আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কিংবদন্তির কোলে দুই বছর- সুমন জাহিদ (ব্যাচ-৯১)- শেষপর্ব



সিগেরেটের খরচ কমানোর জন্য মিক্সার কিনলাম। এরিনমোর সুগা, মিক্সার মেশিন ও সিগার পেপার। জানতাম বঙ্গবন্ধুও খেত। তারমত করে একটা পাইপও কিনলাম। হেভী ষ্টাইল করে মিক্সার খাই।

চিলেকোঠার জানালা খুললেই বুড়িগঙ্গা, দখিনা হাওয়ায় ঘর ভরে যায়। বুড়িগঙ্গা তখনো এতটা ধর্ষিত হয়নি যে পানি থেকে গন্ধ বেড়োবে। পাশের রুমে ইলা নামে বেশ মিষ্টি একটি মেয়েও পরীক্ষার্থী। শাকিলের সাথে তার দুষ্টমির সম্পর্ক। আমরা তিনজন ১০ টাকা ঘন্টা হিসেবে নৌকা ভাড়া করে নৌকায় বসে পড়তাম।

সে এক মহা রোমান্টিক প্রস্তুতি। শাকিলের বড় মামা ছিলেন এসপি পরবর্তিতে সিএমপি কমিশনার আবার ছোট মামা লিটন পুরাই উল্টা ও উড়াধুড়া। বহুত ঝুমের লোক। লিটন মামার এক বন্ধু আসতো, ইউরোপের প্রায় সকল কারাগারে নাকি তার জেলখাটার অভিজ্ঞতা আছে। অবশেষে পরীক্ষা শুরু হলো।

বিজ্ঞান কলেজে সিট পড়েছে। ফরিদাবাদ টু ফার্মগেট-অনেক দূরের পথ। দুই বন্ধু দুই ঘন্টা আগে ভেঙে ভেঙে রিক্সা জার্নি করে পরীক্ষা দিতে গেলাম। পরীক্ষার হলে আলতাফুন্নেছা ম্যাডাম আসলেন আমাকে সাহস দেয়ার জন্য। প্রথম দিনের পরীক্ষাটা ভালোই হলো কিন্তু পরীক্ষা শেষে কি এক ঘটনা নিয়ে লংকা কান্ড; ফলাফল হিসেবে বিজ্ঞান কলেজ ভাংচুর।

ঢাকা কলেজের এই একটি বদনাম আর ঘুচানো গেল না। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে! কয়েক মাস আগে টেলিভিশনে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, হলিক্রসের সাথে। হলিক্রসের দলনেতা বন্ধু লায়লা পরবর্তিতে বাংলাদেশের প্রথম নারী রুড্স স্কলার, প্রেম করে আমাদের আরেক স্কলার বন্ধু নটরডেমের রোমেলের সাথে। আর আমাদের ঢাকা কলেজের দলে মহা ফাজিল বন্ধু তুরিন, আয়াজ ও শাহেদ। তিনটাই এখন বিদেশের মাটিতে বড় ডাক্তার।

যাইহোক বিতর্ক যতটা জমলো, তার চেয়ে বেশী জমলো দর্শক সারির চেঁচামেচি ও উত্তেজনা। হলিক্রসের জয় হলো। পোলাপান বিক্ষুব্ধ হয়ে মহা আনন্দে বিটিভির ষ্টুডিও ভবন ভাংচুড় শুরু করলো। যাইহোক শাকিলের বাসায় বসেই পরীক্ষা দিচ্ছি। ছেলেদের কষ্টের কথা ভেবে শাকিলের মা বাড়ী থেকে এলেন।

চিরায়ত বাঙালি রমনি। আমাদের খাওয়া দাওয়ার মান অনেক উন্নত হলো। খালাম্মাকে কদমবুচি করে রোজ পরীক্ষা দিতে যাই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটের এক ছাত্র আমাদের কলাবাগানের আরেক বন্ধু নটরডেমের বাবলুকে পড়াতো। জয় সেই স্যারকে ১৫ দিনের চুক্তিতে নিয়ে এলেন।

স্ট্যাট পরীক্ষার আগে শাকিল আর ওর মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জয়ের বাসায় উঠলাম। জয়ের বাসার পরিবেশের সাথে আমি ও আমার বন্ধুরা অনেক আগে থেকেই পরিচিত। আমরা পরিসংখ্যানে মনেনিবেশ করলাম। জোড়া তালি দিয়ে যতটুকু শেখা গেল। জয় যেহেতু বাই বর্ন মেধাবী, তাই জয়ই আমার সার্বক্ষণিক শিক্ষক হলেন।

দীর্ঘ ১৫ দিনের টানা প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা হলে গেলাম। গিয়ে দেখি অনেকে কান্নাকাটি শুরু করেছে। উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন। কোনমতে ডান বাম পিটিয়ে পরীক্ষা দিলাম। প্রায় ১৫/২০ মার্ক ছেড়েই দিলাম।

ওটাই ছিল মূলত শেষ পরীক্ষা। তারপর শুধু প্রাক্টিক্যাল। জয়ের বাসা থেকে বিদায় নিয়ে হলে ফিরলাম। এখন শুধু ধ্যান জ্ঞান বার্ষিকী। ঢাকা কলেজের ইতিহাস নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে অনেক বিচিত্র ধরনের তথ্য পেয়েছি।

