আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কিংবদন্তির কোলে দুই বছর- সুমন জাহিদ (ব্যাচ-৯১) - দ্বিতীয় পর্ব



ডিপার্টমেন্টের পিয়ন আমাকে ক্যান্টিন থেকে ডেকে নিয়ে গেল। ম্যাডামের সামনে অপরাধীর মত মাথা নীচু করে আছি। ‘কিরে মুখটা কালো কেন?’ আমি চান্স পেয়ে প্রসঙ্গ বদল করার চেষ্টা করলাম, ‘ম্যাডাম ক্ষুধা লাগছে কিন্তু পকেটে টাকা নাই!’ এই প্রশ্রয়টুকু ম্যাডামের কাছে আরো আগেই পেয়েছিলাম। ম্যাডাম তার ভেনিটি ব্যাগ খুলে ৫০ টাকা দিলেন এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে বেশ গর্বিতভাবেই অন্য স্যারদের আমার উত্তরপত্রটি দেখালেন। বললেন ‘সুমনরে তুই যদি আর কিছু দিন আগে আসতি, ভূগোলে তুই হাইয়েস্ট মার্কস পেতি! তুই বাবা আর কয়েকটা দিন বাসায় আয়, দেখি কতটুকু ওভারকাম করানো সম্ভব!’ ক্লাশ করেনি বলে ফাইনাল পরীক্ষার প্রাক্টিক্যালে পুরো নম্বর পায় নি, তবে মোট নম্বর যা পেয়েছিলাম ম্যাডাম বেশ খুশীই হয়েছিলেন।

কলেজে পলাশ নামে আমার একটি বন্ধু ছিল, এখন ইউনিসেফের কর্মকর্তা। ওর ভালো নাম মোঃ জাহিদুল হাসান ; কবিতা লিখে ‘জাহিদ উল হাসান’ নামে। ছোটবেলা থেকেই জানতাম লেখকরা এক বা একাধিক নাম কিংবা ছদ্মনামে লেখে। সুতরং আমরাও যেহেতু একদিন বিখ্যাত হবো সুতরং একটু আনকমন, শ্রুতিমধুর নাম নিলে অসুবিধা কোথায়! আমার আকীকাকৃত নাম মোঃ জাহিদুল ইসলাম ডাক নাম সুমন। সুমন নামটার মত এতটা কমন নাম আমাদের প্রজন্মে ছিল না বললেই চলে।

স্কুল জীবনেও সুমন নামের ৪/৫ জন ছিলাম একই ক্লাশে, আর গোটা স্কুলে কয়েক ডজন সুমন ছিল। স্কুলের বন্ধুরা আমাকে জাহিদ সুমন নামে ডাকতো। আমিও ওয়ন ফাইন মনিং ‘জাহিদ সুমন’কে উল্টে ‘সুমন জাহিদ’ হয়ে গেলাম। বোদ্ধা বন্ধুরা দুই একজন নাক সিঁটকালো কিন্তু অধিকাংশই বাহাবা দিল। বিভিন্ন অখ্যাত পত্রিকায় গল্প কবিতা ছাপা হতে শুরু করলো।

সেই সঙ্গে রাতারাতি সাংবাদিকও বনে গেলাম। ‘এখনই সময়’ ও ‘আসে দিন যায়’ নামে দুটি সাপ্তাহিকে বিনা পারিশ্রমিকে ঢাকা কলেজ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করেছি। দৈনিক পত্রিকা ও সাপ্তাহিক মনোরমায় ও নিয়মিত লিখতাম। মনোরমা অফিসে যেদিন প্রথম গেলাম গিয়ে দেখলাম সম্পাদকের চেয়ারে বসা রিটন ভাই। তার টেবিল গ্লাসের উপরে মার্কার দিয়ে বড় করে লেখা ‘ভাংতে চাইলে চাপ দিন’।

ব্যাপক মজা পাইলাম। প্রথম ৬/৭ মাস ইচ্ছাকৃতভাবেই কোন রাজনৈতিক সংগঠনে জড়াই নি। যেহেতু সাংবাদিক তাই সব খোঁজ খবর রাখতাম, এমনকি গ্রুপিং-লবিং সম্পর্কেও স্বচ্ছ ধারণা ছিল। এদিকে ডাকসু নির্বাচনের দামামা বাজছে। এখনই সময় থেকে বলা হলো ডাকসু কাভার করতে।

বিশাল দায়িত্ব। সকাল ১০টার ভিতরে মধুতে যাই। বড় বড় নেতাদের সাক্ষাতকার নেই। ছাত্রলীগ প্যানেল দিয়েছে ‘আলম-কামরুল-মেহেদী’ জাতীয় ছাত্রলীগ প্যানেল দিয়েছে ‘বুলবুল-কামাল-চাঁন’। ছাত্রদল দ্বিধাবিভক্ত।

কিংবদন্তি ছাত্রনেতা সানাউল হক নীরু সদ্য জেল থেকে বেরিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ছাত্র সংবর্ধনা দেয়া হলো। নীরু প্যানেল ঘোষণা করলো দুদু-রিপন পরিষদ। খালেদা জিয়া মানলেন না। ছাত্রদল তখন খালেদা জিয়ার কথায় চলে না চলে নীরুর কথায়।

খালেদা জিয়া ‘আমান-খোকন-আলম’ প্যানেল ঘোষণা করলো। সাংবাদিক হিসাবে আমিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সব প্রার্থীদের আলাদা আলাদা সাক্ষাতকার নিচ্ছি। সে এক বিশাল উত্তেজনার দিন ছিল। নেতারা অনেকেই বাই নেমে চিনে।

ইতোমধ্যেই আমি হোস্টেলে উঠেছি। ফোর সিটেড রুম। ইউসুফ স্যার আর রফিক স্যার হাউস টিউটর। হোষ্টেলের দুই কর্ণারে তাদের বাসস্থান। সাউথ হোস্টেলের নীচতলায় সম্ভবত ১০৯ নম্বর রুম।

