হৃদয়ের কাছে বুদ্ধির বাস ভাল কথা। কিন্তু মাঝে মঝে হৃদয়ের ওপর থেকে বুদ্ধির শাসন তুলে দিতে হয়, হৃদয়কে স্বাধীন করে দিতে হয়, মুক্ত করে দিতে হয়। স্বাধীন মুক্ত হৃদয়ের ধর্মকে সব সময় বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে নেই
বাংলাদেশের মুক্তযুদ্বের চলচিত্রের ইতিহাস লিখতে গেলেই যে মানুষ টির নাম চলে আসে তিনি জাহির রায়হান। জহির রায়হানের চেতনাতেই ছিল মুক্তির বীজ। ভাষা আন্দোলনের সময়ই স্বেচ্ছায় কারাবন্দী জহির রায়হান ঘোষনা দিয়েছিলেন “একুশে ফেব্রুয়ারী” ও “লেট দেয়ার বি লাইট” নামে দুটি চলচিত্র করবেন।
কিন্ত নানা কারনে সে দুটি আর করা হয়নি। ১৯৭০-৭১ সালে লেট দেয়ার বি লাইটের কাজ শুরু করলেও শেষ করতে পারেন নি। তবে ১৯৭০ সালেই তিনি পর্দায় বিস্ফোরন ঘটালেন “জীবন থেকে নেয়া” ছবির মাধ্যমে। গান ও সুরে কৌশলে ইঙ্গিত দিলেন স্বাধীন বাংলার।
মুক্তিযুদ্ব নিয়ে আমাদের দেশে বেশী চলচিত্র নির্মিত হয়নি, হাতে গোনা যে সব চলচিত্র নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে প্রমান্য চিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র।
আবার দেশীয় নির্মাতার চলচিত্র ও বিদেশী নির্মাতার চলচিত্র এই দুভাগেও ভাগ করা যায়।
বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের চলচিত্রের মধ্যে আমরা চারটি চলচিত্রের নাম জানতে পারি। এ চারটি হল জহির রায়হান পরিচালিত “স্টপ জেনোসাইড” ও “আ স্টেট ইজ বর্ন” আলমগীর কবির পরিচালিত “লিবারেশন ফাইটার” ও বাবুল চৌধুরী পরিচালিত “ইনোসেন্ট মিলিয়নস”। এর মধ্যে স্টপ জেনোসাইড চলচিত্রটির নির্মানশৈলী, আঙ্গিক ও উপস্থাপনা নান্দনিকতায় ভাস্বর। “আ স্টেট ইজ বর্ন” ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের বর্ষে বর্ষে শোষন নির্যাতন তুলে ধরা হয়েছে।
এই ইংরেজী ধারা ভাষ্যে ছিলেন আলমগীর কবির। আবার আলমগীর কবিরের “লিবারেশন ফাইটার” ছবির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্বাদের প্রশিক্ষন, অবস্থান, প্রত্যয়, অপারেশন কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে। “ইনোসেন্ট মিলিয়নস” ছবির মাধ্যমে হানাদার বাহিনীর গনহত্যা, শরনার্থী শিবিরের অবর্ননীয় দুঃখ কষ্টের মধ্যে অসংখ্য শিশুর মৃত্যু দেখান হয়েছে। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ছবির প্রায় সব সব বৈশিষ্ট্য আর একটি ছবির মধ্যে খুজে পাই তারেক মাসুদ আর ক্যাথেরিন মাসুদের “মুক্তির গান” (১৯৯৫)এ। এ ছবির চিত্রগ্রহন করা হয়েছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্বের সময়।
লিয়ার লেভিন নামে একজন মার্কিন চলচিত্রকার যুদ্বকালীন ট্রাকবাহী একটি সঙ্গিত দলের সাথে ক্যাম্পে এবং পথে পথে ঘুরে চিত্র গ্রহন করেন। যুদ্বের সময় তোলা এসব ফুটেজ ২০ বছর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উদ্বার করে আরো অন্যান্য সুত্র থেকে নিদর্শন সংগ্রহ করে এই ছবি তৈরী করেছেন মাসুদ দম্পত্তি।
স্বাধীনতা উত্তর মুক্তিযুদ্ব নিয়ে প্রথম চলচিত্র নির্মান করেন চাষী নজরুল ইসলাম “ওরা ১১জন” (১৯৭২)। মুক্তিযুদ্ব নিয়ে দ্বিতীয় চলচিত্র সুভাষ দত্তের "অরুনাদয়ের অগ্নিস্বাক্ষী” (১৯৭২)। সরাসরি মুক্তিযুদ্ব নয়, মুক্তিযুদ্বের পরিপ্রেক্ষিতে, যুদ্বকালীন মিত্র ভারতের সাথে সম্পর্ক নিয়ে যুদ্বে ক্ষতিগ্রস্থ কয়েকজন মানব মানবীর ঘটনা, আবেগ নিয়ে প্রামান্য রিতীতে বিশিষ্ট চলচিত্র সাংবাদিক আলমগীর কবির বানান “ধীরে বহে মেঘনা” (১৯৭৩)।