এমনিতে এটা সর্বজনবিদিত ছিল এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেটি প্রতিষ্ঠালগ্নথেকেই অন্তত আমাদের সময় পর্যন্ত একক ও আনপ্যারালাল শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন। বাংলাদেশে এমন কোন সেক্টর নেই যেখানে ঢাকা কলেজের সাবেকরা নেতৃত্ব দেয় না। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাস নিয়ে কোন কাজই খুঁজে পাওয়া যায় না। ইলিয়াস স্যার কে বললাম, স্যার কলেজের ইতিহাসটি উদ্ধার করা প্রয়োজন। কিন্তু কিভাবে? স্যার বললেন ইতিহাসবিদদের সাথে আগে যোগাযোগ করো।

সায়ীদ স্যার জানালেন ১৯৮৭ সালে ঢাকা কলেজের প্রাক্তন ভাইস প্রিন্সিপ্যাল হাবীবুর রশীদ স্যার দৈনিক বাংলাতে ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি সংখ্যায় ঢাকা কলেজের প্রথম দিককার ইতিহাস লিখেছিলেন। কিন্তু স্যার মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। লিংক দিলাম। খাইটা খাও। বিচিত্রা অফিসে যাওয়া আসা ছিল।

সেই সুবাদে দৈনিক বাংলায় কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে আমলাতন্ত্রের লাল ফিতার দৌরত্ম দেখে নিরাশ হলাম, কিন্তু হাল ছাড়লাম না। কয়েকজন ইতিহাসবিদের সাথে যোগাযোগ করলাম লাভ হলো না। কোন এক রেফারেন্সে ইস্কাটন গার্ডেনে মুনতাসির মামুন স্যারের কাছে গেলাম। স্যার শুনে বললেন কলেজকে বল ফান্ড এ্যারেঞ্জ করতে, গবেষণা করে ইতিহাসটা উদ্ধার করা যাবে। এদিকে বাজেট মাত্র বিশ হাজার টাকা।

মান সম্পন্ন বার্ষিকী মানে কয়েক লাখ টাকার মামলা। টাকার বিষয় কি করা যায়? একদিন ইলিয়াস স্যারকে বললাম স্যার আপনাকে নিয়ে একটু প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সাথে বসতে চাই। ইলিয়াস স্যারকে বললাম স্যার কথা যা বলার আমি বলবো। যদি আমার কথা যুক্তিপূর্ণ হয় আপনি শুধু সমর্থন দিয়ে যাবেন। ঢাকা কলেজের বার্ষিকী টাকার অভাবে হবে না, এটা হতে পারে না! স্যার বললেন তোমার ভাবনাটা বলো।

স্যার এক সাথেই শুনবেন। প্রিন্সিপ্যাল স্যারের রুমে ঢুকে দেখি বেশ কয়েকজন স্যার। স্যারকে বললাম আমাকে ৫ মিনিট সময় দিবেন। স্যার হেসে বললেন ৫ মিনিট কেন যত সময় লাগুক বলো না! বসি একটু পরেই বলি। অন্যান্য স্যাররা চলে গেলেন।

ভাইস প্রিন্সিপ্যাল স্যারকেও থাকতে অনুরোধ করলাম। তিনি আবার চেকের সাইনিং অথরিটি ও সংসদ কোষাধ্যক্ষ। প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে ৩০০০ কপির একটা বাজেট ধরিয়ে দিলাম। প্রায় দুই লাখ টাকার মামলা। ইলিয়াস স্যার বললেন হ্যাঁ মান সম্পন্ন একটা বার্ষিকীতে এটা তো লাগবেই।

স্যার টাকার ব্যবস্থা কি হবে? প্রিন্সিপ্যাল স্যার বললেন আমি কি করবো? আমি বললাম ‘স্যার আপনিইতো সব করেছেন। আমি একা বলে আমার ন্যায্য বাজেটের সিকিভাগও আপনি বরাদ্দ দেননি’। স্যার লাল হয়ে ওঠলো। ‘মানে? আমি কাকে টাকা বেশী দিয়েছি? প্রতিটি বিভাগে তো কম বেশী এমনই বরাদ্দ হয়েছে। আমি তোমাকে এত ভালোবাসি আর তুমি আমাকে বলছো আমি তোমার প্রতি অন্যায় করেছি’।

ইলিয়াস স্যার আমার জন্য কিছুটা বিব্রত তখন। ইলিয়াস স্যারের দিকে তাকিয়ে বললাম ‘স্যার নাথিং পারসোনাল। আপনি শুধু একটি প্রশ্নের জবাব নিন। সন্তোষজনক জবাব যদি পান বার্ষিকী আমি বাপের ধানি জমি বিক্রি করে বের করবো!’ প্রশ্নটা কি? ‘প্রতি বছর কতজন ছাত্র ভর্তি হয়? সব মিলিয়ে ধরুন ৪ হাজার। আচ্ছা ধরুন ৩ হাজার।

ভর্তির সময় বার্ষিকী বাবদ কত টাকা নেয়া হয়, ১০ টাকা। প্রতি বছর মোট ৩০ হাজার টাকা। গত দশ বছর সংসদ ছিল না, বার্ষিকীও হয় নি। ১০ বছরে বার্ষিকী বাবদ কত টাকা জমা হওয়ার কথা ৩ লাখ টাকা! আর বরাদ্দ পেয়েছি ২৫ হাজার টাকা! স্যার আপনি জবাবটা নিয়ে আসেন’। বলে আমি রুম থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছি।