ছাত্রদল নেতা নুরুল ইসলাম নয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মাহবুবুল হক রিপন ভাই আমার রুমে থাকে। নয়ন দা আমার দেখা অন্যতম ভালো মানুষ, পরবর্তিতে কেন্দ্রেও খুব প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। বিপ্লবী রিপন ভাই এখন পুরোই বিভ্রান্ত। দিনের বেলায় কেউই থাকি না কিন্তু প্রতি রাতেই ১০/১২ জন থাকি। অন্যান্য বৈধ রুমমেটরা নিজ ক্যারিয়ারের স্বার্থে কক্ষ ত্যাগ করেছে।

বাবা বাড়ী থেকে প্রতি মাসে ৮০০ টাকা পাঠাতো। এটি অবশ্য তৎকালীন সময়েও বেশ অপ্রতুল টাকা ছিল। হোষ্টেলের অন্যান্য ছাত্ররা গড়ে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা আনে। চাকুরিজীবি বাঙালির টানাপোড়েনের সংসার; আমরা ৪ ভাইবোন, তার উপরে প্রায় সকল নিকটাত্মীয়কে শিক্ষিত করার দায় বাবা হাসিমুখে একাই নিয়েছে। আমি টাকা পয়সার বিষয়ে বাবা-মাকে কখনই চাপ দেয়নি।

এমনকি কোন মাসে বাড়তি টাকাও নেয়নি। নিউ মার্কেট সোনালী ব্যাংকে একটি সঞ্চয়ী হিসাব খুললাম। সকাল বেলা চেক জমা দিয়ে টোকেন নিয়ে ক্লাশে ফিরতাম। একটি ক্লাশ করে আবার ব্যাংকে যেতাম টাকা তুলতে। অনেক সময় ফিরে এসেও দেখতাম চেকটি পাশ হয়ে কাউন্টারে আসেনি।

হোষ্টেলের অধিকাংশ ছাত্রই টিউশনি করে। কিন্তু কলেজে ভর্তির দু’এক মাসের মধ্যেই দেশ ও জাতির মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। টিউশনি করার সময় কোথায়। ফারুক আহমাদ নামে ছাত্র মৈত্রী থেকে যোগ দেয়া ছাত্রলীগের এক ডায়নামিক নেতা ছিলেন। খুবই জ্ঞানের কথা বলেন সবসময়।

মিছিল মিটিংয়ে টানা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন, কলেজের রাজনীতি ও সংস্কৃতির পর্দার আড়ালের এক দুর্দান্ত খেলোয়াড়। আমি মোটামুটি তার গেটিস হয়ে গেছি। ফারুক ভাই, নিপু ভাইর সাথে থেকে প্রিন্টিং ও প্রুফ রিডিং শিখে ফেলেছি। লেটার প্রেস ও অফসেট দুটোই শিখেছি। তখন অফসেট প্রিন্টিং মাত্র জনপ্রিয় হচ্ছে।

কম্পিউটার কম্পোজ করে ইচ্ছেমতন ডিজাইন করে ট্রেসিং পেপার পেষ্টিং করে প্লেট বানাতাম। আউটপুট প্রযুক্তি তখনও বের হয়নি। ফিল্টার দিয়ে কালার সেপারেশন করে ক্যামেরার মাধ্যমে ম্যানুয়াললি পজেটিভ বের হতো। কাজটা খুবই উপভোগ্য। আমার কবি বন্ধু পলাশ আর আমি মিলে ৯০ এর বইমেলায় একটি কবিতা পত্র বের করলাম।

ডিমাই সাইজের এক রঙা কাগজ। একপাশে নাম দিলাম ‘হ য ব র ল’, অন্য পাশে নাম দিলাম ‘অব্যয়’। অর্থকরী সম্ভবত পলাশই পুরোটা দিয়েছিল। হাজার তিনেক ছাপালাম। পলাশকে বললাম, আমি একাই তোকে দুই হাজার কপি বিক্রি করে দিবো, দুই টাকা করে।

তাতেই ওর সব টাকা উঠে কিছু লাভও হয়। প্রতিদিন বিকেল হলেই কয়েকশত কপি নিয়ে বাংলা একাডেমীর বই মেলায় চলে যাই। কোনদিন একা, কোনদিন পলাশ কিংবা অন্যকেউ। পুশিং সেল শুরু করলাম। একজনকে ক্রেতাকে টার্গেট করে তার সামনে গিয়ে ভুবন ভুলানো একটা হাসি দিয়ে বলি ‘আমরা ঢাকা কলেজের কয়েকজন নবীন কবি মিলে এটা বের করেছি।

কোন মূল্য নেই, আমাদের উৎসাহদিতে আপনি যা দিবেন তাতেই আমরা খুশি!’ টার্গেট মিস হয় খুব কম। এদিকে ত্রি-রতœ আমার উদ্যোগ দেখে ব্যাপক বিনোদিত হলো-‘তুমি মিয়া আসলেই একটা মাল!’ বইমেলায় আগত সকল কবি সাহিত্যিকদের বেশ কাছের মানুষ তারা, বিতলামীর জন্য বা অন্য যে কোন কারণে হোক লেখক-প্রকাশক প্রায় সবাই কম বেশী তাদের সমীহ করে। আমিও তাদের পাশেই ঘুরঘুর করি। সেলিব্রেটি বা অন্যকোন বিশেষ মানুষ দেখলে আমাকে দূর থেকে দেখিয়ে দেয়, বলে ‘উই লোকটি বা ভদ্র মহিলা হচ্ছে অমুক, যা দেহি পটাইতে পারো কিনা!’ আমি যথারীতি সামনে গিয়ে স্বসম্মানে তার নাম উচ্চারণ করে একই রেকর্ড বাজিয়ে দেই। ব্যাস কম বেশী কাজ হয়ই।

কোনবারই ফেল মারিনি। ৫ টাকা থেকে ২০, ৫০ এমনকি ১০০ টাকা পর্যন্ত কেউ কেউ দেয়। বেশ অনেক টাকা প্রতিদিন আয় হচ্ছে। বন্ধুদের নিয়ে প্রতিদিনই টাকা উড়াই। একটি দুটির বদলে ফাইভ ফাইভের আস্ত প্যাকেট কিনি।

