আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দোহাই আপনাদের... আমরাও মানুষ !



টিভির পর্দায় চোখ রাখলেই দেখা যায় রাজপথে জীবনদগ্ধ মানুষের ছবি। আর পত্রিকার পাতায় মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন হয়ে ভাসছে অগ্নিদগ্ধ অসহায় মানুষের আর্তনাদের প্রতিচ্ছবি। মানুষ যেন নির্বিকার হয়ে অবলোকন করছে জ্বলতে থাকা রাজপথ আর আগুনে পোড়া নিরীহ মানুষের যন্ত্রণাকাতর মুখ। কি নির্মমতা ! কি অসহায়ত্ব! যন্ত্রণাদগ্ধ মানুষের করুণ আর্তনাদে পাষাণের চোখও জলে ভিজে যায়, শুধু স্পর্শ করে না কতিপয় ক্ষমতালোভী স্বার্থপর রাজনীতিবিদের অন্তরাত্মাকে ! সেসব রাজনীতিকের প্রতিপক্ষ কি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ? এই সব নিদোর্ষ সাধারণ মানুষ কেন তাদের বর্বর সহিংসতার শিকার হবে ? তারা কেন আগুনে জ্বলবে ? মৃত্যুর মিছিল কি সেসব রাজনীতিকদের হৃদয়ে এতটুকু দাগ কাটে না ? তাদের কি না ফেরার দেশে ফিরে যেতে হবে না ? তারা কি ফিরিয়ে দিতে পারবেন কোন প্রাণ, কারো স্নেহময়ী সন্তান, প্রাণের চেয়ে প্রিয় বাবা-মা, কিংবা পরম ভালোবাসার প্রিয় মানুষটিকে ? তাই জীবনের মুল্য না বুঝে, দেশ ও মানুষের কল্যাণের কথা না ভেবে যারা আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারছে, যারা গণহত্যা চালাচ্ছে, তাদের এবং তাদের হুকুমদাতাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জোর দাবী জানাচ্ছি। জীবনযুদ্ধে দগ্ধ অসহায় ও নিরপরাধ মানুষের আর্তনাদে গা শিহরে উঠে ।

ছেলের দগ্ধ মুখ দেখে বাবার আহাজারি, শিশুর কাছে বাবা অচেনা হয়ে যাওয়া, অনাগত সšতান এতিম হয়ে যাওয়া, মায়ের চোখের আলো নিভে যাওয়া, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সোনালী স্বপ্ন ধুলিসাৎ হওয়া, ছেলে হারানো মা অথবা স্বামী হারানো স্ত্রীর অসহায়ত্ব এখন হরতাল-অবরোধের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, হৃদয় কাঁপানো দৃশ্য । বাংলার মানুষ এধরনের দৃশ্য আর দেখতে চায় না । গত ২৬ অক্টোবর থেকে আন্দোলনের নামে সহিংস দুর্বৃত্তায়ন যেন ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞকেই হার মানিয়েছে । বিশেষ করে গত ১২ নভেম্বর ২০১৩ রাজধানীর রায়েরবাগে ও ২৮ নভেম্বর ২০১৩ রাজধানীর শাহবাগে বাসে পেট্রোল নিক্ষেপের ফলে অগ্নিদগ্ধ নিরীহ সাধারণ বাসযাত্রীদের কান্না ও আহাজারিতে আকাশ ভারি হয়ে আসছিল, আগুনের লেলিহান শিখার কাছে অসহায় ও পরাজিত উপস্থিত জনসাধারণকে তাদের অক্ষমতা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল, স্তম্ভিত ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল সকলেই । এ কেমন নির্মমতা ? একি কোন সভ্য সমাজ, সৃষ্টির সেরা মানব জাতির কাজ ।

শাহবাগে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত ০২ জনের ০১ জন হল রবিন, বাড়ি তার মাদারীপুরে। তার মৃত্যুতে স্বজনদের আহাজারিতে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। সবচেয়ে নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো, তার স্ত্রী পাঁচ মাসের অন্তঃসত্তা । কি জবাব তিনি দেবেন তার অনাগত সন্তানকে ? তার অনাগত সন্তান কখনো দেখতে পাবে না তার ডিএনএ’র সূত্রকে, শুধুই জানবে নিষ্ঠুরতার এবং নির্মমতার এক গল্প । সে কাকে দোষী করবে ? ঘটনার নেপথ্যের নেতারা হয়তো চলে যাবে অন্ধকার থেকে আরো অন্ধকারে অথবা প্রকাশ্যে সভ্য মানুষ বেশে ।