প্রিন্সিপ্যাল নাজির উদ্দিন আহমেদ বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। ইলিয়াস স্যার ধমক দিলেন। সুমন একদম বাইরে যাবে না, চুপচাপ বসো। কারো মুখে কোন কথা নেই। ভাইস প্রিন্সিপ্যাল স্যার বললেন, সুমন তোমার কথা যুক্তিপূর্ণ, কিন্তু বাবা কলেজের বাৎসরিক বাজেটের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে।

কোন খাতের টাকা উদ্বৃত্ত থাকলে অন্যখাতে ব্যয় হয়ে যায়। ইলিয়াস স্যার বললেন তুমি তো ভালোই দুষ্টু। এ জটিল হিসেবটা তোমার মাথায় এলো কিভাবে? স্যার বললেন তুমি যেহেতু এতটাই ভেবে এসেছ, সমাধানও নিশ্চয় তুমি ভেবে রেখেছো। অধ্যক্ষ একটু ভরসা পেলেন। বললেন বলো কি করা যায়? এবার আমার মূল পরিকল্পনার কথা জানালাম।

স্যার কলেজের ইতিহাসটা কিছুটা উদ্ধার করতে চাই। সে তো আরো খরচের বিষয়! মুনতাসির মামুনও তেমনি বলেছেন। স্যারদের এবার প্লানিংটা দিলাম। স্যার ইতিহাসটা হবে কথ্য ইতিহাস। সাক্ষাৎরকার ভিক্তিক।

যত প্রবীন ছাত্র তত পুরনো তথ্য, ততটাই আবার তাদের ষ্টাবলিষ্টমেন্ট। যেমন আবুল খায়ের লিটুর চাচা, জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, ব্যারিষ্টার মইনুল, ভাইস প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমেদ..। হাবীবুররশীদ স্যারের লেখাটাসহ আরো যা তথ্য পাই তা কম্পাইল করে যতটুকু উদ্ধার করা যায়, শুরুটাতো হলো। আপনার স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞাপন ফর্ম তৈরী হবে। আপনি অফিসিয়াললি কিছু এপয়েনমেন্ট করে দিবেন।

বাকী দায়িত্ব আমার। এত পরিশ্রম তুমি একা কেমনে করবে? তুমি বাচ্চা ছেলে, শহরের রাস্তাঘাটই তো চিননা। স্যার চিন্তা করবেন না। বন্ধুরা আছে না! ইলিয়াস স্যার আছেন না। সাহস দেখে সবাই বেশ থমকে গেলেন।

ইলিয়াস স্যার বললেন সুমন পারবে। আরেকটি কথা আমি সকল প্রকার জবাবদিহিতা শুধু আপনাদের কাছেই করবো। সংসদের কাছে নয়। সংসদের কোন সহযোগিতা না হলেও চলবে। ডিস্টার্ব না করলেই হলো।

স্যাররা সবাই সহমত হলেন। সোহাগ তখন সংসদে আমার জন্য ষ্ট্যান্ড নিয়েছিল। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্যার থাকেন টিকাটুলি কে এম দাস লেনে। স্যারের বাহির ও ভিতর পুরোটাই এক। গৃহকর্তা হিসেবে সংসারের সকল সদস্যের সাথে সম্পর্ক যে এত মধুর, মমতাময়, স্বচ্ছ ও আধুনিক-হতে পারে না দেখলে কাউকে বিশ্বাস করানো সম্ভব নয়।

স্যারের বাসায় ঢুকলেই ‘ও গো দেখে যাও সুমন এসেছে, আমরা বারান্দায় বসলাম-তুমি ওর জন্য কিছু খাবার পাঠাও না!... আমি শুধু চা খাব, ও হ্যাঁ দিয়েসেলাইটা খুঁজে পাচ্ছিনা..নিয়ে এসোনা প্লিজ। ’ ..একদম সাদাকালো আর্ট ফিল্মের মত একটি সংস্কৃতিবান পরিবার। যাবার সময় আবার আমার ব্যাগে কয়েকটা আপেল কিংবা কমলা জোড় করে ভরে দিত, স্বাস্থ্যটাও তো দেখতে হবে! ওগো তুমি একটু ওকে বোঝাও, ছেলেটা এত পরিশ্রম করে! শোন কাজের ফাঁকে, ফাঁকে এগুলো খাবে দেখবে ক্লািন্ত আসবে না! লেখা বাছাইয়ের সমস্ত দায়িত্ব ইলিয়াস স্যারের। স্যার একদিন বললেন আমার বন্ধু সৈয়দ আলী মকসুদের কাছে ১৯৩৯ সালের ঢাকা কলেজের একটি বার্ষিকী আছে। ওখানে সৈয়দ ওলিউল্লাহর একটি লেখা আছে, পারলে দেখা করো।

মকসুদ সাহেবের বাসায় গেলাম, বললেন নোয়াখালী থেকে এই দুর্লভ লেখাটি সংগ্রহ করেছি। কম্পোজ ক্লাসিক বাবু ভাইর উপর। কারো সাথে দেখা করতে গেলেই কার্ড দেন। বাধ্য হয়ে একটা নেইম কার্ড করলাম। মোবাইল কিংবা অনলাইনের যুগ তখনও আসেনি।

