বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মার্কিন কংগ্রেস। গতকাল দুপুরে ওয়াশিংটনে মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপ-কমিটির শুনানিতে প্যানেল আলোচকসহ মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যরা তাদের এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাদের মতে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধান দুই দলের অনড় অবস্থান, রাজপথের ক্রমবর্ধমান সহিংসতা, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা আর সন্ত্রাসবাদের উত্থানের আশঙ্কা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। মার্কিন কংগ্রেসের ওয়েবসাইটে তুলে ধরা শুনানির ভিডিওচিত্র, লিখিত অনুলিপি ও বার্তা সংস্থা এনার প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। এ আলোচনায় রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প, সংখ্যালঘু নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রসঙ্গও তুলে ধরে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সফর করা মার্কিন প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশিরা।
ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলের ল্যাবার্ন অফিস ভবনে পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির কক্ষে 'নৈরাজ্যে বাংলাদেশ : খাদের কিনারে একটি জাতি?' শীর্ষক শুনানিতে সভাপতিত্ব করেন কংগ্রেসের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক উপ-কমিটির চেয়ারম্যান স্টিভ শ্যাবোট। সভাপতির সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই শুনানিতে চার কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড শারমেন, জেরার্ড কোলোনি, টুলসি গ্যাবার্ড ও গ্রেস মেং বক্তৃতা করেন। বক্তৃতা পর্ব শেষে পাঁচ মিনিট করে বক্তৃতা দেন তিন প্যানেল আলোচক। তারা হলেন ওয়াশিংটনভিত্তিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'উড্রো উইলসন সেন্টার'র পাবলিক পলিসি স্কলার ড. আলী রিয়াজ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এ এম এন নুরুজ্জামান এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অ্যাডভোকেসি পরিচালক জন শিফটন। এরপর প্রশ্নোত্তর পর্ব আর মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাড রয়েসের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয় দেড় ঘণ্টার এ শুনানি।
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদেরসহ দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ, জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকরা শুনানি চলাকালে উপস্থিত ছিলেন।
সূচনা বক্তব্যে স্টিভ শ্যাবোট বলেন, নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার প্রাক্কালে রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আমার ঢাকা সফরের সময় বিরোধী দল বিএনপির ডাকে হরতাল চলছিল। আর এ হরতালে সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে বৈঠকে অবাধ, সুষ্ঠু ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়েছি।
অথচ তাদের দুজনকেই নিজেদের অবস্থানে অনড় মনে হয়েছে। শেখ হাসিনা মনে করেন, অবাধ নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা রয়েছে। আর খালেদা জিয়া মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি বিরোধী দল নির্বাচনে যাবে কিনা। তিনি বলেন, সফরে সহিংসতা বন্ধের জন্য দুই নেত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছি।
কারণ সহিংসতা বন্ধ না হলে তা অস্থিতিশীলতাকে উসকে দেবে। শ্যাবোট বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম, গ্রামীণ ব্যাংক ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
প্যানেল আলোচনার শুরুতে অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তিনটি পরিস্থিতি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এক. একটি রুটিনমাফিক নির্বাচন। তবে দুই দলের অনড় অবস্থানের কারণে এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা নেই।
সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকে বিরোধী দলের দাবি মেনে নিয়ে সংকট উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। দুই. বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন। তবে এবারকার পরিস্থিতি '৮৮ ও '৯৬-এর চেয়ে আলাদা হওয়ায় এর ফলাফলটা হবে আলাদা। তিন. নির্বাচনটা পিছিয়ে দেওয়া। শেষ বিষয়টিতে আপাতত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে মনে হলেও তা শেষ পর্যন্ত প্রধান দুই দলের বৈরিতা কমানোর সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
আলী রিয়াজ মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট দূর করতে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে গণতন্ত্রের মানোন্নয়নে মনোযোগী হওয়া উচিত। নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে বাংলাদেশকে সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা করা প্রয়োজন। নির্বাচনের পর সংযত আচরণের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্ট করে বিবৃতি দিতে হবে, যাতে করে সমাজের দুর্বল জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যেন নির্যাতনের শিকার না হয়। সেই সঙ্গে ধর্মীয় মৌলবাদ মোকাবিলায় সব দলকে একসঙ্গে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা ও ভারতের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ দূর করা।