মেলা শেষ হওয়ার আগেই আমার দুই হাজার কপি বিক্রি শেষ হয়ে গেল। পলাশ খুব খুশি। বললাম বাকী একহাজার কপির কতটি আছে? বললো প্রায় সবই আছে। শ’ খাানিকও শেষ হয়নি। এরমধ্যে আরিফ নামে কঠিন এক ধুরন্ধর, চৌকষ বন্ধু ছিল আমার।

আরিফ বললো কিরে বাকী কপিগুলো কি করবি? বললাম দেখি সামনে যে দু তিন দিন মেলা আছে তাতে যতটুকু পারি। ও বললো কালকে সকাল ১০ টার ভিতর ৫০০ কপি নিয়া আয়, আমি ৫ টাকা করে দিব, শর্ত শুধু তুই আমার সাথে থাকবি। রাতে আমার টেনশনে ঘুম হয় না ও ৫০০ কপি কারে দিবে? কীভাবে সম্ভব? যাই হোক সকাল বেলা যথারীতি ৫০০ কপি নিয়ে পলাশ হাজির। ও বললো যা করার তুই কর, বিক্রি হলে আমারে দুই টাকা করেই দিস, না হলেও কোন আপত্তি নেই কিন্তু আরিফের সাথে আমি নাই। আচ্ছা দেখিনা ও কি করে! আরিফ আমাকে নিয়ে যাদব ঘোষের মিষ্টির দোকানের পাশ দিয়ে মার্কেটে ঢুকলো।

প্রতিটি দোকানে এক কপি করে দিয়ে গেল, বললো ঢাকা কলেজ থেকে আমরা এটি বের করেছি। প্রতিটি দোকানে এক কপি করে দিয়ে যাচ্ছি, খুশী হয়ে আপনারা যা দেন। টাকাটা রেডী রাইখেন, বিলি শেষে টাকা তুলতে আবার আসছি। এ দেখি ডাইরেক্ট চাঁদাবাজী! আমি একটু পিছটান দিলাম। ‘কীরে ডরাস, আমি আছি না! আমি তো জানি কোন নেতা কোন মার্কেট থেকে কত চাঁদা নেয়! কোন সমস্যা নাই নেতারা জানলেও কিছু বলবে না, আরো ঊল্টো বলবে আমারে আগে বললেতো আমি আরও দশগুণ টাকা তুইলা দিতাম।

’ আরিফই সব বলে, আমি শুধু ওরে ফলো করি। ধানমন্ডি হকার্স আর গাউসিয়া মার্কেটে বিলি করেই সব শেষ। এরপর আবার গোড়ায় ফিরে শুরু করলাম টাকা তোলা। আরিফকে পাঁচ, দশ টাকা দিয়ে সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়। সেই রকমের ফাপড় তার! ৫০/ ১০০ টাকা ছাড়া সে হাতই আগায় না, খুব জোড়াজুড়ি করলে ২০ টাকা।

একটা কাপড়ের ব্যাগ কিনে নিলাম। তার মধ্যেই টাকা রাখি। টাকা তুলতে তুলতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। মোটামুটি এক বস্তা টাকা হলো। দুপুরে কিছুই পেটে দেয়ার সময় পাইনি।

আরো কিছু বন্ধুসহ নিউমার্কেটের ভিতরে একটি হোটেলে ঢুকলাম। পেট পুরে সবাই বিরানী খেলাম। এরই মধ্যে ও ব্যাগটা দখলে নিল। বললো এখানে বসে টাকা গোনা যাবে না। ও ব্যাগের ভিতর হাত দিয়ে খুবই গোপনে কিছু টাকা বের করে গুনে গুনে আড়াই হাজার টাকা দিল।

খাওয়া শেষে হাসিমুখে বিদায় নিলাম। তারপর অনেক দিন ওরে কলেজে দেখিনি। কতটাকা ওর লাভ হলো তা আর জানা হয়নি। এই আরিফকে একদিন আবিষ্কার করলাম বাণিজ্যমেলায়। বন্ধুরা অনেকেই টাংকি মারতে নিয়মিত মেলায় যায়।

একদিন আমাকেও নিয়ে গেল। দেখি আরিফ সেখানে। কিরে দোস্ত খবর কি? এখানে কি করিস তুই? বললো আছে কিছু ধান্ধা আছে, বলা যাবে না। আমরা প্রায় দশ বারো জন। ওরে বললাম ধান্ধা যেহেতু একটা আছে তোর, চল খাওয়া আমাগো।

ও একটু কি যেন ভাবলো। বললো ও ‘খাবি? এ আর এমন কি! চল’। মেলার ভিতর একটা হোটেলে ঠুকলাম। বাইরের হোটেলের চেয়ে যে কোন খাবারের কয়েকগুন দাম। ডবল ডিমের কয়েকটা মোগলাই পরাটা ভাগ করে খেলাম।

পরে কয়েকটা চায়ের অর্ডার দিলাম। ওয়ান ষ্টু টু করে চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছি, ও বললো ‘চায়ের পর তো আবার সিগ্রেটও খাইতে চাবি! তোরা বয়, আমি সিগ্রেট নিয়াই’। এই যে দোস্ত আমার গেল আর আসলোনা! তারপর কি আর করার, গড়তে হলো যৌথ খামার! তারপর আবার আরিফ হাওয়া। কয়েকমাস পর কলেজে এলো। সবাইতো ওরে যুৎ করে ধরলাম।

