১১ নভেম্বর মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভার সব সদস্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পদত্যাগপত্র দাখিল করেছেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে তা ব্যাপকভাবে প্রচার হয়েছে। ওইদিন মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে পদত্যাগ পর্বটি সম্পন্ন হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছিলেন, ওই সভাটিই ছিল বর্তমান লীগ মন্ত্রিসভার শেষ বৈঠক। কিন্তু সব সমালোচনা উপেক্ষা করে পদত্যাগী মন্ত্রীদের নিয়ে আজ আবার মন্ত্রিসভার বৈঠক বসছে।
সংবিধান অনুযায়ী যেসব মন্ত্রীর পদ শূন্য হয়ে গেছে অর্থাৎ যারা এখন আর মন্ত্রী নেই তাদের নিয়ে মন্ত্রিসভার এ বৈঠক বৈধ কি অবৈধ তা নিয়ে সর্বত্র আলোচনার খই ফুটছে। এসবের কোনো মূল্য আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে নেই। উল্টা তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীদের পদত্যাগ গ্রহণ না করা পর্যন্ত তার মন্ত্রীরা স্বপদে বহাল থাকবেন। কোনো কোনো সংবিধান বিশেষজ্ঞের মতে, মন্ত্রিসভার এই বৈঠক যে অবৈধ তা তিনি আমলে নিচ্ছেন না। প্রধানমন্ত্রীর এই এটিচ্যুড ভয়ঙ্কর বলে মনে করছেন অনেক পর্যবেক্ষক।
তারা ধারণা করছেন, আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন সে ব্যাপারে তিনি কারও কথা শুনবেন না। তবে কি তিনি এটাও বুঝিয়ে দিচ্ছেন সংবিধান অগ্রাহ্য করতে পারলে পপুলার জনমতও তিনি অগ্রাহ্য করতে পিছপা হবেন না। তিনি বোধহয় এই ইঙ্গিতই দিলেন যে, শুধু পদত্যাগী মন্ত্রিসভা বহাল রাখাই নয়, তার ইচ্ছা ও পছন্দানুযায়ী নির্বাচনে যদি বিরোধী দল রাজি না হয়, তাহলে বর্তমান জাতীয় সংসদের মেয়াদ নিয়েও তিনি ভিন্ন চিন্তা করতে পারেন। পদত্যাগী মন্ত্রীদের নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক করে তিনি এমন মেসেজই কি জাতিকে দিলেন, আইনে কী আছে, সংবিধান কী বলে ওসব তার কাছে বড় কিছু নয়। তিনি যা বলেন, বলবেন ও চাইবেন তা-ই আইন, তা-ই সংবিধান! যদি এমনই হয়, সামনে বর্তমান বিপদের চেয়েও বড় বিপদ সারা জাতির জন্য অপেক্ষা করছে।
বর্তমান সংসদে তাদের যে দানবীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে তাতে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারির মতো একটা অগণতান্ত্রিক, স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলতে পারেন তারা। আলাপ-আলোচনা-সংলাপের মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে ফয়সালা করার গণদাবি পূরণ না করে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার এবং ব্যারিস্টার মওদুদ, এম কে আনোয়ারের মতো বয়োবৃদ্ধ নেতাদের আট দিনের রিমান্ডে নেওয়ার নিষ্ঠুরতা প্রমাণ করে সরকার বেপরোয়া। এই রেপরোয়া ভাবেরই আরেক প্রকাশ_ মন্ত্রীর পদশূন্য ব্যক্তিদের নিয়ে 'মন্ত্রিসভার' বৈঠক। মন্ত্রিসভার এই বৈঠক নিয়ে গণমাধ্যমে নানা ধরনের মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। একটি জাতীয় দৈনিক একে 'জাতীয় রসিকতা' বলে মন্তব্য করে লিখেছে, 'বেইলী রোডেও এমন নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
নাটকপ্রবণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১১ নভেম্বর যা ঘটে গেল তা একেবারেই অভিনব। সুনিশ্চিত করে বলতে গেলে, অভিধানের কোনো শব্দই আসলে এ নাটককে কাভার করে না। 'সংবিধান', 'সংবিধান' বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলা মহাজোট সরকার সংবিধান নিয়ে কি তামাশাটাই না করল। তবে মশকরা এখনো শেষ হয়নি। '
দুই.
