আর্চার ব্লাড, সচেতন কূটনীতিক, যাকে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও রাজনীতিবিষয়ক অধ্যাপক গ্যারি জে বাস উপাধি দিয়েছিলেন 'অকপট সাম্যবাদী', তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ঊর্ধ্বতনকে টাইম টু টাইম সব জানানোর। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন দূতকে দেওয়া হয়েছিল গোপন একটি ওয়্যারলেস, যার মাধ্যমে ব্লাড ও তার কর্মকর্তারা স্টেট ডিপার্টমেন্টে তারবার্তা পাঠাতেন। রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতের সংখ্যার হিসাব রাখার চেষ্টা করছিলেন তারা। বিশেষ করে হিন্দুদের। তারা চিহ্ন পেলেন বোমা, ট্যাঙ্ক ও কামানের শেল নিক্ষেপের।
পেলেন ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ ও বিতাড়নের প্রমাণ। এমনকি কিছু পাকিস্তানি সেনাও কষ্ট পেয়েছিলেন নিজস্ব বাহিনীর বিকৃত রুচি দেখে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি,যিনি পূর্ব পাকিস্তানে টিক্কা খানের জায়গায় সেনাপ্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন, এবং পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর 'স্কর্চড আর্থ পলিসি' থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলন, স্মৃতি হাতড়ালেন। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল কঠোর নিষ্ঠুরতার চিত্র-হত্যার বদলে নির্মম নির্যাতন, যা চালিয়েছিলেন চেঙ্গিশ খান কিংবা জালওয়ানওয়ালা বাগে ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ার। কারণ নিয়াজি পূর্ব পাকিস্তানিদের ওপর প্রয়োগ করতে চান এমনই এক পলিসি।
মনে মনে যা ভাবছিলেন সেভাবেই চালালেন ধ্বংসযজ্ঞ। এর তাণ্ডব আসলে কতটা ভয়াবহ ছিল তা বোঝা যায় এমনকি নিঙ্নের জবানিতে। সাবেক এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার স্মৃতিকথায় পূর্ব পাকিস্তানে নিয়াজিদের আক্রমণকে উল্লেখ করেছেন 'অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতা' বলে। পক্ষকালব্যাপী চলা হত্যাযজ্ঞের সাক্ষ্য-প্রমাণ ব্লাড ও তার কর্মকর্তারা হোয়াইট হাউসে পাঠিয়ে দিলেন তারের মাধ্যমে। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নৃশংস আক্রমণ নাড়া দিল বিশ্ববিবেককে।
বসে থাকল না ভারত সরকার। তারা কার্যকরভাবে বিবেচনা করল এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে। তবে পূর্ব পাকিস্তান বিষয়ে ভারত হস্তক্ষেপ করবে কি না এ নিয়ে বিতর্ক হলো দেশটির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। সহিংসতা বন্ধে হস্তক্ষেপকে ঝুঁকি ও বাড়তি চাপ হিসেবে দেখলেন কেউ কেউ। বিতর্ক হলো একটি গণতান্ত্রিক দেশ অন্য একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিতে পারে কি না এ নিয়েও।
এ ক্ষেত্রে পাল্টা যুক্তি তুলে ধরা হলো। বলা হলো, একটি দরিদ্র ও সেনানিয়ন্ত্রিত দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশ পাকিস্তান। নগণ্য সংখ্যক আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়ে বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশের উসকানিতে কী করে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে নিজ দেশেরই অন্য একটি অংশে! নানা বিষয়ে বিতর্কের পর তারা পেঁৗছল নতুন এক উপসংহারে। ভূতাপেক্ষ ভারতীয় আখ্যান ধাবিত হলো অভিপ্রায় ও দেশটির দৃঢ়সংকল্প পলিসির প্রতি। ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল সাম মানেকশ জানালেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অধৈর্য হয়ে পড়েছেন জরুরি ভিত্তিতে অ্যাকশনে যাওয়ার জন্য।
তিনি মন্ত্রিপরিষদের সভা আহ্বান করেছেন এ জন্য যে, তিনি চাইছেন এখনই পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সেনা মুভ করুক। মানেকশ বললেন, তিনি চেষ্টা করেছিলেন ইন্দিরাকে সংযত করার এই বলে যে, এ জন্য সামরিক বাহিনীর যথেষ্ট প্রস্তুতি দরকার। ইন্দরা গান্ধী চেয়েছিলেন যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধে জড়াতে। এ কারণে এপ্রিলের শুরু থেকেই দৃষ্টি রাখছিলেন তিনি পাকিস্তানের কর্মকাণ্ডের প্রতি। ইন্দিরা গান্ধী তার মন্ত্রিসভায় ডাকলেন মানেকশকে।
তবে এ জন্য নয় যে, তিনি যুদ্ধের নির্দেশ দিতে চান। বরং এ জন্য যে, তিনি এবং তার সহকর্মীরা একসঙ্গে মানেকশর মুখে শুনতে চান, প্রকৃত অর্থে ভারতীয় সেনারা কতখানি প্রস্তুত। এটি সত্য যে, কে সুব্রামানিয়াম, যিনি জ্যেষ্ঠ আমলা ও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক-বিশ্লেষক, তার মতো ভারতের কিছু প্রকৃত চিন্তাশীল ব্যক্তি জোর দিয়ে বলছিলেন দ্রুত মিলিটারি অ্যাকশনে যেতে। কিন্তু ইন্দিরা অপেক্ষা করছিলেন তার অত্যন্ত পছন্দের উপদেষ্টা পি এন হাসকার ও তার সামরিক বাহিনীর মতামতের।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ইন্দিরা গান্ধীর এটি ছিল প্রথম বড় কোনো আন্তর্জাতিক ক্রাইসিসের মুখোমুখি হওয়া।
নিজ দলকে নিয়ন্ত্রণ ও ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মোকাবিলা করে করে তিনি অনেকটা সতর্ক হয়ে উঠেছিলেন। আর এটি তিনি কাজে লাগাতে পেরেছিলেন ভিন্ন একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে। তবে এমন নূ্যনতম আশঙ্কা ছিল না যে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে যুক্ত হবে। যদিও অনেকে এমনটা ভেবেছিলেন। ইন্দিরা দুটো বিষয় নিয়ে সন্দেহে ছিলেন।
একটি হচ্ছে, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে অন্য কোনো দেশ স্বীকৃতি দেবে কি না। অপরটি, ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক অনুমোদন পাবে কি না। ইন্দিরা ও তার উপদেষ্টাদের ভয় ছিল, ভারতকে সমালোচনার মুখে ফেলতে পারে এই ক্রাইসিসে যুক্ত হওয়া। ভারতীয়রা সচেতন ছিলেন যে পাকিস্তানের মার্কিন অস্ত্রসম্ভার সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। অন্যদিকে ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তানে নিজস্ব শক্তি প্রদর্শনের প্রতি মনোযোগ দেয়, তবে এটি হবে পশ্চিমের জন্য বিপজ্জনক।
ছিল উদ্বেগও এ নিয়ে যে, পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে চীন পারে হস্তক্ষেপের সুযোগ কাজে লাগাতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।