কিরে দোস্ত হয়ে তুই এমন চিটিংবাজী করতে পারলি? এতদিন কৈ ছিলি? ও নির্বিকারভাবে বললো ‘দোস্ত জেলে ছিলাম’! মানে? ‘বানিজ্য মেলার টিকিট কাউন্টারের ভিতরে আম্গো একটি চক্র আছে, আসল টিকেটের মাঝে নকল টিকিটও বিক্রি করি, শালা তোগো জন্যে সিগ্রেট আনতে গিয়াই পুলিশে কট খাইলাম। ক্যান পেপারে দেখস নায়? আর বন্ধু হয়ে তোরা একবার দেখতেও গেলি না! অথচ তোগো জন্যই কিনা...’ কি আর করা! উল্টো আমরাই মাফ চাইলাম। পরে জেনেছিলাম এটাও চাঁপা! ঢাকা কলেজের হোষ্টেল লাইফের মত বৈচিত্রময় সময় আর কখনোই আসেনি। কাউকে বলেও বুঝানো সম্ভব নয় কতটা বর্ণিল, কতটা সুন্দর, কতটা টান টান উত্তেজনায় ভরপুর ছিল আমাদের হল জীবন। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর গ্রাম থেকে আসা সবচেয়ে মেধাবীমুখ গুলো একত্রিত হয়েছে এখানে।

বিচিত্র চরিত্রের এক মহা মিলনকেন্দ্র। বাইরের মানুষ তো দূরের কথা বন্ধুদের ভিতরেও যারা নিয়মিতভাবে একটানা হলে থাকেনি তাদের পক্ষেও সম্ভব নয় আমাদের হল জীবনকে উপলব্ধি করার। আমাদের হোষ্টেলগুলোর মধ্যে ৪টি ইন্টারমিডিয়েট ছাত্রদের জন্য নর্থ, সাউথ, হিন্দু ও ইন্টারন্যাশন্যাল হোষ্টেল। একটি ডিগ্রী হোষ্টেল। সন্ধ্যারপর লোডশেডিং হলেই নর্থ ও সাউথ উভয় হোষ্টেলের ছাত্ররাই গালিযুদ্ধে অবতীর্ন হতো।

সাউথের সামনে দক্ষিণে একটি বস্তি ছিল। নর্থ আলারা বস্তি বস্তি বলে চিৎকার করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের চেষ্ট করতো, আর সাউথের ছাত্ররা নর্থকে উদ্দেশ্য করে মুরগী মুরগী বলে প্রত্যুত্তর দিতো। কোন এক কালে নর্থের একদল ছাত্র নাকি হোসেন আলীর মুরগী চুরি করতে গিয়ে কট খেয়েছিল। থালা-বাটিসহ যতপ্রকারের শব্দযন্ত্র হতে পারে সব নিয়েই ঝাপিয়ে পড়ে এই ওরাল ওয়ারে। পরবর্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও দেখেছি বঙ্গবন্ধু হল ও জসিম উদ্দিন হলের মধ্যে সেইম যুদ্ধ, সেইম অপবাদ! হোষ্টেলে উঠে প্রথমেই ধাক্কা খেলাম ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞা নির্ণয়ে।

মহনচাঁদ ও যাদব ঘোষের দোকানে সকালের নাস্তা কিংবা অন্যসময়ে মিষ্টি খেয়ে লিখে রাখিস বলে চলে আসতো একদল। এটা নিঃসন্দেহে অন্যায়। আরেক দল মোট বিলের ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ দিতো। এটি বোধ হয় পুরোপুরি অন্যায় নয়। ঢাকা ¯œ্যাক্সে মোরগ পোলাউ ২০ টাকা, কিন্তু হলের ছেলেদের জন্য ১৫ টাকা, এটাও গ্রহনযোগ্য।

কিন্তু অনেকে তাও দিতো না। দলবেঁধে বলাকা, মল্লিকায় ছবি দেখা ছিল আরেকটি বিনোদন। ২০ জন দেখলে ৫টা টিকিট কাটতাম। বলাকা হলে কিছুদিন পরপর মারামারি লাগতো। আল মল্লিকায় নিয়ম করা হলো একমাত্র পলভাইর পাশ ছাড়া সিনেমা দেখা যাবে না।

পল ভাই অবশ্য দিল দরিয়া মানুষ কাউকে বিমুখ করতো না। হলের রাতের কালচার খুবই এ্যাডভেঞ্চারাস। রাত ১২ টার পর শুরু হতো বিভিন্ন অভিযান। এর একটি হলো ফুলের টব চুরি। দিনের বেলায় রেকি করে যেত।

রাত হলে ভ্যান ভর্তি করে ফুলের টব নিয়ে আসতো ফুটপাতের নার্সারি থেকে। সিদ্দিক ভাই নামের কুমিল্লা এক বড় ভাই ছিল আমাদের হলে। মোটামুটি ধনাঢ্য ব্যাবসায়ী পরিবারের ছেলে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তার মাইক্রোবাস হলে আসতো, সেটি বোঝাই করে সে ফুলের টবগুলো কুমিল্লায় নিয়ে যেত। রাতে একসাথে অনেকগুলো অভিযান চলতো।

সব অভিযান শেষ করে আমরা যেতাম মিষ্টির কারখানায়। যাদব ঘোষের মিষ্টির কারখানাটা দোকানের পিছনে কয়েকটা বাড়ি পর। সারা রাত ধরে কারিগররা মিষ্টি বানায়। পেট পুরে মিষ্টি খেতাম, দু এক কেজি নিয়েও আসতাম। আসার সময় জমিদারী স্টাইলে দু’একশত টাকা দিয়ে আসতাম কারিগরদের বখশিস হিসেবে।

কলেজের সামনেই টেম্পু ষ্ট্যান্ড। খুব সহজেই টেম্পুগুলো স্ট্যার্ট দেয়া যেত। টেম্পু নিয়ে মধ্যরাতের শহর দেখার মজাই আলাদা। এই টেম্পু নিয়েই চলে যেতাম কলেজের পিছনের নায়েমে। নানা রকমের ফুল ফলে সমৃদ্ধ লোভনীয় একটি স্থান।

টেম্পু ভরে ডাব আর কাঠাল নিয়ে আসতাম হলে। নাইট গার্ডরা উল্টো আমাদের সাহায্যই করতো। ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাসভবনটিও মধ্যরাতের বেশ প্রিয় একটি কাঙ্খিত জায়গা। ও বাসার পেয়ারা খুব মিষ্টি। স্যার একবার পুলিশ দিয়ে দাবড়ানি দিয়েছিলেন; বিনিময়ে ঝালটা ঝাড়লাম স্যারের বাসার কাচের জানালার উপরে।