কিভাবেই বা স্বান্তনা দেবে তার অসহায় মাকে ? একই ঘটনায় দগ্ধ বেসরকারী ব্যাংক কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতর কন্ঠে বলতে থাকেন, "ও ভাই, দেড় বছরের একমাত্র ছেলে মাহির আমার জীবনের সবকিছু। কতদিন ছেলেটাকে আদর করতে পারি না । আমার শিশু ছেলেটাতো অন্যায় করেনি ? তারপরও কেন সে এতিম হবে ?" পাশে বসা তার স্ত্রী বলছিলেন, "সব সময় ছেলেটা বাবার বুক জড়িয়ে থাকে । বিভৎস হওয়ায় চিনতে না পেরে ও বাবাকে দেখে এখন আঁতকে উঠে । যেই ছেলে অফিস থেকে বাবা ফিরলে' বাবা বাবা বলে কোলে উঠত ।

আর সে এখন বাবাকে চিনে না। এর চেয়ে নির্মমতা আর কি হতে পারে''? মাহিরের তার বাবার দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকার দৃশ্যে তার মা- বাবা দু’জনের চোখেই অঝোর ধারায় জল বেয়ে আসছিল। আপনি কি পারবেন চোখের পানি ধরে রাখতে ? এর নামই তো মানবতা ! এদিকে মাত্র চার মাস আগে বিয়ে হয়েছিল রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা মাসুমা আক্তার । অফিস শেষে বাসায় ফিরার পথে দগ্ধ মাসুমা আক্তারের জীবনের স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে গেল। নববিবাহিত স্বামীকে কি বলে স্বান্তনা দিবেন ? সাজানো গোছানো সংসার কি পারবেন ফিরিয়ে দিতে ? ঢাকা কলেজের ছাত্র ওহিদুর রহমানের বাবা ওয়াজিউল্লাহ প্রায় তিন বছর ধরে নিখোঁজ ।

অভাগা সেই ছেলেটি এখন অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ও লাইফ সাপোর্ট নিয়ে বেঁচে আছেন । বাবাকে খুঁজে ফেরা ছেলেটি এখন অবরোধের সহিংসতার নির্মম বলি হয়ে নিজেই হারিয়ে যেতে চলেছেন । কি মর্মান্তিক ! অগ্নিদগ্ধ রিয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে মা আয়েশার অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল । পাশেই আরেক ছেলে সবুজ রিয়াদের দিকে নির্বাক তাকিয়ে ছিল । অভাবের সংসারে মা বাবা ও ভাই বোনের দেখভালের দায়িত্বটা ছিল রিয়াদের উপরেই ।

রাজনীতির আগুনে পুড়ে সেই রিয়াদই এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, তার বাবাও শয্যাশায়ী । সামনের অনিশ্চিত ভবিষতের চিন্তায় পরিবারটি এখন দিশেহারা । অন্যদিকে, অবরোধের সহিংসতায় লাশ হওয়া ছেলেকে দেখার ক্ষমতা নেই দৃষ্টিশক্তিহীন পেয়ারা বেগমের। তাই পিকআপ ভ্যান থেকে যখন নামানো হল লাশের খাট, হাতড়ে হাতড়ে তিনি তা স্পর্শ করলেন । বুক চাপড়ে আহাজারি করতে করতে বললেন, "এই খাটে কি তুমি শুয়ে আছ, বাবা ? কথা কও বাপ, কথা কও !" উত্তর মেলে না।