ভ্যাগাবন হলেও তো কার্ডে যোগাযোগের ঠিকানা ও ফোন নম্বর লাগবে? কলেজের নম্বর ছাড়াও বন্ধু রিমুর বাসার ল্যান্ড ফোন নম্বর দিলাম। রিমু একদিন হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজছে। দেখা হওয়ার পর বললেন সদ্য সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্যরিষ্টার মওদুদ আমাকে খুঁজছে। ওর মা ফোন ধরেছিল এবং তার অজ্ঞান হবার অবস্থা। মওদুদ সাহেব পরে আমাকে অনেক তথ্য ও রেফারেন্স দিয়েছিলেন।

তার পরের দিনগুলো ছিল স্বপ্নের সমান নয় তার চেয়েও অনেক বেশী। আবুল খায়ের লিটুর রাজবাড়ির নীচতলা টা বিশাল আর্ট মিউজিয়াম। এক কোনে মৃদু টেবিল ল্যাম্পের আলোয় চেয়ারে বসে উবু হয়ে আতশ কাচ দিয়ে লুঙ্গি পরিহিত, গামছা কাঁধে অশীতিপর এক বৃদ্ধ সারা দিন শুধু পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে। চারিদিকে শুধু বই আর বই। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে পন্ডিত ব্যক্তি, জ্ঞানজগতের রহস্য পুরুষ প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক, ঢাকা কলেজের ১৯২৭-২৮ এর ছাত্র।

একুশের প্রথম কবি মাহবুবুল হক, জিল্লুুর রহমান, কবি শামসুর রাহমান, কবি রফিক আজাদ, মেনন, মখা আলমগীর, আব্দুর রাজ্জাক, ইকবাল আনসারী খান, আনোয়ার আনসারী খান, সৈয়দ আলী আহসান, বিচারপতি বদরুল হক, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ফুটবলার সালাউদ্দিন, তানভীর মাজাহার তান্না, আখতার হামিদ সিদ্দিকী, .. কয়জনের নাম বলবো, প্রায় অর্ধ্ব শতাধিক বিদগ্ধজনের সাক্ষাৎকারে উঠে আসলো তাদের সময়ের ঢাকা কলেজ। একজনের কাছ থেকে কয়েকটা রেফারেন্স, তার কাছ থেকে আরো.. শেষ সময়ে গিয়ে বলি বিজ্ঞাপনের কথা। প্রতি রাতে রুমে ফিরে তথ্য যাচাই বাছাই করে এগুলোকে কম্পাইল করি। এরই মধ্যে হাবিবুর রশীদ স্যারের বাসার খোঁজ পেয়েছি। তার মহিয়সী স্ত্রী ফেরদৌস আরাকে পটিয়ে ফেরত দেয়ার শর্তে পত্রিকাগুলো নিয়ে আসি।

আমার জীবনের একটি বড় পাপ পত্রিকাগুলো ফেরত না দেয়া যা আজও আমাকে দগ্ধ করে। কাজ শেষে পেপার গুলো হারিয়ে ফেলেছিলাম। বিজ্ঞাপন ও অনুদান মিলিয়ে প্রায় লাখ খানেক টাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছি। বিজ্ঞাপন সংগ্রহের যে বিচিত্র ও তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল পরবর্তি জীবনে এই কাজটি আর করিনি। ভর দুপুরে ক্ষুধার্ত পেটে ৩/৪ ঘন্টা অপেক্ষা করিয়ে সাক্ষাত দিয়েছে কেউ কেউ, তারপর মুখের উপর না বলে রুম থেকে বের করে দিয়েছে এমন শীর্ষ ব্যবসায়ীও আছে।

উল্টো অভিজ্ঞতাও হয়েছে। আরো অর্থের প্রয়োজন। কাগজটা তো কেউ অনুদান দিবে না, যদি ছাপাটা সিস্টেম করা যেতো! খবর লাগালাম বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রেস কোনগুলো। পদ্মা প্রিন্টার্স, জেনিথ প্রিন্টার্স..। জেনিথের মালিক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।

ভান্ডারিয়ার খুব প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান নাহিদ আমার ছেলেবেলার দোস্ত; মঞ্জুর স্থানীয় রাজনীতিতে ওদের পরিবারের ভূমিকা অনেক। বাসা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনেই ‘মানিক মিয়া ভবন’। ইত্তেফাকের দখল নিয়ে ব্যারিষ্টার মইনুল ও মঞ্জুর ভ্রাতৃদয়ের যুদ্ধ তখন শহরের টক অব দা টাউন। একজন নিহত ও হয়েছে। ব্যারিষ্টার সাহেব অভিষেকের সময় আমাকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে স্বেচ্ছায় বলেছিলেন এরপর কোন পাবলিকেসন্স করলে আমার কাছে এসো।

কিন্তু মঞ্জু সাহেবের হার্টের তুলনায় তারটা চিকেন হার্ট জানতাম। নাহিদকে নিয়ে ঘন্টা খানেক অপেক্ষার পর দেখা পেলাম। বললাম স্যার বিজ্ঞাপন বা অর্থ কিছুই চাই না, শুধু ছাপা সুবিধা চাই। আমার কাছে কেন আমি তো নটরডেমিয়ান। বললাম জানি।