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা, যাতে করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রতিবেশী বা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি তৈরি না করে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) মুনীরুজ্জামান বলেন, বিরোধী দলকে বাদ দিয়েই সরকার নির্বাচন করতে যাচ্ছে; যা দেশকে সংঘাত ও কঠিন সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। তাই দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করে একমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণ সম্ভব। তিনি বলেন, বর্তমানে বিরোধী দলের প্রতি সরকারের যে অসহনশীলতা এবং রাজনৈতিক সংঘাত চলছে, তা অব্যাহত থাকলে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। আর এ পরিস্থিতি জঙ্গিবাদের উত্থানে মদদ জোগাবে।
চূড়ান্ত বিচারে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটলে আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিঘি্নত হতে পারে। চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও সহিংসতা অব্যাহত থাকলে সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে জেনারেল মুনীরুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সেনাবাহিনীর কোনো ভূমিকা নেই। ২০০৭ সালের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের কোনো ইচ্ছা নেই। তবে সহিংসতা অব্যাহত থাকলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোনো একপর্যায়ে তাদের ভূমিকা নিতে দেখা যেতে পারে। আমাদের বোধহয় এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করাটা সমীচীন হবে না।
মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনাল প্রসঙ্গ : উপ-কমিটির চেয়ারম্যান স্টিভ শ্যাবোট বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল নিয়ে নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করেন। রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষকে হেনস্তার জন্য এ ট্রাইব্যুনাল কাজ করছে বলে তার কাছে অভিযোগ এসেছে বলেও উল্লেখ করেন। মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মনিরুজ্জামান বলেন, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আন্তর্জাতিক রীতি অনুসৃত হচ্ছে না। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরিচালক জন সিফটন বলেন, এ বিচার আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ন্যায়-নিষ্ঠভাবে হচ্ছে না। বাংলাদেশে মানবাধিকার আজ বিপন্ন।
গণতান্ত্রিক পরিবেশ সমুন্নত রাখতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। এ সময় ড. আলী রিয়াজ জোর দিয়ে বলেন, 'একাত্তর সালে ৩০ লাখ বাঙালিকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার হতেই হবে। অন্যথায় বাংলাদেশে আইনের শাসনের প্রত্যাশা মুখ থুবড়েই থাকবে। ড. রিয়াজ বলেন, বিচার ব্যবস্থায় ঘাটতি বা কোনো ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করা যেতে পারে। কিন্তু ওই বিচার বন্ধ করা চলবে না।
এটি বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষের দাবি এবং একাত্তরে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্বজনেরা বিচার দেখে যেতে চান।
সংখ্যালঘু নির্যাতন ও গার্মেন্ট প্রসঙ্গ : কংগ্রেসের পররাষ্ট্রবিষয়ক মূল কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাড রয়েস গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্যাতনে জড়িতদের বিচার না হওয়ায়। তিনি বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তেজনাকর হলেই হিন্দুরা ভিকটিম হন। শুধু হিন্দু সম্প্রদায় নয়, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও নাস্তিক লোকজনের ওপর হামলা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে মাদ্রাসা শিক্ষা বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো মৌলবাদে মদদ জোগাচ্ছে কিনা কিংবা এ সমস্যা কতটা প্রকট তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে বলেন, পাকিস্তানে এ সমস্যা অঙ্কুরে বিনষ্ট করা যায়নি, তাই গভীর সংকট তৈরি করেছে।
কমিটির সদস্য টুুলসি গ্যাবার্ডও সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের হিন্দুরা প্রতিনিয়ত টার্গেট হচ্ছেন প্রতিবেশীদের। হত্যা, ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন তারা। বাড়িঘর এবং পূজা-অর্চনার স্থান জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অপর সদস্য গ্রেস মেং বলেন, গার্মেন্ট সেক্টরের শ্রমিকদের ভাগ্য উন্নয়নে আন্তর্জাতিক মহলের প্রত্যাশার ব্যাপারে তিনি আশা করেছেন যে, শীঘ্রই বাংলাদেশ সরকার গার্মেন্ট সেক্টরে বিরাজমান সমস্যার সমাধানে শ্রম আইনকে ঢেলে সাজাবে।
তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক জন শিফটন বাংলাদেশকে এখনই জিএসপি সুবিধা না দেওয়ার পরামর্শ দেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।