তুচ্ছ ঘটনা কিংবা কেবলই নিছক গুজবকে কেন্দ্র করে গত তিন বছরে দেশের গার্মেন্ট সেক্টরে ২১৫ দফা অরাজকতা ঘটেছে। এসব ঘটনায় কারখানা ভবন ভাঙচুর, সড়ক অবরোধ, যানবাহন ভাঙচুর ও আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার মতো নানা অঘটন ঘটেছে। এসব ঘটনায় দুজন পুলিশ সদস্যসহ ৪৩ জন গার্মেন্ট কর্মী নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে তিন হাজারেরও বেশি শ্রমিক। বিভিন্ন অরাজকতার ঘটনায় পুলিশ তাৎক্ষণিক অভিযানে এক হাজার দুইশরও বেশি শ্রমিককে গ্রেফতার করে। এসব ঘটনায় বিপুল পরিমাণ সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ'র কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, যারা এ গার্মেন্ট সেক্টরকে ধ্বংস করতে নেপথ্যে থেকে ভূমিকা রাখছে, ইন্ধন দিচ্ছে এবং ধ্বংসাত্দক কর্মকাণ্ডে যেসব বহিরাগত অংশ নেয় তাদের নামে কখনো মামলা হয় না। কোনো ঘটনা ঘটলেই কিছু গার্মেন্ট শ্রমিকসহ অজ্ঞাত ৪০০-৫০০ শ্রমিককে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। এতে করে কাজের কাজ কিছুই হয় না। প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। ঝুট ব্যবসার ভাগাভাগি নিয়ে গার্মেন্ট কারখানা সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে উঠেছে।
এদের মধ্যকার বিরোধ এবং ঝুট ব্যবসা না দেওয়ায় কোনো কোনো মালিকের ওপরও ক্ষুব্ধ হয়ে এসব চক্র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পথ বেছে নেয়। শুধু প্রভাব বিস্তারই নয় ঝুট ব্যবসা সম্প্রসারণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ও একজনের ব্যবসা অন্যজন ভাগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টায় এরা অনেক কারখানার শ্রমিকদের উসকে দিয়ে থাকে। যে সব কারখানার ঝুটে লাভ বেশি সেখানে সব সময় একটি পক্ষ শ্রমিক আন্দোলন করানোর চেষ্টা করে বলে মালিক-শ্রমিক উভয়ই জানায়। হয়তো টিফিন ব্যবসা, নয়তো ঝুট ব্যবসা, এ দুটির যে কোনো একটি পাওয়ার জন্য সময় বুঝে শ্রমিকদের উসকে দেয় ঝুট ব্যবসায়ীরা। আর এই ঘটনার ফলে একই কারখানায় একাধিক বার শ্রমিক আন্দোলন হয়।
ফলে অশান্ত হয়ে ওঠে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলসহ ডিইপিজেড এলাকা। গার্মেন্ট মালিকরা জানান, ১০ বছর আগেও গার্মেন্টের পরিত্যক্ত (ঝুট) কাপড় পুড়িয়ে ফেলা হতো। কিন্তু ১০ বছর ধরে এসব ঝুট লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। যে দল ক্ষমতায় আসে সেই দলের সন্ত্রাসীরাই এ সেক্টর দখল করে। এ নিয়ে প্রায়ই ছোট-বড় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
গত কয়েক বছরে ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলের অনেক প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক অসন্তোষের সময় পুলিশের পাশাপাশি এসব সন্ত্রাসীদেরও শ্রমিকদের ওপর হামলা চালাতে দেখা গেছে। তাছাড়া ঝুট দখল নিয়ে সন্ত্রাসীদের দুই গ্রুপের কোনো দ্বন্দ্ব থাকলেও এক পক্ষ শ্রমিকদের উসকানি দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করে। শ্রমিক সংগঠনের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সম্পর্কে গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু জানান, ভাঙচুরের ক্ষেত্রে অনেক সময় তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেয়। সরকার বা গার্মেন্ট মালিক পক্ষের সবসময় কিছু লোক থাকে, যারা শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে নানা মন্তব্য করে। তবে সহিংস কর্মকাণ্ডে শ্রমিকদের বাইরে অন্যদের উৎসাহ বেশি থাকে বলে মিশু স্বীকার করেন।
শ্রমিকরা যখন রাস্তায় নেমে বেপরোয়া ভাঙচুর করছে তখন সাংবাদিক এবং দায়িত্ব পালনরত পুলিশ অনেক শ্রমিককে প্রশ্ন করেছেন কী জন্য তারা রাস্তায় নেমেছেন, সরকার তো তাদের বেতন বৃদ্ধি করেছে, এখন তাদের দাবি কী। কিন্তু অনেক শ্রমিকই এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। টেঙ্টাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি আবুল হোসাইন বলেন, প্রধান সমস্যা মালিকদের আচরণ। মালিকরা শ্রমিকদের সমস্যা অন্তর দিয়ে অনুধাবন করার চেষ্টা করলে অনেক সমস্যার সমাধান এমনিতে দূর হয়ে যায়। এঙ্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী জানান, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের অবস্থান দুর্বল করতে একটি প্রতিবেশী দেশের লবিগুলো সাম্প্রতিককালে ব্যাপকভাবে তৎপর হয়ে উঠেছে।
