মা,
অনেক ব্যস্ততা আর প্রবাস জীবনের অনেক অনেক নতুনত্বের মাঝে তোমাকে চিঠি না লেখার অজুহাতটাকে আজ ঠিক ঠিক দূরে সরিয়ে রাখলাম। দেখতে দেখতে দুই দুটি বছর পার হয়ে গেল। মনে হয়, সেই কত যুগ আগে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাঁচের দেয়ালের দুই পাশে আমরা দু’জন। ছলছল চোখে মুখের হাসি দিয়ে অজানা যাত্রার পথে প্রিয়তম সন্তানকে বিদায় দিয়েছিলে। কতদিন দেখি না তোমায়,মা! কেমন আছ তুমি?
আমি ভাল আছি মা।
নতুন দেশে নতুন ভাষার একদম নতুন রকম মানুষের মাঝে জীবনটাকে আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করেছি। সেই ছেলেবেলায় যেমন নতুন নতুন জিনিস দেখে কৌতুহলে হাজার সব প্রশ্নের আব্দারী করতাম,এই নতুন দেশের অন্যরকম মানুষগুলো আবার যেন আমাকে সেই বয়সটাতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। কত কত প্রশ্ন যে মনে জমে আছে, কবে যে তোমার কাছাকাছি বসে মন খুলে তোমার সাথে কথা হবে, সেইসব ভাবতে ভাবতেই আজ সব পড়াশোনার ব্যস্ততা ফেলে শুধু তোমার সাথে শব্দ দিয়ে চিঠি বোনা।
সবচেয়ে আগে শুরু করি ভাষা দিয়ে। কি জান মা, মাতৃভাষার জন্য যে মানুষ প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারে, এটা জার্মানীতে না আসলে কোনদিন উপলব্ধি করতাম না।
এখানে এসে এই প্রথম জীবনে খটখট করে ইংরেজী বলতে হচ্ছে। সেটাও না হয় চলেই যাচ্ছিল। যত ঝামেলা বাধালো জার্মান ভাষাটা! আমাদের দেশে শিক্ষিত মানুষজন সুযোগ পেলেই ভুলভাল ইংরেজী দিয়ে নিজেকে জাহির করে। আর এই দেশের মানুষরা নিজেদের ভাষা নিয়েই অহংকারী, প্রয়োজন না পড়লে অন্যের ভাষা ব্যবহার করতে চায় না। মা, তুমিই বল, পৃথিবীর সেই একমাত্র জাতি যারা মাতৃভাষার জন্য রাজপথ রক্তাক্ত করল, তাদেরই কি নিজের ভাষা বলতে পেরে গর্বিত হবার কথা না? সেইদিন ফোনে বড় আপু বলছিল তার ছেলেটাকে ইংরেজী মিডিয়ামে না দিলে নাকি কোনভাবেই মানুষ হবে না ঠিকমত।
ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই শুধু দশগুণ বেশী টাকা দিয়ে হলেও ইংরেজী মিডিয়ামে পড়ানো। কোথায় যেন কিছু একটা মিলছে না হিসেবে। তুমিই বল মা, বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষায় তোমাকে এত আপন করে চিঠি লিখতে পারতাম? বড় আপুর ছেলেটাও কি একদিন অনেক ইংরেজী শিখে পরদেশে বসে মাকে লিখতে বসবে না?