ব্যরিষ্টার সাহেব প্রধান অতিথি ছিলেন আমাদের অভিষেক অনুষ্ঠানে। তিনি জানেন আমি একাই ছাত্রলীগ থেকে জিতেছি। তাই আর তার কাছে যাই নি। বেশ কিছুক্ষণ না না বললেন। বললাম স্যার কাগজেই তো ৯০ শতাংশ খরচ।

কাগজের টাকাটা অনেক কষ্টে জোগাড় হয়েছে। জেনিথতো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কোয়ালিটি প্রেস। আচ্ছা আচ্ছা পাম দিতে হবে না, সকালে ইত্তেফাকে আসো দেখি একটা বিজ্ঞাপন টিজ্ঞাপন দেয়া যায় কিনা! আমার মিটিং আছে, উঠলাম। সাদা কাচের কাপে সবুজ রঙের গরম পানীয় খেতে দিল। বুঝলাম না কি জিনস খেলাম।

পরদিন সকালে গিয়ে বসে আছি। ১২ টার দিকে তিনি আসলেন। আমিও ছালাম দিয়ে তার সাথে সাথে দোতলায় উঠলাম। রুমের দরজা খুলে দিল বেয়ারা আমাকে ইশারা দিলেন প্রবেশের। বললাম স্যার বিজ্ঞাপন চাইনা, শুধু ছাপা সুবিধা।

ফোনে জিএম সাহেবকে আসতে বললেন। বলে দিলেন দেখুন তো ও কি বলে। তার রুমে গেলাম। বললাম দশ ফর্মা, এক ফর্মা কালার..। হিসাবটা নিয়ে জিএম সাহেবসহ আবার তার রুমে আসি।

দেখি এক হুজুরকে তুলাধুনা করছে- ‘চাকুরি দিতে পারি তবে কালকে দাড়ি টুপি ছেড়ে শার্টপ্যান্ট টাই পড়ে আসেন তারপর দেখবো!’ ভান্ডারিয়ার চাকুরীপ্রার্থী এক হুজুর, তার দুসম্পর্কিয় জ্ঞাতি। ‘এই টুইরা হুজুররাই দেশটারে খাইলো!’ হিসাবটা দেখে বললো- ‘ফন্দিটা তো ভালোই করেছো। জি এম সাহেব, ইত্তেফাক থেকেই কাজটা তুলে দিন’। আমার একটা বিচিত্র শখ ছিল পোষ্টার আর সুভ্যেনীড় সংগ্রহের। ঘুরে ঘুরে চিত্র প্রদর্শনী দেখতাম।

রাস্তায় কোন সুন্দর পোষ্টার দেখলেই তা তুলে নেয়ার চেষ্টা করতাম। একটা সাংস্কৃতিক সপ্তাহের পোষ্টার কালেকশনের জন্য ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও গিয়েছিলাম একবার। আমার কবি বন্ধু আহমেদ হেলাল ছোটনের বাসা থেকে বেশ কিছু আর্ট এক্সিবিশনের ক্যাটালগ এনেছিলাম। ওর বড় ভাই জামিল আহমেদ চারুকলার শিক্ষক। একটি ক্যাটালগে জাপান প্রবাসী শিল্পী জি এস কবিরের সার্কেল নামে একটা ছবি খুব পছন্দ হলো।

স্যারকে দেখালাম, স্যার বললেন খুবই চমৎকার আইডিয়া। কিন্তু শিল্পীর পারমিশন কিভাবে আনবে? সেটা বোঝা যাবে স্যার। ছোটনকে বললাম পারমিশনের দায়িত্ব নিতে হবে তোর। ছোটন বললো সমস্যা নেই জি এস কবির ভাইয়ার বন্ধু, আমাকেও স্নেহ করেন। ব্যাক গ্রাউন্ড কি দেই সামথিং এক্সক্লুসিভ।

রাস্তায় সিলভার গ্রীন কালারের একটি গাড়ি দেখে চোখ আটকে গেল। এই কালারটি তো চেষ্টা করলে প্রিন্টিংএ ও আনা সম্ভব। গুরু ফারুকভাইর পরামর্শ নিলাম। সিলভার কালারের সাথে গ্রীন মিক্সড করে অতিরিক্ত স্পট কালার মারতে হবে। খরচ কোন সমস্যা নয় ছাপা যেহেতু ইত্তেফাকের।

মিতু ভাইর একটি পজেটিভ হাউস ছিল কলেজের উল্টোদিকে হোসেন আলীর মুরগীর আড়তের আগে। ওখান থেকেই পজেটিভ, ফটো কম্পোজ, পেইজ মেক আপ দিয়ে হাতে পেষ্টিংসীট তৈরী করি। আমীরুল ভাই মার্কার দিয়ে ‘বার্ষিকী’ শব্দটি বিভিন্ন ঢঙ্গে লিখে দিলেন। কালার ডটসের পর কাওরন বাজারে ‘ডায়ালগ’ নামে আরেকটি অত্যাধুনিক আউটপুট হাউস হয়েছে। দিলখোসান নামে এক ইন্ডিয়ান সুন্দরী ওটার ম্যানেজার।

ওখান থেকে সব ছবিগুলোর কালার সেপারেশন করেছিলাম। শুধু ছবিগুলোর স্ক্যান ও পজেটিভ বিল সেই সময়ে ৮ হাজার টাকার মত হয়েছিল, বর্তমানে যা ১ হাজার টাকায়ই সম্ভব। সবকিছু মিলে অবশেষে ছাপা শুরু হলো। ভুলের ভিতরে বড় ভুল একটাই হয়েছে- প্রুফটা পাকনামী করে প্রফেশনালকে না দিয়ে নিজেরাই দেখেছি। বেশ কিছু বানান ভুল ছিল।