তারা বিদেশি মিডিয়ায় নিজেদের পয়সা খরচ করে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সম্পর্কের অবনতির সুযোগটি তারা পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছে। এর সঙ্গে তাদের কাছে সাপে বর হয়ে এসেছে সাভারে গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের রহস্যজনক খুনের ঘটনাটি। ঝুট ব্যবসায়ীরা বড় সাঙ্গাত : ঢাকা ইপিজেডের মতো নিরাপত্তা বেষ্টিত রক্ষণশীল এবং শতভাগ রপ্তানিমুখী গার্মেন্টে কর্মরত শ্রমিককে বহিরাগত ঝুট ব্যবসায়ী কর্তৃক মারধর করায় ডিইপিজেডের কর্মরত অন্যান্য শ্রমিকেরা হামলা ও মারধরের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। কারণ ঢাকা ইপিজেডের ১২০টি কারখানার প্রতিটিতেই ঝুট ব্যবসায়ী রয়েছেন।
যারা এলাকার অত্যন্ত প্রভাবশালী ও সন্ত্রাসী প্রকৃতির লোক। ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় অর্ধ শতাধিক যুবক কোটিপতি বনেছেন। তাদের বেপরোয়া দাপট বেড়ে গেছে কয়েকগুণ বেশি। ডিইপিজেডের প্রভাবশালী ঝুট ব্যবসায়ী আলমাসের ব্যাপারে খোঁজখবর নিলে আরও জানা যায় সে সাভারের বর্তমান সরকার দলীয় সংসদ সদস্য তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদের বিয়াই পরিচয় দিয়ে প্রভাব বিস্তার করে ঢাকা ইপিজেডে প্রায়ই অঘটন ঘটিয়ে থাকে। তার অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই সংসদ সদস্য মুরাদ জংয়ের ভয় দেখানো হয়।
এ-ওয়ানের শ্রমিকেরা জানান, কোরিয়ান কোম্পানি এ-ওয়ানের একজন অসাধু কর্মকর্তা পলাশের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আলমাস এ-ওয়ানে ঝুট ব্যবসার নামে অরাজকতা চালিয়ে আসছে। অভিযোগ রয়েছে ঝুটের নামে কাপড়ের ইনটেক রোল ও নতুন মেশিন পুরাতন সাজিয়ে ওই অ্যাডমিন ম্যানেজার পলাশের মাধ্যমে কয়েকজন সিকিউরিটিকে ম্যানেজ করে কারখানা থেকে গোপনে বের করে আনে। আলমাসের ব্যাপারে বাইপাইলের লোকজন জানায় এ-ওয়ানে ব্যবসা করে কয়েক বছরের ব্যবধানে সামান্য খেটে খাওয়া দিন মজুর থেকে আলমাস এখন শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছে। অনুসন্ধ্যানে আরও জানা গেছে গত ২০০৬ সালেও এক বার ঢাকা ইপিজেডের এ-ওয়ান সোয়েটার (বিডি) লি. এ ঝুট ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। তখন এই আলমাসের সন্ত্রাসী কাজের সহযোগীরা শ্রমিকদের ওপর হামলা করেছিল।
তখন ধুরন্দর পলাশ তার বন্ধু ঝুট ব্যবসায়ী আলমাসকে ব্যবহার করে প্রতিবাদী শ্রমিকদের ওপর হামলা চালিয়েছিল। তখন কারখানাটি প্রায় ২০-২৫ দিন বন্ধ ছিল। উল্লেখ্য, শ্রমিকেরা কারখানার জিএম হান্নানসহ ১০-১২ জন অফিসারকে মারধর করে হাসপাতালে পাঠায়। কিন্তু ঝুট ব্যবসায়ী আলমাসের মারপিটের ভয়ে সাধারণ শ্রমিকেরা তখন পলাশকে শায়েস্তা করতে পারেনি। শ্রমিকদের আন্দোলনে পুলিশের পাশাপাশি গার্মেন্ট মালিকরা বহিরাগত সন্ত্রাসী ভাড়া করে শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন চালায়।
এমনকি প্রত্যেকটি গার্মেন্টের ঝুট ব্যবসায়ীরা শ্রমিকদের পর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে পিটিয়ে আহত করে। পুলিশের সামনেই জামগড়ার প্রীতি গার্মেন্টসের শ্রমিকদের মারধর করে স্থানীয় যুবলীগ নেতা সাইদ মীর ও তার লোকজন। কারণ সাইদ মীর প্রীতি গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসায়ী। এভাবে পুলিশের সামনে সন্ত্রাসী ও ঝুট ব্যবসায়ীরা শ্রমিকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে অথচ প্রশাসন রয়েছে একেবারে নীরব। যে কারণে শ্রমিকরা কাজে যোগদান করলেও ভেতরে ভেতরে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ফলে এক দিন পরপর সুযোগ বুঝেই আন্দোলনে যাচ্ছে শ্রমিকরা। ঢাকা ইপিজেডে কর্মরত শ্রমিকদের অনেকেই জানান, মূলত শ্রমিকরা যখনই তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করতে যায় তখনই ঝুট ব্যবসায়ীদের হামলার শিকার হতে হয় তাদের। কারণ ঢাকা ইপিজেডসহ আশুলিয়ার ৫ শতাধিক গার্মেন্টের প্রায় ২ শতাধিক ঝুট ব্যবসায়ী রয়েছে। যারা অত্যন্ত প্রভাবশালী ও কালো টাকার মালিক। ঝুট ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কারখানার কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে ঝুটের বদলে রাতের আঁধারে লাখ লাখ টাকার সুতা ও ইনটেক কাপড়ের রোল বের করে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়ায় এরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
এসব প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে থানা পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। মূলত আশুলিয়ার গার্মেন্ট শিল্পে মাঝে মধ্যেই যে অস্থিরতা বিরাজ করে তার পিছনে ঝুট ব্যবসায়ীদের হাত থাকে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।