স্যার পরবর্তিতে জানালার সুরক্ষার জন্য লোহার খাঁচা বানাতে বাধ্য হলো। কলেজে প্রবেশ করার পরই দেখলাম ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবীতে সব সংগঠন যুগপৎ আন্দোলন করছে। ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরেই ঢাকা কলেজের অবস্থান। তাই স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার কিছুতেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে রাজী নন। আমাদের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন আবুল হোসেন স্যার।

খুবই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, কড়া মেজাজের মানুষ। এরশাদের প্রিয়ভাজন মানুষ হিসেবে তার দুর্নাম ছিল। কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী না যেন অন্য কোন মন্ত্রী প্রধান অতিথি। কলেজ মাঠে বিশাল সামিয়ানা টানিয়ে অনুষ্ঠান হচ্ছে।

এদিকে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবীতে উত্তপ্ত শ্লোগান দিয়ে এক একটি মিছিল আসছে! বিশাল চিৎকার, চেচামেচি! কারো কথা কেউ শুনছে না! এরই মধ্যে মিছিল থেকে একটি জুতা এসে পড়লো অতিথিদের টেবিলের উপরে। শ্লোগান উঠলো ‘এরশাদের দালালেরা, হুশিয়ার সাবধান!’ ‘যে করবে দালালী, তার মুখে চুনকালী!’ ‘দালাল প্রিন্সিপ্যালের, পদত্যাগ চাই’..। ব্যাস শুরু হয়ে গেল দৌড়াদৌড়ি। পুলিশ স্কোয়াড করে অতিথিদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে গেল। একদল ছাত্র চলে গেল প্রিন্সিপ্যালের বাসা ভাঙচুড় করতে।

দরজা জানালার কাঁচ ভাঙা হলো, গাড়ী ভাঙা হলো, স্যারের ড্রয়িং রুম তছনছ করা হলো, সেখান থেকে কডলেস টেলিফোন সেট, দেয়াল ঘড়ি, বিভিন্ন শো-পিস যে যেভাবে পারে নিয়ে গেল। সবশেষে জানালার পর্দায় আগুন দেয়া হলো। অবশ্য পরিবারের সদস্য বা অন্য কেউ আহত হয় নি। আগুনও দ্রুত নিয়ন্ত্রন করা হয়েছিল। সেই কডলেস ফোনটিতে কয়েন বক্সের টেলিফোন লাইন সংযুক্ত করে আমরা রুমে বসে কথা বলেছি দিনের পর দিন।

স্যার তারপরও অনেকদিন কলেজে ছিলেন। কলেজ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেন। স্যার বিদায় নেয়ার আগে একবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু কীসব কারনে যেন সেটি বন্ধ হয়ে যায়। শেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছিল ৮১ সালে। মনের অজান্তে ইতোমধ্যেই আমি রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছি।

ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে সাইদুল ইসলাম খান পল তখন শুধু ঢাকা কলেজই নয় গোটা এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট এলাকার শীর্ষ নেতা। মোস্তফা মোহাসীন মন্টু তখন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ডাক সাইটের নেতা ও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের প্রধান অভিভাবক। জাভেদ মঞ্জুরুল ইসলাম অশ্রু আমাদের সময়ের সবচেয়ে ড্যাশিং হিরো। বাবু নামের তিনজন ছাত্র নেতা ছিলেন। তিনজনই খুব সুদর্শন, স্মার্ট।

ক্লাসিক বাবু (ক্লাসিক কোচিং এর মালিক), ভ্যবলা বাবু-তাকে পরে ইনডেক্স বাবুও বলা হতো, অশ্রুভাইর হরিহর আত্মা, আর ছিলেন ছিলেন আফজাল বাবু। তখন আমরা খুব গ্রুপিং করতাম। একদিকে ছিল ‘জসিম গ্রুপ’ আরেক দিকে ‘মজিদ গ্রুপ’। অবশ্য দুজনেই কলেজের সাবেক নেতা। জসিম ভাইরা ‘আমরা কজন মুজিব সেনা’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরী করেছিল।

আফজাল বাবু, কায়কোবাদ, চিনু, সংগ্রাম- ভাই এরা সবাই জসিমগ্রুপের ভ্যানগার্ড। জসিমভাই গাউসিয়ায় টাওয়ার নামে একটি টেইলার্স দিয়েছিলেন। ওখানেই তাদের গোপন মিটিং হয়। তারা খুব ডেডিকেটেড। বিরোধীরা তাদের দর্জি বাহিনী বা আমতলা গ্রুপ বলে স্টাবলিশ করতে চেয়েছিল।

মজিদ গ্রুপ বলতে যা বুঝায় তা হলো এন্টি জসিম গ্রুপ। জসিম গ্রুপকে ঠেকানোর জন্য রেষ্ট অফ অলের মধ্যে একটা ঐক্য ছিল। লিয়াকত শিকদার ছিলেন এই গ্রুপের প্রধান গেইম মেকার। ফুল টাইম পলিটিশিয়ান, একাই মাঠ গুছাতেন; তার হাতেই কলেজে ছাত্রলীগের গ্রাসরুট বর্ধিত ও শক্তিশালী হয়। পর্দার আড়ালে থাকতে পছন্দ করেন।

নিজে কোন পোষ্ট-পজিশন প্রার্থী নয়, প্রিয় বন্ধু অশ্রুকে প্রতিষ্ঠিত করাই যন তার একমাত্র আরধ্য। লিয়াকত ভাই এক্ষেত্রে সফলও হয়েছিলেন; কিন্তু ঘাতক বুলেট অশ্রু ভাইর জীবন অকালেই কেড়ে নিল। অন্যান্য অনেক সিনিয়র নেতা ছিলেন- শামীম, কবীর, অলোক, মিজান, শাহেদ, সাঈদ..প্রমুখ ভাইরা। এরা সবাই নিঃসন্দেহে যোগ্যতর সংগঠক ও ত্যাগী ছাত্রনেতা। আর ফারুক ভাইর কথা তো আগেই বলেছি।