সায়ীদ স্যার আমাকে দেখলেই বলতেন কি মিয়া তোমার তাজমহল নির্মাণ কতদূর? স্যার ২২ হাজার লোকের বিশ বছর লেগেছিল, একা হলে কতদিন লাগতো? অবশেষে আমার তাজমহল নির্মাণ শেষ হলো। ছাপা শেষে সায়ীদ স্যার খুব খুশী হয়েছিলেন। এরইমধ্যে একদিন কলেজে ঢুকছি, শুনলাম রেজাল্ট দিয়েছে। হঠাৎ করে প্রানটা ছ্যাত করে উঠলো। আমাদের হাউজ টিউটর প্রিয় রফিক স্যার আমাকে দেখেই সুমন তোমার রোল কত? মনে করার চেষ্টা করলাম।

স্যার ‘মনে নেই!’ কী বল পাগলের মত? এডমিট কই? স্যার খুঁজে দেখতে হবে? স্যার চরম বিরক্ত হলেন। আমার খুব বড় প্রত্যাশা ছিল না। একটা ফাষ্ট ডিভিশন পেলেই আমি ও আমার পরিবার খুশী। হঠাৎ আমার এক বন্ধুকে দেখলাম যার ঠিক পরের রোল নম্বরটি আমার। ও বললো তুই ষ্টার পেয়েছিস তিনটি লেটার।

পুরাই বিভ্রান্ত আমি। স্ট্যাটে তো ৮৫ মার্কস’র বেশী উত্তরই দেয়নি। ৩টা লেটার হয় কিভাবে? দৌড়ে রুমে গেলাম এডমিটের জন্য। বেশী সেইফ জায়গায় রাখতে গিয়ে ভুলেই গেলাম কোথায় রেখেছি। ফিরে এলাম অধ্যক্ষের রুমে।

রফিক স্যার পারলে আমায় চুম্মা দেয়। প্রিন্সিপ্যাল স্যার বললেন তোমার বাবা ফোন করেছিলেন, তিনি খুব খুশী হয়েছেন। তুমি আবার ফোন কর। প্রিন্সিপ্যালের ফোন দিয়ে বিনা পয়সায় এনডব্লুডি করতাম আগে থেকেই। বাবাকে ফোন করলাম, আব্বা আপনি এখনই কাউকে রেজাল্টা জানাবেন না, একটু ভুলও হতে পারে।

ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে আমি আপনাকে কনফর্ম করছি। স্যার বললেন মানে কি? স্যার আমি একটু কনফিউজড, ফলাফলটা রিচেক করতে চাই। স্যার তার গাড়ি দিয়ে এক ম্যাডামসহ বোর্ড অফিসের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে পাঠালেন। তার রুমে ঢুকেই ম্যাডাম বললেন ও রেজাল্ট নিয়ে একটু কনফিউজড। এতভালো নাকি হওয়ার কথা না! কন্ট্রোলার স্যার বললেন জীবনে এরকম উল্টো কথা প্রথম শোনলাম।

যাই হোক দেখি। স্যার টেবুলেশন সীট ও আরো কীসব কাগজ দেখলেন। বললেন ‘তোমার মোট নম্বর ৭৫৩। এখন রি-এক্সামিন করাতে চাইলে পার, তাতে কিন্তু সাধারণত বাড়ে না কমে’। আর রিস্ক নিলাম না।

কলেজে এসে খুশীতে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সামনেই একটা পেগু ড্যান্স দিলাম। পরীক্ষার ফলাফলে গড়ে সবাই খুশী। জয় শালা আবার থারটিনথ্ ষ্ট্যান্ড করলো। আমাদের বন্ধু রেসিডেন্সিয়ালের ইউসুফ জাই স্যারের ছেলে টিটো জয়ের চেয়েও ভালো করলো। আনন্দে ও বাসায় পার্টি দিল।

আর ওর বাবা খুশীতে তার পারসোনাল ফ্রীজের দরজা খুলে দিলো। টিন টুকাটুকি করে সমস্বরে বললাম ‘লেটস্ চিয়ার্স’। সরি রনি, কেমনে যে ভুলে গেলাম, তোর আরও ২/৩ বড়ভাই কিন্তু লেখাটা আগেই দেখেছে ওরাও ভুল করল। প্রোফাইল এ নিজের ছবটাও রাখিস, অনেকদিন দেখিনা তোরে। ভালো থাকিস।

আমি খুবই ভোজন রসিক, আড্ডা ও ভ্রমনপ্রিয় মানুষ। কোন দাওয়াত কিংবা অফারের অপেক্ষা করতাম না, ২৪ ঘন্টাই চান্সে থাকতাম। এই দু’ বছরে আমি আমার অনেক বন্ধুর গ্রামের বাড়ীতেও বেড়িয়েছি। সবান্ধব হাকুল্লাহ খাওয়া তো নিয়মিত রুটিন (অজানা বিয়ে বাড়িতে অনাহুত হয়ে খেয়ে আসা)। হাজী, ষ্টার, নীরব, ফখরুদ্দিন, ঘরোয়া- এগুলো তো রোমান্টিকদের জায়গা! আমরা এ্যাডভাঞ্চারাসরা যেতাম ব্যতিক্রমী ও ঐতিহ্যের স্বাদ নিতে বিউটি বোডিং, আর্যবোডিং, কল্পনা বোর্ডিং থেকে সদরঘাটের ভাসমান নৌকার আদর্শ হিন্দু হোটেলে।