আলমগীর কবিরের “আমার জন্মভূমি” (১৯৭৩) আনন্দর “বাঘা বাঙ্গালী” (১৯৭৩) ও মমতাজ আলীর “রক্তাক্ত বাংলা” (১৯৭৩) মুক্তিযুদ্বের ছাপ রয়েছে, কিন্ত ছবিগুলো কোন আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। বিপথে চালিত মুক্তিযোদ্বাদের নিয়ে খান আতা পরিচালিত “আবার তোরা মানুষ হ” (১৯৭৩), ছবিটি নাটকীয় উচ্চকিত হলেও ভাল একটা মেসেজ ছিল। খান আতার অন্য আর একটি ছবি হল “এখনও অনেক রাত” (১৯৯৭)। সংগ্রাম (১৯৭৪) মুক্তিযুদ্ব ভিত্তিক চাষী নজরুলের দ্বিতীয় ছবি। মিতার “আলোর মিছিল” (১৯৭৪) মুক্তিযুদ্বোত্তর সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে।
হারনুর রশীদের “মেঘের অনেক রং” একটি কাব্যিক ব্যঞ্জনাধর্মী ছবি। শহীদুল হকের “কলমিলতা” (১৯৮১) একটি আগোছাল ছবি। হুমায়ূন আহামেদ “আগুনের পরশমনি” নান্দনিকতায় ভাস্বর। “হাঙ্গর নদী গ্রেনেড” (১৯৯৬) চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত এই ছবিটি সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি। পরে নির্মিত হয় শামীম আখতারের “ইতিহাস কন্যা” ও “শিলালিপি”।
বি এম সালাহ উদ্দিনের “একজন মুক্তিযোদ্বা”, চাষী নজরুল ইসলামের “মেঘের পরে মেঘ” (২০০৪), ধ্রুবতারা (২০০৬), হুমায়ুন আহমেদ এর “শ্যামল ছায়া” (২০০৪), তৌকির আহ্মেদ এর “জয়যাত্রা” (২০০৪) মোরশেদুল ইসলামের “খেলাঘর” (২০০৬)
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ব নিয়ে বিদেশি নির্মাতারাও অনেক প্রমান্যচিত্র ও কাহিনীচিত্র তৈরি করছে। এদের মধ্যে রয়েছে ভারতের এস সুকদেবের “নাইন মান্থস টু ফ্রিডম” বিনয় রায়ের “রিফিউজি-৭১” আই এস জহরের “জয় বাংলাদেশ”, এইচ এস আদভানি ও অন্যান্য “লুট অ্যান্ড লাষ্ট”, আমেরিকার রবার্ট রজার্সের “দি কান্ট্রি মেড ফর ডিজেষ্টার”, যুক্ত রাজ্যের ব্রেইন টাগের “ডেট লাইন বাংলাদেশ”, তানিয়া কাউলের “মেজর খালেদ ওয়ার’স”, বিবিসি “ওয়ার ক্রাইমস ফাইল” এবং জাপানের নাগিসা ওসিমার “জয় বাংলা” ও “রহমানঃ দি ফাদার অভ নেশন”
মূক্তিযুদ্ব নিয়ে কিছু বিকল্প ধারার ছবি হয়েছে সেগুলোর পূর্নাঙ্গ তালিকা আমার কাছে নেই। কারো কাছে থাকলে দিলে ভাল লাগবে
কিছু প্রস্তাবনা
১। মুক্তিযুদ্ব ভিত্তিক ছবিগুলো একসাথে ডিভিডি করা হোক।
২।
সরকারী আর্থিক অনুধান বাড়ানো হোক।
৩। মুক্তিযুদ্ব ভিত্তিক ছবিগুলো প্রতি সপ্তাহে প্রতি টিভি চ্যানেলে অন্তত একবার দেখান হোক।
প্রতিটা জাতি যখন নতুন করে মাথা তুলে দাঁড়ায় তখন সেই মুহুর্তটাই সেই জাতির চুড়ান্ত গৌরবের মুহুর্ত, সেই গৌরবোজ্জল মুহুর্ত ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য চলচিত্রের কোন বিকল্প নেই। পৃথিবীর প্রতিটি জাতি এ ব্যপারে পূর্ন সচেতন।
দূর্ভাগ্য আমাদের ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত মুল্য আমরা সামান্য সেলুলয়েডের ফিতায় ও ঠিক মত ধারন করতে পারিনি। আর পারিনি বলে আমদের এখন তার মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। এদেশে এখন মুক্তিযোদ্বারা মানুষের করুনা পায় আর স্বাধীনতা বিরোধীরা মন্ত্রী হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।