এক কুরবানির ঈদের দিন মেয়েটাকে প্রথম দেখেছিলাম। আমাদের গরুটা একটুপরে কুরবানি দেওয়া হবে বলে সবাই গরুটাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল। সেও ছিল ভিড়ের মধ্যে। কি অপরূপা সুন্দরই না ছিল মেয়েটা। কবি-সাহিত্যিক না হওয়ায় তার রূপের রূপক বর্ননা দেবার সাহস করলাম না।
যাইহোক, অপরূপা সেই সুন্দরির সাথে ছিল আরও একটা মেয়ে। আমি তো যারপরনাই অবাক! কুরবানি দেওয়া দেখতে তো বস্তির বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এসে ভিড় করে। কিন্তু এই মেয়েদুটাকে দেখে তো বড় ঘরের মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। আমার আবার বরাবরের উটকো কৌতূহল। তাই কৌতূহলকে অবদমিত না রেখে এগিয়ে গিয়েছিলাম মেয়েদুটির দিকে।
আজকালকার দিনে হলে 'হাই' বলে আলাপচারিতা শুরু করা যেত। কিন্তু তখনকার দিনে সেসবের বালাই ছিল না বলে স্রেফ মুখটাকে হাসি হাসি করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না আপু! মেয়েটাও আমার হাসি আমাকেই ফেরত দিয়ে বলেছিল, আমাকে তো আপনার চেনার কথা না! আমি থাকি ঢাকায়। ঈদে মামার বাড়ি এসেছি। এই হল আমার মামাতো বোন সোমা। দুজনে মিলে গরু কোরবানি দেখতে বের হয়েছি।
-আপনাদের মামার বাড়ি কোথায়?
-আছে এখান থেকে বেশ দূরে। জায়গাটার নাম খুব সম্ভবত বৃষ্টিপুর। আগে কোনদিন আসি নাই তো, জায়গাটা ঠিক কোথায় আপনাকে বলতে পারছি না।
বৃষ্টিপুর জায়গাটা যে কোথায় এবং কত দূরে, তা আমার ভালই জানা ছিল। তাই আমি অনেকটা চোখ কপালেই তুলে বলেছিলাম, সে কি! আপনারা দুজনে মিলে এতদূরে চলে এসেছেন!
-আপনাদের তো সকালবেলা উঠে নামাজ পড়তে যেতে হয়।
আমাদের সে সমস্যা নাই। তাই সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই বেরিয়ে পড়েছি। বাসায় অবশ্য কাউকে বলে আসি নাই। জানলে আসতে দিত না। নিজেদের গরুর কুরবানি না দেখে পরের গরুর কুরবানি দেখতে কে ছাড়বে বলুন? সোমাটাকেও তো কত জোরজবরদস্তি করে আনতে হল।
এই বলে সে তার মামাতো বোনের মাথায় একটা চাটি মারল। আগেই বুঝেছিলাম যে সোমা নামের মেয়েটা কম কথা বলে। কিন্তু সেও এবার ঝাঁজিয়ে উঠল, আমি পথ চিনিয়ে এত দূর নিয়ে আসলাম আর তুই কিনা এখন আমাকেই মারছিস! ফুপুকে বলে দিলে বুঝবি মজা!
সে তার ফুপুকে বলে দিবে কিনা, আমার তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। আমি শুধু মনে মনে তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলাম কাজিনকে নিয়ে আমাদের বাসায় এসে পড়াতে। আসলে আমার গল্পের মেয়েটা এতই আকর্ষণীয়া ছিল যে তার সাথে দেখা করবার সুযোগ করিয়ে দেয়ায় যার পরোক্ষ অবদান রয়েছে, তাকেই হাজার নমঃ করতে মন চাইছিল।
আমি আবারো মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, হঠাৎ গরু কুরবানি দেওয়া দেখতে বেরিয়ে পড়লেন যে?
উত্তরে সে কি বলেছিল, ভাল করে শোনা হল না। শুধু 'এডভেঞ্চার' কথাটা কানে এসেছিল। এমন না যে আমি তার কথায় আগ্রহ হারিয়েছিলাম। আমাদের গরুরই কুরবানি আর আমি কোথায় উধাও হলাম, তাই নিয়ে বাবা হইচই শুরু করায় আমাকে ভিড় ঠেলে তার দিকে এগিয়ে যেতে হল। গরু কুরবানির ঝামেলা শেষ হওয়ায় আমি আবার ফিরে এলাম সেখানে, যেখানে দাঁড়িয়ে মেয়েটার সাথে কথা বলছিলাম।
কিন্তু আর খুঁজে পেলাম না তাকে। কি করেই বা পাব? সে বেরিয়েছে এডভেঞ্চার করতে। একজায়গায় গরু কুরবানি হয়ে গেলে অপরিচিত আরেকবাড়ি যাবে, এমনই নিশ্চয় তাদের প্ল্যান ছিল। আমার জন্যে তো তার অপেক্ষা করবার কথা নয়।
তবু মনটা কেমন যেন বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিল।
মেয়েটার নামটা পর্যন্ত জানতে পারি নি। আর একবারমাত্র চেহারা দেখেই তা মনে রাখা তো অসম্ভব। তার ওপর তখন দুজনেই ছিলাম টিনএজার। আর এখন কেটে গেছে আট-নয় বছর। বদলে গেছে উভয়েরই মুখের গড়ন এবং চেহারা।
তাই আজ দেখলেও তাকে চেনার বা তার আমাকে চেনার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। সেজন্য আজ আমার পড়ালেখার সুবাদে দুজনে একই শহরে বাস করায় কতবারই হয়ত তাকে দেখেছি কিন্তু চিনতে পারি নি।
আমার মেয়েটাকে নিয়ে এতসব লেখার যথেষ্ট তাৎপর্য আছে। মেয়েটাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম তখন শুধুই তার রূপে বিমোহিত হয়েছিলাম। ভালবাসা কি তা তখনো বুঝি নি।
তবু আজ এখনো প্রেমহীন এ জীবনে কল্পনায় কোন মেয়েকে নিয়ে ভাবতে বসলে সেই একবারের দেখা মেয়েটার আবছা, ভুলে যাওয়া মুখাবয়বই ভেসে ওঠে। আফসোস হয়, কেন মেয়েটার নামটা অন্তত জেনে নিলাম না!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।