স্কুলে বসে আমার এক মামার পাগলামীর কথা শুনেছিলাম। তিনি মেট্রিক পরীক্ষার পরে ঢাকা শহরের প্রতিটা সিনেমা হলে একটি করে সিনেমা দেখেছিল। তার এই মাস্তিকরার ব্যতিক্রমী রেকর্ড গড়ার আইডিয়াটি আমায় উদ্দিপ্ত করেছিল। আমার মাথায়ও তেমনি একটি রেকর্ড গড়ার চিন্তা ছিল। আমি যেহেতু ভোজন প্রিয় লোক এবং চায়নীজ খাবার ভালোই লাগে তাই সিন্ধান্ত নিয়েছিলাম শহরের সব চায়নীজে একবার করে খাবারের চান্স নিব।

হয়তো সফল ও হয়েছিলাম। তখন শহরে ১০-১৫ টি চায়নীজ (গুলশান-উত্তরা বাদ দিয়ে)। ক্লাসিক বাবু একদিন কলেজে ডেকে বললেন সুমন এত কিছুর পরেও তোরা এত ভালো রেজাল্ট করেছিস, তোদের একদিন চায়নীজ খায়াবো। কবে খাবি বল? আপনি বলেন? ওকে নেক্সড ফ্রাইডে। ওকে, তোর বন্ধুদেরও নিয়ে আসিস।

কতজন? আরে তোরে কি আর না আছে! বাবুভাই ধনাঢ্য ব্যবসায়ী জানতাম; কিন্তু খুবই উপকারী প্রানী, ভালো লোক। তাকে মাইকেল বানাবো! এখন গায়পড়ে কেউ যদি ধরা খাইতে আসে কি বা করার। নির্দিষ্ট দিনে ধানমন্ডী ৮-এর আলী ভাইয়ের ম্যাগডোনাল্স্-এ খেতে গেলাম। মাত্র ২০০ শত বন্ধু নিয়ে। একটু কনফিউজড ছিলাম, মুখের উপর কোন তির্যক বাক্য বললে প্রতিউত্তর দিতে পারবো না, যেহেতু বড়ভাই।

ওমা, দেখি বাবু ভাই স্যুটেড বুটেড হয়ে খুবই খুশীমুখে সবাইকে রিসিভ করছে। আমাকে দেখে বললো, তুই তো আসলে কোন কামের না- তোরা পরীক্ষা দিলে হাজারের উপরে, আর ২০০ বন্ধুও নিয়ে আসতে পারলি না? পরে বুঝেছিলাম, ক্লাসিক কোচিং এর এটি নতুন প্রচারণা স্টাইল। পরে নটরডেমের শ’খানেক বন্ধুদের নিয়েও চাংপাইতে একদিন বসেছিলাম বাবু ভাইর সৌজন্যে। আমাদের সাথে অনেকগুলো মাষ্টার পিস ছিলো। প্রত্যেকের কথা লিখলে মহাকাব্য হবে।

একটা কুম্ভকর্ণ ছিল, নামটা ভুলে গেছি। দুপুর বেলা সবাই পরীক্ষা দিয়ে হলে ফিরেছে। এসে দেখলো বন্ধুটি তখনও নাক ডাকছে। সবাই ভাবলো পরীক্ষা দিয়ে বোধহয় আগেই ফিরেছে। সবার শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল।

চোখ খুলেই বলে, চল পরীক্ষা দিয়া আসি। মানে সকালে পরীক্ষা ঠিকই তার মনে ছিল কিন্তু রাত জেগে পড়ার কারনে সকাল ৮টার ঘুম তার বিকাল ৩টায় ভেঙেছে। আরেক মেধাবী বন্ধু তাকে প্রায়ই আবিস্কার করি বিভিন্ন ফুটপাত কিংবা ড্রেনের পাশে ঘুমানো অবস্থায়। কঠিন বাম তাত্ত্বিক। জমিদার বাবাকে শ্রেণীশত্রু ঘোষনা করে গৃহত্যাগ করলো।

ততদিনে প্যাথেড্রিনের নেশাটা তাকে পেয়ে বসেছে। অসম্ভব জেদী। একদিন খুব অস্থির হয়ে আমাকে বললো ‘আমার সাথে একটু কমলাপুর যাবি?’ কেন? বললো ‘কমলাপুর রেল ষ্টেশনে একদিন ঘুমিয়ে ছিলাম এক পুলিশের বাচ্চা কোমরে বুটের লাথি দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। এটা আমার খুব ইগোতে লেগেছে। শালাকে না মারলে আমি সুস্থ হবো না!’ আমাকে রাজী করাতে না পেরে আরেকজনকে নিয়ে গেল।