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হলে ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে সে দিনক্ষণ গণনা শুরু করতে হবে।
সে অনুযায়ী ২৭ তারিখ থেকেই ক্ষমতাসীন লীগ সরকারের নিয়মিত মন্ত্রিসভা বহাল রাখা বা থাকা অনৈতিক, অসাংবিধানিকও বটে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, একটা স্পষ্ট সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করে ফেলেছেন তারা। সরকারি মহলের অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের উদাহরণকে চ্যালেঞ্জ করে কেউ কেউ বলছেন, সেসব দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয় সংসদ ভাঙার পর। আমাদের মন্ত্রীরা পদত্যাগ করলেন অথচ সংসদ ভাঙল না_ এটা অবৈধ। সংবিধান তৈরি হয় একটা ডিসিপ্লিন মেনে চলার জন্য।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সেটাই উড়িয়ে দিচ্ছে। তারা উপদেষ্টাদের অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, এখন তারা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা থাকেন কী করে? মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেও পদবি ব্যবহার করছেন এবং নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন সরকারি খরচে। অথচ নির্বাচনী আইনে আছে, মন্ত্রী-এমপিরা সরকারি সুবিধা নিয়ে ইলেকশন ক্যাম্পেইন করতে পারবেন না। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগপত্র প্রদান করলেই মন্ত্রীপদ শূন্য হয়ে যাবে।
সাংবিধানিক পদাধিকারীদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা বা না করার কোনো বিধান সংবিধানে নেই। সংবিধানের এই সহজ ভাষা ও মর্মার্থ বুঝতে না পারাটা অদক্ষতা বা কোনো কূটকৌশলের আশ্রয় নেওয়া। যার কোনোটাই গ্রহণযোগ্য নয়। সংবিধানের ৫৮ (১) (ক) অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীর পদ শূন্য হয়ে যাবে। অথচ সরকার এ নিয়ে যেন গোটা দেশবাসীর সঙ্গে রসিকতা করছে।
তারা যা করছে তা নিয়ে জনমনে এমন সংশয় জেগেছে যে, সরকারের মনে বোধহয় কোনো দুষ্ট বুদ্ধি কাজ করছে।
৫৮ (১) (ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, 'প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন। ' এটা এত সহজভাবে লিখিত যে, একজন মন্ত্রীর পদত্যাগ কখন থেকে কার্যকর হয় তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের তা বুঝতে 'অসুবিধা হওয়ার' কারণ দুর্বোধ্য নয়। একজন মন্ত্রী বলেছেন, পদত্যাগপত্র নাকি রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেওয়ার জন্য দেওয়া হয়নি।
তাহলে যে কেউ এ প্রশ্ন তো তুলতেই পারেন যে, ঘটা করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্রগুলো কি কোনো নাটক-সিনেমায় ব্যবহার করার জন্য ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছিল? তাও যদি হয়, মিডিয়ায় মন্ত্রীদের পদত্যাগের বিষয়টি এত ফলাও করে প্রচার হলো কেন? জাতির সঙ্গে রসিকতা? বেশ ক'দিন ধরেই যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী মন্ত্রিসভার সদস্যদের পদত্যাগের আভাস দিয়ে আসছিলেন। কয়েকজন দিনক্ষণও ঘোষণা করেছিলেন এবং সে অনুযায়ীই আমরা সব মন্ত্রীর পদত্যাগের আবেগঘন 'মোহনীয়' দৃশ্য দেখলাম। বিদায় বেলার অনেকের জল ছলছল চোখ দেখলাম। কয়েকজন মন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রীর পা ছুঁয়ে সালাম করতেও দেখলাম। এ যেন 'সুযোগ এলে আবার আমায় ডেকো'র আকুল আকুতি! এতকিছুর পর এখন বলছেন, মন্ত্রীরা পদত্যাগই করেননি।
সাবেক বামপন্থি আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদের কথা তো আরও হাস্যকর বলে মন্তব্য করেছেন কোনো কোনো পর্যবেক্ষক। তিনি বলেছেন, "মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেননি, পদত্যাগের 'অভিপ্রায়' ব্যক্ত করেছেন মাত্র। " আইনমন্ত্রী তো আইনের মানুষ। সংবিধান সম্পর্কেও জ্ঞানসমৃদ্ধ। সংবিধানের কোন জায়গায়, কোন ধারা-উপধারায় মন্ত্রীদের পদত্যাগের 'মধুর অভিপ্রায়ের' বিষয়টি লেখা আছে? উজিরে খামাখা বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তো আরও এক ডিগ্রি সরেস।