এবার খাট জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ। বলতে থাকেন, "আমি তোমারে চোখে দেখবার পারতেছি না বাবা, মা কইয়া ডাকবা না ? রাগ করছো, বা'জান? " অন্ধ পেয়ারা বেগম বুঝে গেছেন এ খাটেই চিরনিদ্রায় শায়িত তার আদরের সন্তান মোজাম্মেল । স্বামীহীন ও পুত্রশোকাতুর পেয়ারা বেগম এই শোক সইবেন কিভাবে ? হরতাল ও অবরোধের সহিংসতার শিকার কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও জীবন গড়ার যুদ্ধে আজ অসহায় । চাকুরীজীবী হয়ে সংসারের হাল ধরবে-ওদের এমন সোনালী স্বপ্ন আজ হরতাল ও অবরোধের আগুনে ধুলিসাৎ হতে চলেছে। স্বজনের প্রশ্ন, "ওদের কি অপরাধ ? ওরাতো রাজনীতি করে না ।

ঘৃণ্য রাজনীতির খেলায় ওরা কেন দগ্ধ হবে?" ওদের দগ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের স্বপ্নও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে । এদিকে হরতাল ও অবরোধ দিয়ে উচ্চশিক্ষার্থীদের পাশাপাশি জুনিয়র ও প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার অর্ধকোটি শিশুকে আর তাদের পরিবারগুলোকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে চরম উৎকন্ঠা ও হয়রানির অন্ধকূপে । রোম পুড়ছে, তারা বাঁশি বাজাচ্ছেন ? আর তা না হলে, জাতির ভবিষৎ তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া কোন সভ্য রাজনীতিবিদদের পক্ষে সম্ভব হত না। হরতাল/অবরোধে এরূপ মর্মপর্শী ও হৃদয়বিদারক ঘটনার কোন অন্ত নেই । না জানা, না বোঝা, আরও অনেক যন্ত্রণা ও কষ্ট বয়ে চলেছে রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হয়ে অসংখ্য সাধারণ মানুষ ।

চোখ ভিজে আসে, চোখ ভেসে যায়, অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে । রাজনীতিবিদদের হৃদয়ের কঠিন বরফটি আর কত যন্ত্রণার শিহরণে গলবে তা জানা নেই, তবে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে-এমনটাই সবার প্রত্যাশা । আর কতটা লাশ পড়লে স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক মহলের বোধোদয় হবে ? গত ২৬ অক্টোবর থেকে আজ পর্যন্ত শুধু যানবাহনে দেওয়া আগুন ও পেট্রোল বোমা হামলায় পুড়েছেন অন্তত ৫৫ জন, মারা গেছেন ০৯ জন । আর রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন ৫২ জন । এসব নিহত ও আহতদের অধিকাংশই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ।

রাজনীতির বলি হওয়া সাধারণ মানুষের অসহায় মৃত্যুর মিছিল কত সংখ্যায় গিয়ে শেষ হলে ক্ষমতান্ধ ও নির্দয় রাজনীতিবিদদের বোধোদয় হবে ? তাইতো পেট্রোল বোমায় মা হারিয়ে একজন আক্ষেপ করে বলেছিল, "কোন রাজনীতিবিদ বা তাদের স্ত্রী - সন্তানেরা তো হরতালে প্রাণ হারান না"! সহিংসতা সৃষ্টিকারী রাজনীতিবিদদের প্রতি আজ জিজ্ঞাসা - আপনাদের কাছে দেশ, নাকি ক্ষমতা বড় ? মানুষের জীবনের কি কোনই মূল্য নেই আপনাদের কাছে ? এই রাজনৈতিক হানাহানি বন্ধ করে একটা সমঝোতায় আসার জন্য চেষ্টা করাটা কি সমীচীন নয় ? মনে রাখবেন, একটা মানুষের প্রাণ অনেক মূল্যবান, যা আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি না, তা কেড়ে নেওয়ার অধিকার আমাদের কারোরই নেই। তাই সহিংসতা বন্ধে উদ্যোগী হোন-দেশকে বাঁচান । হরতাল বা অবরোধ দিয়ে ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চালানো, ছোট ছোট শিশুসহ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করা- রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হতে পারে না ? একজন মুসলমান হয়ে এমন করে আরেক মুসলমানকে এভাবে কি পুড়িয়ে হত্যা করতে পারে ? দেশবাসী এই জুলুম আর মুখ বুঝে সহ্য করবে না, এটি বন্ধ করা দরকার । এজন্য অচিরেই ক্ষমতার লালসার উর্দ্ধে উঠে সমঝোতার পথ বেছে নিন, দেশ ও জনগণের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করুন । সাধারণ বাংলাদেশীদের স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে দিন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.