তবে সবার চেয়ে তিনি বোধহয় একটু বেশী বুদ্ধিমান। কেননা সাংস্কৃতিক অঙ্গন, জাসদ ছাত্রলীগ কিংবা ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে তার একটি অভাবনীয় প্রভাব ছিল। উনিও এন্টি জসিম কিন্তু পল-অশ্রু পন্থীও নয়। নবাগত বলে তাকে কেউ বিশ্বাস করতো না একমাত্র আমি আর অলোক’দা ছাড়া। পরবর্তিতে ফারুক ভাই রাজনীতি থেকে এমনকি পরিচিত গন্ডি থেকেও হারিয়ে যায়।

বিভিন্ন প্রকার মিশ্র কথা বার্তা কানে আসে। তবুও বলবো, ‘যদ্যপি আমার গুরু শুড়িখানায় যায়; তদ্যপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়!’ ছাত্রদলের নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন বোধহয় তুলা ভাই। চাপ দাড়ি সম্বলিত লেদার জ্যাকেট গায়ে, খাট করে একটু গম্ভীর টাইপের ভদ্রলোক। কলেজের প্রধান ফটকের সামনে বাংলার পাপ্পুভাই আলাপ করিয়ে দিলেন, সুমন এই হচ্ছে দুলা ভাই। আমাদের কলেজের অনেক বড় ছাত্রদলের নেতা।

আমি হাত মিলালাম। বললাম পাপ্পুভাই আপনার দুলাভাই! যেহেতু এখনও রাজনীতি করে তারমানে প্রেমের বিয়ে! পাপ্পু ভাই বললো আরে না মিয়া, আমার দুলাভাই না, উনার নামটাই হচ্ছে তুলা ভাই। আমি আবারও দুলাভাইই শুনি। দুলাভাই আবার কারো নাম হয়! পরে বানান করে আমার ভুল ভাঙালো। তুলাভাই পরে এমপিও হয়েছিলেন।

ছাত্রলীগের ক্ষমতার উৎস যেমন এ্যালিফেন্ট রোড, ছাত্রদলের তেমনি আজিমপুর। আজিমপুরের শামীম ভাই নামে ঝাকড়া চুলের একজন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ছিলেন। অল্প কিছুদিন আমরা পেয়েছিলাম। তারপর আর তাকে দেখেনি। জাতীয় পার্টির সময় সরোয়ার নামে একজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ছিল কলেজে।

তিনিও আজিমপুর-লালবাগ এলাকার গডফাদার। বিখ্যাত মরন চাঁদ মিষ্টান্ন ভান্ডারের প্রধান শাখাটি ছিল কলেজের উল্টো দিকে। এই সরোয়ারের একক অত্যাচারে মরন চাঁদের প্রধান শাখাটির মৃত্যু হলো। নগদ ক্যাশ ছাড়াও প্রতিদিন একমন মিষ্টি বখরা দিতে হতো সরোয়ারকে। কলেজের ছাত্রদল মূলত সপু-নেওয়াজ ভ্রাতৃদয়ের একক নিয়ন্ত্রণে।

সরোয়ারের সাথে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করে তারা কলেজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ছাত্রলীগের প্রধান আক্রমনের টার্গেট ছিলো সপু-নেওয়াজ। সপুভাই দীর্ঘদেহী মানুষ, দেখতে ছাত্রনেতা বলে মনে হয় না, জাতীয় নেতা মনে হয়। তাদের নামে বিভিন্ন প্রকার কুৎসা রটানো হতো। কিন্তু বেশ কাছ থেকেই তাদের আমি দেখেছি।

তেমন কোন বিচ্যুতি আমি অন্তত দেখিনি। সকল সংগঠনের মধ্যে সপু ভ্রাতৃদ্বয়ই ছাত্র রাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতিতে সবার আগে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ছাত্রদলের আরেক ত্যাগী সংগঠক ছিলেন আউয়াল ভাই। হারুন ভাইও খুব পলিটিক্যাল কিন্তু বেচারা একাই খালি নির্বাচনে হেরে যায়। ছাত্র ইউনিয়ন ও জাসদের সাংগঠনিক অবস্থা বেশ দুর্বল।

ফারুক ভাইর দুই গেটিস মাহবুবুল হক রিপন আর খুররম ভাই সংগঠন দুটির প্রধান সংগঠক। আমার ব্যক্তিগত জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন ১৯৯০। দশ বছর বিরতির পর প্রথম নির্বাচন। ডাকসু নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর আওয়ামীলীগের কাছে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর নির্বাচন। বিএনপির কাছেও তাই।

কেন্দ্রীয় ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্রলীগের চেয়ে ছাত্রদলের ঢাকা কলেজের উপর আত্মিক টানটা একটু বেশী। কেননা তৎকালীন ছাত্রদলের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতারা ঢাকা কলেজের সাবেক ছাত্র। ছাত্রলীগ থেকে পল-অশ্রু-ভুলু ও ছাত্রদল থেকে সপু-জাকির-সোহাগ পরিষদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। ফারুক ভাই ভিপি নমিনেশন পেতে ব্যর্থ হয়ে তাকে ছাত্রলীগ প্যানেলের নির্বাচন পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়। ডাকসুতে যেহেতু ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়নি সুতরং ঢাকা কলেজেও এর ব্যতিক্রম নয়।

ছাত্র ইউনিয়ন ও জাসদ আলাদা প্যানেল দেয়। সকল সংগঠনেই ইন্টারমিডিয়েট থেকে শুধু এজিএস ও দু’একটি সম্পাদকীয় পদ দেয়া হয়। মাসুদ ছাত্রলীগের এজিএস পদপ্রার্থী কিন্তু জোসেফহাইড। সংখ্যাগরিষ্টতায় ল্যাবরেটরিয়ান হিসেবে বন্ধু ভুলু নমিনেশন পায়। ছাত্রদলেও ক্যাচাল বাঁধে।

