রইল। যে অন্ধকার তার জীবনে ঘনিয়ে আসতে চলেছে তার কাছেতো এই অন্ধকার কিছুই না।
মেয়েটি তার বাবার মুখটি মনে করল। ধবধবে সাদা দাড়িভর্তি কী সুন্দর একটা মুখ। দেখলেই কেমন পবিত্র একটা অনুভূতি হয় মনে। কি করছে এখন বাবা? নিশ্চয়ই তাকে খুঁজছে পাগলের মত। মায়ের মুখ মনে পড়ল তার।
দুঃখ- শোকে, ভাল লাগা-মন্দ লাগায় সারাক্ষণ মুখে হাসি ধরে রেখে যুদ্ধ করে যায় যে মহিলা-কী করছে এখন সে? নিশ্চয়ই আকুল হয়ে কাঁদছে। মেজ আপার শান্ত চোখ দুটি এখন নিশ্চয়ই উদ্বিগ্নতায় ছেয়ে গেছে। বন্দী অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করার পর থেকে এই প্রথম তার চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল। তখন আবার দরজা খুলে গেল। মেয়েটি আগের মতই চোখ বন্ধ করে অসাড় হয়ে পড়ে রইল।
তার মুখের উপর গরম নিশ্বাস পড়ল। ভয়ে বুক কেঁপে উঠল তার। হায় আল্লাহ, এই মানুষগুলোর মধ্যে একটি মানুষেরও কি ভেতরের মানুষটি বেঁচে নেই? সবাই কি পুরোপুরি পশুতে রূপান্তরিত হয়েছে? নিজের ভেতর চিৎকার করে সে বলল, ‘প্লীজ, আমাকে যেতে দাও। ’ মনের অজান্তেই সেই শব্দ তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো। গোঁ-গোঁ একটা শব্দ হল।
মেয়েটি চোখ মেলে কাতর অনুনয়ে তার সামনে বসে থাকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইল। চোখের ভাষায় সে বলল, ‘প্লীজ, আমাকে যেতে দাও। ’ ছেলেটির বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের মত হবে। শ্যামলা গায়ের রঙ। মুখে খোচা খোচা দাড়ি।
লোভে চকচক করছে না তার চোখ। ছেলেটি বলল, ‘কে তুমি?’
‘আমি শায়লা। ’
শায়লা নামের মেয়েটি কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝে ফেলল এই ছেলেটি ঐ তিনজনের একজন নয়। ছেলেটি কিছুক্ষণ নিস্পলক তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। কী সুন্দর ছোট্ট গোলগাল একটা মুখ! তার মনে হল যেন ঝুমা বসে চোখের জল ফেলছে।
ঝুমা তার ছোট বোনের নাম, যে বছরখানেক আগে তার ভালবাসার মানুষের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। সবাই চেয়েছে তাদের আদরের ঝুমা ফিরে আসুক কিন্তু সে আসেনি। যোগাযোগই করেনি কখনো। এখন এই দুর্দশায় ঝুমা থাকলে তার যেমন লাগত এই মেয়েটির জন্যেও ঠিক তেমনই লাগছে। ছেলেটি বলল, ‘বড় ভাই আমাকে পাঠাইছে তোমার খোঁজ নিয়ে যেতে।
আমি তোমাকে কী বলি সেটা শুন মন দিয়া। এই দালানটার পেছন দিকটায় একটা জঙ্গল আছে। জঙ্গল ধরে সোজা দৌড়াইবা। একটা গেইট আছে ঐদিকে। গেইট টপকাইয়া যদি যাইতে পার তাইলে বাঁইচা যাবা।
ঐপাশে বড় রাস্তা। বড় রাস্তা ধইরা তুমি কোন দিকে যাইবা আমি জানি না। এই ঘরটা ছাদের উপর। ছাদের সাথে লাগানো একটা সুপুরি গাছ আছে। ঐ গাছ ধইরা নাইমা জঙ্গলের দিকে দৌড়াও।
’
ছেলেটি তার প্যান্টের পকেট থেকে একটা মোবাইল ফোন মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল, ‘প্রয়োজন না হইলে আলো জ্বালাইবা না। ’
তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মেয়েটির মন ভরে গেল।
শায়লা নামের মেয়েটি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সোজা দৌড়ে যেতে থাকল। সে এখনো জানে না তার ভাগ্যে কী আছে, তবু নিজেকে রক্ষার শেষ চেষ্টা তাকে করতেই হবে। তার পায়ে কাঁটা ফুটল, ধারালো কোন একটা লতার সাথে লেগে হাতের চামড়া ছিলে গেল, হয়তো রক্তও বের হল।
সে ব্যাথা অনুভব করল কিন্তু থামল না। শরীরের শক্তি কমে গেলেও মনের শক্তি তাকে পড়ে যেতে দিল না। একসময় গেইট পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠে গেল সে। পেছনে তাকিয়ে দেখল-নাহ, কেউ ধাওয়া করছে না তাকে। তবু সে দৌড় থামাল না।
আরো কিছু দূর গিয়ে একটা পথনির্দেশিকা চোখে পড়ল তার। হ্যাঁ, আর সামান্য কিছু দূর গেলেই একটা থানা পাওয়া যাবে, একটা বাজার পাওয়া যাবে। অনেক শব্দ শোনা যাচ্ছে, অনেক আলো চোখে পড়ছে। সে বাবাকে ফোন করে বলল, ‘বাবা, আমার ভয় করছে। ’ কথা বলার সময় মেয়েটির গলা কাঁপছিল; হয়তো ভয়ে নয়, মুক্তির আনন্দে।
ল্যাম্প পোস্টের আলোয় পিচ ঢালা কালো রাস্তাটাকে বড্ড আপন মনে হল তার। পায়ের ব্যাথাটাও অনুভব করল তখন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।