তিনি সংবিধানের ৫৫ (৪) অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়ে বলেছেন, মন্ত্রীদের উত্তরাধিকারী দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত পদত্যাগী মন্ত্রীরা বহাল থাকবেন। তারা মানুষকে কত বোকা ভাবেন! ৫৫ (৪) ধারায় লেখা আছে, "প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিলে বা স্বীয় পদে বহাল না থাকিলে মন্ত্রীদের প্রত্যেকে পদত্যাগ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে; তবে এই পরিচ্ছেদের বিধানাবলী সাপেক্ষে তাহাদের উত্তরাধিকারীগণ কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তাহারা স্ব স্ব পদে বহাল থাকিবেন। " পাঠক, লক্ষ্য করুন এখানে স্পষ্ট বলা আছে, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে বা স্বীয় পদে বহাল না থাকলেই কেবল এই ধারাটি প্রযোজ্য হবে। কিন্তু সুরঞ্জিত বাবুরা পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রীকে গদিতে রেখে, স্বীয় পদে বহাল রেখে। সংবিধান অনুযায়ী এখন গদি শুধু প্রধানমন্ত্রীরটাই আছে, সুরঞ্জিত বাবুদেরটা আর নেই।
প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির গ্রহণ-বর্জনের যে কথা বললেন, তা সংবিধানের কোথায় আছে? অবশ্য এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন যে, মন্ত্রীরা তার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এমতাবস্থায় মন্ত্রীদের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ, বাড়িতে-গাড়িতে পতাকা ব্যবহার, মন্ত্রী হিসেবে সরকারি নথিতে স্বাক্ষর প্রদান সবই অবৈধ; অনৈতিক তো বটেই। এমন একটা বাস্তবতায় পদত্যাগী মন্ত্রীদের নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক বসছে আজ। কেমন করে? এটা কি আইনের জোরে না কি গায়ের জোরে? ২৭ অক্টোবর থেকে, বিশেষ করে ১১ নভেম্বর পদত্যাগের পর থেকে পদত্যাগী মন্ত্রীদের কার্যাবলীকে বৈধতা দেওয়ার জন্যই কি মন্ত্রিসভার(?) এ বৈঠক? অথচ বলা হয়েছিল ১১ নভেম্বরের বৈঠকটাই ছিল মন্ত্রিসভার শেষ বৈঠক। অনেকেই বলছেন, বিধিবিধান, সংবিধান লঙ্ঘন করে জাতির সঙ্গে এ যেন তামাশা চলছে।
তিন.
কিন্তু এর পরিণতি কি ভালো হবে? ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধান সংশোধন করে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশালী শাসন কায়েম করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এর মাধ্যমে দ্বিতীয় বিপ্লব শুরু হলো। রাতারাতি সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে গেল, মাত্র চারটি দৈনিক পত্রিকা (এর মধ্যে একটি আবার বঙ্গবন্ধুর ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মনির বাংলাদেশ টাইমস) রেখে বাদবাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল (১৫ জুন সাংবাদিকরা এখনো সে জন্য কালো দিবস পালন করেন), অসদাচরণের দায়ে বিচারপতিদের চাকরিচ্যুত করার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের কব্জায় রাখা হয়েছিল। এত কিছু করেও বাকশাল টিকেনি। দমন-পীড়ন চালিয়ে দ্বিতীয় বিপ্লবের ঝাণ্ডা বেশি দূর কিন্তু এগিয়ে নেওয়া যায়নি।
সব কিছু তছনছ হয়ে গিয়েছিল। সর্বনাশ নেমে এসেছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারে। এমন কথা এখনো কানে আসছে যে, কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীকে অসমাপ্ত 'দ্বিতীয় বিপ্লব' সমাপ্ত করার পরামর্শ দিচ্ছেন। যারা বঙ্গবন্ধুকে সোভিয়েত আদলে দ্বিতীয় বিপ্লবের কুপরামর্শ দিয়েছিল তারা এখন তার কন্যার সঙ্গেও বেশ ভালোভাবে আছেন। তাই সন্দেহটা দৃঢ় হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দোহাই লাগে, সেই সর্বনাশা পথে পা দেবেন না।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
ই-মেইল : kazi.shiraz@yahoo.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।