ল্যাবরেটরিয়ানরা যেহেতু ছাত্রলীগ বেশী করে। ছাত্রদল গেল ভিন্ন ফর্মুলায়। তারা জোর দিল মফস্বলের ভোটারদের প্রতি। নর্থ হোস্টেল থেকে কমার্সের সোহাগকে তারা নমিনেশন দিল। আর জিএস প্রার্থী জাকির ভাইও হলে থাকে, লক্ষীপুরের ছেলে; সেও একটু ফারুক ঘেষা।

আমি ইতোমধ্যে সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। ৯০’র স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ছাত্রলীগ থেকে ‘চাই আলোকিত ভোর’ নামে ক্রাফ্ট কাগজে লেটার প্রেসে ছেপে একটি কবিতাপত্র বের করলাম। পলভাই অর্থ সংস্থান করে দিলেন। বেশ সুন্দর হয়েছিল। কয়েকটি দেয়াল পত্রিকা ও স্বাধীনতা দিবসে একটি মুক্তিযুদ্ধের আলোক চিত্র প্রদর্শনী করেছিলাম।

এ ছাড়া কবিতা পরিষদ থেকেও দুএকটি জমজমাট অনুষ্ঠান করেছিলাম। কবিতা পরিষদের ঢাকা কলেজের সম্মেলনে কবি শামসুর রাহমান এসেছিলেন প্রধান অতিথি হিসেবে। আমাকে জিগ্যাসা করা হলো কোন পদ চাই। আমি বললাম আপনারা যেটা ভালো মনে করেন। সবাই ধরে নিল আমি সাহিত্য সম্পাদকই হতে চাই।

কিন্তু আইডিয়াল স্কুলের খান মোহম্মদ শামীম আজিজ ঐ পদে প্রার্থী হলো। শামীম আবার পল ভাইর কাছের মানুষ, হেভী ওয়েট প্রার্থী। শামীম ও প্রথম এজিএস প্রার্থী ছিল। বিকেলে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে গেলাম আড্ডা দিতে। ত্রি-রতœকে বললাম সমস্যার কথা।

রিটন ভাই আর আমীরুল ভাই দুজনেই সমস্বরে বললো ‘তুমি তো হালা বরিশাইল্লা ভোদাই। সাহিত্য সম্পাদক হইতে যাইবা কোন দুঃখে। দুই বৎসর পর কোন হালায় তোমারে মনে রাখবো? মিয়া তুমি হইবা বার্ষিকী সম্পাদক। এমন একটা বার্ষিকী বাইর করবা যাতে কলেজটা যতদিন থাকে তোমার নামও ততদিন সবাই লইবো। গান্ডুষ কোথাকার!’ কলেজে ফিরে শামীমরে বললাম ‘বন্ধু বইলা কথা, তুই যেহেতু সাহিত্য সম্পাদক পদটি চাচ্ছিস যা বন্ধুত্বের জন্য সেক্রিফাইস করলাম, আমি বার্ষিকী পেলেও খুশী’।

শামীম ও খুশী। আমাদের বন্ধুদের ভিতরে আখলাক চৌধুরী পেয়েছিল পূর্ণ সম্পাদক, ক্রীড়া সম্পাদক। আখলাকরা ১০/১২ ভাই বোন। বাপসহ সকলেই জাতীয় পর্যায়ের টেনিস প্লেয়ার। ওর বাবা এসপি পি ছিলেন, জিয়াউর রহমানের আমলে চাকুরী হারান, অফিসার্স ক্লাবের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক।

কঠিন আওয়ামীলীগার। যেকোন প্রকারের পুলিশী ঝামেলায় পড়লে আখলাকের বাবাই ছিলেন আমাদের অন্যতম ত্রাণকর্তা। কলেজের উল্টোদিকের গলিতে ছিল কামরুল ভাইর মৌসুমী প্রিন্টার্স। অফসেট প্রিন্টিংয়ের কাজ কামরুলভাইর ওখান থেকেই করতাম। খুবই হেল্পফুল, মাই ডিয়ার টাইপের মানুষ।

ফারুকভাই সব প্রার্থীর দলীয়ভাবে একক পোষ্টার করে দিলেন। আমার প্রতিপক্ষে ছিলেন ছাত্র দলের অনেক বড় নেতা হারুন ভাই ও ছাত্র ইউনিয়নের চঞ্চল ভাই। আমার কোন অর্থকরি নেই। অবশ্য অর্থকরীর প্রয়োজনও বোধ করিনি। আমি শুধু স্কুল জীবনে যে সমস্ত সাংস্কৃতিক সনদ অর্জন করেছিলাম সেগুলো ও বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় যে লেখাগুলো ছাপা হয়েছিল তা দিয়েই কয়েকটা ডিসপ্লে বোর্ড তৈরী করেছিলাম।

চারুকলার হোস্টেলে আমি প্রায়ই বড়ভাইদের সাথে আড্ডা দিতে যেতাম। লিটুভাই, রবিদা, সুব্রত দা, মিলন কান্তি আরো পরে ধ্রুব দারা ছিলেন। আমার নির্বাচনে তারা বিনা পারিশ্রমিকে দিয়াল লিখন করে দিলেন। ছড়াকার ত্রয়ী আমার জন্য ছড়া লিখলেন, বড় বড় কবিরা আশাবাদ ব্যক্ত করলেন, তা দিয়ে একটি প্রচারপত্রও তৈরী করলাম। আমাদের সকলেরই খুব আত্মবিশ্বাস ছিল পূর্ণ প্যানেলে জয়ী হবো।

অশ্রুভাই বলতো, ‘আমরা তো জীতবই! তবে প্রশ্ন হচ্ছে কত ভোটের ব্যবধানে জীতবো?’। প্রতিদিন ভোটার লিস্ট নিয়ে আট দশটি গ্রুপ ক্যাম্পেইনে বের হয়। মৌসুমী প্রিন্টার্সে ঢোকার আগেই ছিল হোসেন আলীর মুরগীর আড়ত। তার উপরে খাবার হোটেল। এর আগে ছাত্রলীগের নেতাদের হাজার হাজার টাকা বাকী ছিল ঐ হোটেলে।

