১৯৭১ সাল। শরণার্থীশিবিরে মানবিক বিপর্যয় দেখতে এসেছেন ইন্দিরা গান্ধী। প্রায় এক কোটি লোক জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছে ভারতের বিভিন্ন এলাকায়। ঘুরে ঘুরে দেখছেন তিনি। নিরাপত্তাকর্মীরা আগলে রেখেছে তাকে।
এই নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে শরণার্থীশিবিরের এক বৃদ্ধা কীভাবে পৌঁছে গেলেন ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। বিনীতভাবে তাকে বললেন,
'মা, আপনি আমাদের বাঁচান। '
ইন্দিরা গভীর মমতায় হাত রাখলেন সেই বৃদ্ধার কাঁধে। বললেন,
'চিন্তা করবেন না। আপনারা আমাদের অতিথি।
ভারতীয়দের কাছে অতিথি হচ্ছেন দেবতা। '
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এভাবেই মহিয়সী নারী ইন্দিরা গান্ধী পরম ভালোবাসা ও স্নেহে নিপীড়িত নির্যাতিত অসহায় বাঙালি শরণার্থীদের মনে সাহস জুগিয়েছেন, তাদের অনুপ্রাণিত করেছেন।
ইন্দিরা গান্ধীর জন্ম ভারতের রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী, ঐতিহ্যবাহী নেহেরু পরিবারে ১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর। বাবা পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু এবং মা কমলা দেবী। দাদা মতিলাল নেহেরু ছিলেন স্বনামধন্য আইনজীবী, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম ব্যক্তিত্ব তথা কংগ্রেস নেতা।
১৯৮৪ সালের ৩১শে অক্টোবর নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন তিনি।
১৯৩৪-১৯৩৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। রবীঠাকুরই তার নাম রাখেন 'প্রিয়দর্শিনী'। ইন্দিরা গান্ধী হয়ে যান ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী। এরপর তিনি ইংল্যান্ডে যান এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নেন।
কিছুদিন ব্রিস্টলের ব্যাডমিন্টন স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং অক্সফোর্ডের সমারভিল কলেজে তার এনরোলমেন্ট সম্পন্ন হয়।
১৯৪২ সালে ফিরোজ গান্ধীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ইন্দিরা। ১৯৫০ সাল থেকে তিনি আনঅফিশিয়ালি তার বাবা প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে বাবার মৃত্যুর পর তিনি রাজ্যসভার সদস্য হন এবং লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর কেবিনেটে তথ্য এবং যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । ভারতরত্ন উপাধিপ্রাপ্ত তামিলনাডুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তথা কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট কুমারাস্বামী কামরাজের প্রয়াসের ভিত্তিতে ১৯৬৬ সালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতের রাজনীতিতে আবির্ভূত হন।
সে সময় ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেস দুটি দলে বিভক্ত ছিলো, ইন্দিরা গান্ধী সমাজতান্ত্রিক ব্লকের এবং মোরারজী দেশাই দক্ষিণপন্থী ব্লকের নেতৃত্ব দেন। এই সময়ে দক্ষিণপন্থী ব্লকের গোঁয়ার্তুমির কারণে কংগ্রেস কিছুটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় এবং ১৯৬৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৬০টি আসন হারিয়ে ফেলে ও ৫৪৫ আসনের মধ্যে ২৯৭টি আসনে জয়ী হয়।
কংগ্রেসের অখণ্ডতা বজায় রাখতে সদাসচেষ্ট ইন্দিরা গান্ধী তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মোরারজী দেশাইকে ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার এবং ফিন্যান্স মিনিস্টার পদে নিয়োগ দেন । কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হয়নি, মোরারজী দেশাই গ্রুপের রক্ষণশীল সংকীর্ণ মনোভাবের কারণে অবশেষে কংগ্রেস বিভক্ত হয়ে পড়ে । ১৯৬৯ সালে তিনি ব্যাংকগুলোকে রাষ্ট্রায়ত্ত করেন ।
পরবর্তী দুবছর ইন্দিরা গান্ধী প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক এবং কম্যুনিস্ট পার্টিগুলোর সমর্থন পরিপুষ্ট হয়ে সরকারের দায়িত্ব পালন করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ইন্দিরা গান্ধীই ছিলেন সবচেয়ে বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করা নারী প্রধানমন্ত্রী (১৫ বছর)।
১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে বিশ্বশান্তি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে এক বিশেষ বার্তায় ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পূর্ববঙ্গের ঘটনায় ভারতের পক্ষে উদাসীন থাকা কঠিন এবং ইতোমধ্যে ২০ লাখ শারণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এসব উদ্বাস্তু যাতে সম্মানের সঙ্গে দেশে ফিরতে পারে সেজন্য পাকিস্তানকে বাধ্য করতে হবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী হিসেবে প্রতিবাদী অথচ নিরস্ত্র বাঙালিকে সাহস জোগান ইন্দিরা গান্ধী। ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, যুবকদের গেরিলা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় ভারতে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করতে ৬ ডিসেম্বর ইন্দিরা সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশের লাখ লাখ শরণার্থীকে সেবাযত্ন করায় ইন্দিরা গান্ধীর কাজকে যীশু খৃষ্টের কাজের সঙ্গে তুলনা করেছেন নোবেলজয়ী মাদার তেরেসা। 'তারা সবাই ঈশ্বরের সন্তান' নামের বইতে মাদার তেরেসা এ বিষয়টি উল্লেখ করেন।
ইন্দিরা গান্ধীকে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার জন্য ২০১১ সালের ২৫ জুলাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মনানা 'স্বাধীনতার সম্মাননা' দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন তার পুত্রবধু সোনিয়া গান্ধী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।