তার কাছ থেকে শুনেছিলাম- ‘আমাকে কিছু না বলে কমলাপুর নিয়ে গেল। দ্যাখি এক পুলিশ বসে আরেকজন ঠেস দিয়ে প্লাটফর্মের সামনে ঝিমুচ্ছে। কথা নেই বার্তা নেই দেখি ও আস্ত একটা ইট দিয়ে ঐ পুলিশের মাথায় সজোড়ে আঘাত করে বলে উঠল- দোস্ত দে দৌড়!’ আমার সেই সাবেক নেশাগ্রস্থ বন্ধুটি এখন সরকারী মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। হলে শাখারী ব্লকে আমার রুমের উল্টো পাশে একটি ছেলে ছিল। আমাদের ১ ব্যাচ জুনিয়র।

মোটা ফ্রেমের চশমা পরে। বন্ধুরা ওকে বিজ্ঞানি বলে ডাকে। চেহারা ও ভাবভঙ্গি বিজ্ঞানিদের মতই। রুমে সাধারনতঃ কাউকে ঢুকতে দেয় না। পরীক্ষার আগে আমার ভয়াবহ সর্দি কাশী হয়েছিল।

কাশীর শব্দে অনেকেরই পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটছে; কিন্তু বলতে পারে না। মাঝরাতে ও কড়া নাড়লো। রুমে ঢুকে বললো সুমনভাই খুব কষ্ট হচ্ছে! ব্যাঙের আবার সর্দি আমার আবার কষ্ট। আসলে কাশির শব্দে কষ্টতো হচ্ছে তোদের। ও বললো যদি একটু আমার রুমে আসতেন! প্রথমবার ওর রুমে ঢুকলাম।

রুমে ঢুকে দেখি বিশাল কায়-কারবার। রুম ভর্তি অনেক ছোট ছোট বিভিন্ন সাইজের বোতলে বিভিন্ন রঙের তরল। টেষ্ট টিউব, বার্ণার আরো কিসব আজিব জিনিসপত্র। যেন সত্যিকার একটি মিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার। অনেকগুলো দাতভাঙ্গা ইংলিশ বইও আছে।

হোমিও প্যাথিক, আয়ুর্বেদীয় অনেক প্রকার চিকিৎসার কথা জানি। কিন্তু এইটা কি? ও বললো এটা বায়োক্যামিক্যাল চিকিৎসা। আমাকে জামা খুলে একবার উপুর করলো, একবার চিৎ করলো কি সব মালিশ করলো। ষ্ট্যাটিথিস্কোপ কানে লাগিয়ে খুব ভাবের সাথে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে। কাগজে নোট নিচ্ছে।

পরে লকার খুলে কি কি মিক্সড করে ¯িপ্রট বার্ণারে বাষ্পোভূত করে আমাকে নিঃশ্বাস নিতে বললো। খুবই উৎকট গন্ধ বমি বমি ভাব চলে এলো। আমি সাধারনতঃ রাগতে পারি না। ওদিন মেজাজটা কঠিন খিচড়ে গেল। বললাম ‘তুই কি মাঝ রাইতে আমারে গিনিপিগ বানাইলি! ফাজিল কোথাকার!’ বলে বাথরুমে গিয়ে বমি করলাম।

বিজ্ঞানী ভয়ে রুম আটকালো। রুমে ফিরে ঘুম দিলাম। পরদিন আমাকে বলে সুমন ভাই আপনার এই বমিটার খুব দরকার ছিল। সর্দি কাশীও উবে গেল। পরীক্ষার পর ও বিদেশে চলে যায়, বিজ্ঞানীকে আর খুঁজে পাই নি।

আমাদের শৈশবে ম্যাচের খোসা দিয়ে চাড়ামারি বা তাস খেলা নামে গোপন একটি জনপ্রিয় খেলা ছিলো। বড়দের দৃষ্টিতে এটি ছিল ট্যাবু। নিয়ম টা হলো নির্দিষ্ট স্থান থেকে একজনের নিক্ষিপ্ত চাড়ার বিপরীতে কিছু পরিমান তাস (ম্যাচের খোসা) বাজি ধরা হতো। অপরজনকে ওই নির্দিষ্ট স্থান থেকেই প্রতিপক্ষের চাড়ার চার আঙুল বা বিঘার মাপের মধ্যে নিজের চাড়াকে প্রতিস্থাপন করতে হবে। অথবা ঐ একই মাপের মধ্যে পূর্বতনকে বাজীর বিপরীতে ফিরাতে হবে।

আমার বন্ধু ও সহযোদ্ধা পিচ্চি মনির নর্থে থাকে। ওর সহোদর রনিভাইও আমাদের একব্যাচ সিনিয়র নর্থের বর্ডার। তার বৃদ্ধা আঙুল ও তর্জনির মাঝখানটা কাটা। রনি ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম- কিসের দাগ? বললেন ছোটবেলায় চাড়ামারি খেলায় বিঘার দৈর্ঘ্য বাড়ানোর জন্য ব্লেড দিয়ে কেটে নিয়েছি। আরো যে কত বিচিত্র মানুষ পেয়েছি কজনের কথা আর বলবো।

অতঃপর ঢাকা কলেজের দুয়ার দিয়েই প্রবেশ করলাম বাস্তব জীবন নামের এক বিশাল পৃথিবীতে, যেটাকে কখনই আর কঠিন মনে হয়নি বরং উপভোগ্য বলেই মনে হয় আজও। সময়ের দরজায় কড়া নেড়ে তাই প্রণতি জানাই এই হাজার দুয়ারী প্রতিষ্ঠানটিকে যে আমাকে প্রস্তুত করেছে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.