নির্বাচনের সময় নিয়ম করা হলো পরিচালনা পরিষদের স্লিপ ছাড়া কোন খাবার যাবে না। সাধরণ ভোটাররা আসলে তার খাবার ফ্রি। প্রতি বেলায় কয়েকশত প্লেট খাবার যেত। সে সময়ে শুধু খাবার বিলই হয়েছিল লক্ষাধিক টাকা। আমি আবার হোস্টেলে থাকি, মানবিক বিভাগের ছাত্র।

যার কারনে আমার সহপাঠিরা আমার নির্বাচনকে সবাই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিল। নির্বাচন উপলক্ষে বিচিত্র ধরনের প্রচারনায় নেমেছিলেন প্রার্থীরা। অশ্রু ভাইর বন্ধু বাবু ভাই মিলনায়তন সম্পাদক প্রার্থী, নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি একটি টেলিফোন ইনডেক্স ভোটারদের উপহার দিলেন। তারপর থেকে ভ্যাবলা বাবু থেকে নাম হয়ে গেল ইনডেক্স বাবু। নির্বাচনের প্রায় সকল মেকানিজম লিয়াকত ভাইর হাতে করা।

লিয়াকত ভাই পরবর্তিতে ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছিলেন। তার ঘনিষ্ঠ মানুষরা অনেকেই বিভিন্ন হিসাব নিকাশে দূরে সরে গেছেন। কিন্তু আমি লিয়াকত ভাই তুল্য আর কোন সাংগঠনিক দ্বিতীয় নেতা পাই নি। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ভিতরে অনেকেই ভুলু, শামীম, আখলাক, শহীদ, মনির, রহমত, বিপ্লব মোস্তাফিজ, রিমু, হুমায়ুন, গিরিংগি টিটু, শাহেদসহ ১৩/১৪ জন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র হিসেবে ছাত্রলীগের প্যানেলে বিভিন্ন পদে নির্বাচন করলো। বন্ধুদের ভিতরে আহমেদ রশীদ জয় ছিল আমাদের মধ্যমনি।

জয় আর রিমুর বাসার দরজা ছিল আমাদের জন্য সার্বক্ষণিকভাবে উম্মুক্ত। জয়কে নমিনেশন দেয়া হলো না। আমরা সবাই ক্ষুব্ধ। পলভাই বললো অস্থির হওয়ার কিছু নাই জয় তোদের চেয়েও বড় নেতা হবে। ১৯৮৬ সালে ছাত্রলীগের সর্বশেষ কলেজ কমিটি হয় ‘পল-কায়কোবাদ’ কমিটি।

নেতারা বললেন ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হবে। সভাপতি, সা.সম্পাদক কে হবে জানি না তবে জয়কে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হবে। পরে ‘অলোক-মিজান-জয়’ কমিটি করা হয়েছিল। জয় এখন বিশ্ব ব্যাংকের কর্মকর্তা। ছাত্রদলের প্যানেলে সোহাগ, বাণী, আতিক, সোহেল, শহীদ, খালেদুনসহ ৮/৯ জন বন্ধু ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র হিসেবে মনোনয়ন পায়।

ভিপি, জিএসসহ অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ পদেই অনার্সের বড় ভাইদের দখলে ছিল। সব দলের কেন্দ্রীয় নেতারা মধুর ক্যান্টিন ছেড়ে ঢাকা কলেজে পড়ে থাকে। স্বীকার করতে অসুবিধা নেই শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, ঢাকা শহরের যত রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা ছিল সবাই যুদ্ধাংদেহী প্রস্তুতি নিয়ে কলেজে মহড়া দিতে থাকে। ছাত্রলীগ অবস্থানগতভাবে সুবিধাজনক স্থানে ছিল। হাবীব-অসীম, আলম-কামরুলসহ বড় ছাত্রলীগ নেতারা নিয়মিত কলেজে আসতে শুরু করলো।

প্রতি সন্ধ্যায় মন্টুভাইর বাসা থেকে নেতারা নির্দেশণা নিয়ে আসে। ছাত্রদলের প্রধান প্রধান নেতা নীরু-বাবলু, অভী-ইলিয়াস, আমান-খোকন, মালেক-রতন-মিলনসহ তৎকালীন নেতাদের মধ্যে ইলিয়াস আলী ও খোকন ছাড়া জানামতে সবাই ঢাকা কলেজের সাবেক ছাত্র। নীরু-অভী সম্ভবত তখন আবার জেলে। অন্য সকল নেতারা সকাল বিকাল কলেজে আসতো। ১২ সেপ্টেম্বর নির্বাচনের মাত্র চারদিন আগে তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ এক বন্ধুক যুদ্ধ হলো কলেজ প্রাঙ্গনে।

জীবনে প্রথম বার সরাসরি বন্দুক যুদ্ধ দেখার অভিজ্ঞতা। কলেজের মাঠের দক্ষিণ পাশে ছাত্রদল ও উত্তরের গেটে ছাত্রলীগ। দুই দিক থেকেই মুহুর্মুহু গুলি আসছে। প্রচন্ড শব্দে আগুনের ফুলকির মত গুলি বের হয়। যোদ্ধারা ক্রোলিং করে শুয়ে শুয়ে বন্দুক চালাচ্ছে।

আমরাও সবাই মাটিতে শুয়ে পরলাম। কালো সেন্টুভাই, রাজা ভাই, মাঈনুদ্দিন ভাই, সাব্বিরভাইসহ অনেক বড় বড় নেতাদের সেদিন দেখেছিলাম। কিন্তু যোদ্ধাদের কাউকেই তেমন চিনি না। সেন্টুভাই ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলায় প্রান দিলেন। ছাত্রদলের ব্রান্ডেড প্রায় সকল নেতাই সেদিন কলেজে এসেছিলেন।

নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ঐদিন সন্ধ্যায়ই আবার দুই দলের মীমাংসা হয়ে গেল। পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক হয়ে আসলো। পরদিন আবার নির্বাচনী প্রচারনায় সবাই মেতে উঠলো যেন কিছুই হয়নি গতকাল।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.