আচ্ছা মা, তোমার মনে আছে আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন বাড়ির কাজ করে না নিয়ে গেলে স্যাররা কি মারটাই না দিতেন? বাবা একদিন বলেছিলেন, স্যারের বেতের বাড়ি না খেলে নাকি কেউ মানুষই হয় না। আমার জার্মান বন্ধু রাইমুন্ড বলল এই দেশে স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের মারা দণ্ডনীয় অপরাধ। এমনকি বাবামারাও সন্তানকে কোন শাস্তি দিতে পারেন না।
রাইমুন্ডকে একদিন বাংলাদেশে নিয়ে আসব এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। তুমি দেখবে মা, ও কিন্তু মার না খেয়েও একটা ভাল মানুষ হয়েছে। সত্যিকারের পরিপূর্ণ মানুষ। আলব্রেশ্ট, আমার অন্য এক বন্ধু, জানতে চাইছিল বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের কথা। C&Aকিংবা H&Mএর মত এইদেশে জনপ্রিয় জামাকাপড়ের দোকানে গেলে “মেইড ইন বাংলাদেশ” লেখাটা চোখে পড়ে অহরহ।
আলব্রেশ্ট বুঝতে পারছিল না, এত ভাল কোয়ালিটির কাপড় এত ভাল দামে এখানে বিক্রি করার পরেও কেন বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকদের এত করুণ দশা। আমি ঠিকমত উত্তর দিতে পারিনি। এইখানে বাংলাদেশের তৈরি কাপড় বিক্রি করে যে সুদর্শনা সেলসগার্ল মার্সিডিজ গাড়ি চালিয়ে অফিস করতে আসে, সেই একই শিল্পের সাথে জড়িত ঢাকা শহরের গার্মেন্টস শ্রমিকরা দশ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে একটা ছোট্ট বেঞ্চির উপর বসে একটা টেবিলে দম বন্ধ করে কোনমতে জীবনের সেলাইমেশিন ঘুরিয়ে যাচ্ছে। আর মাসিক বেতন? সেই টাকায় এইদেশের সেলসগার্লের একদিনের মেকআপের পয়সাও হবার কথা নয়।
আমাদের দেশের খেটে খাওয়া মানুষগুলি এত কষ্টে কেন মা? ওদের তো পরিশ্রমের কোন কমতি নেই।
ওরা কি খুব কাজে ফাঁকি দেয়, ওরা কি পূর্বজন্মে কোন অপরাধ করেছিল যার ফলাফল ঈশ্বর ওদের উপর এই জন্মে চাপিয়ে দিয়ে স্বর্গ নামের অলীকে গা ঢাকা দিয়েছেন? আলব্রেশ্ট, রাইমুন্ডরা পূর্ব জার্মানীর ছেলে। ওদের কোন ধর্ম নেই, অন্তত: ওরা কোন ঈশ্বরকে চেনে না- বলে সবই নাকি মানুষের মনগড়া। আমার আল্লাহ কি ওদেরও ঈশ্বর নন? এই দেশে যদি রাস্তায় ফুল বিক্রি করেও কেউ গাড়ী কিনতে পারে, একই আকাশের নিচে ঈশ্বরের একই পৃথিবীতে সারাদিন গরম সূর্যের তাপে রিকশা ঠেলে আমার দেশের মজুররা কেন তার অসুস্থ বাচ্চার জন্য জীবন রক্ষাকারী অসুধটাও কিনতে পারে না? এইসব প্রশ্নের জবাব আমি ওদেরকে দিতে পারিনি। তুমি কি জান, মা?
তোমার কি মনে আছে মা, আমাদের ছোটবেলা কেটেছিল মোহাম্মদপুরের ছোট সরকারী কোয়ার্টারে। বাবা সামান্য সরকারী চাকুরীজীবি, সামান্য আয়ের এতগুলো ভাই বোনের সংসার।
ভীষণ ধার্মিক আর চিরদিন সৎ থেকে যাওয়ার বদঅভ্যাস বাবা বদলাতে না পারায় নিম্ন-মধ্যবিত্তের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসার আমাদের অন্য উপায় ছিল না। আমাদের পাশের কোয়ার্টারে নীলা নামের আমাদের বয়সী একটা মেয়ে ছিল। দেখতে সুন্দরী হওয়ার অপরাধে প্রায়ই স্কুলে যাবার পথে তাকে পাড়ার এক মাস্তান উত্তক্ত্য করত। নীলার বাবা, মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন, এমনকি বারান্দায় বেরোনোও বন্ধ। আমার মনে পড়ে, আমার বোনদেরও খুব বেশি বাহিরে যাবার অনুমতি ছিল না, যদিও তারা দেখতে সুন্দরী না হওয়াতে স্কুলে যেতে সমস্যা ছিল না।
আমরা ছোটবেলায় জানতাম এটাই নিয়ম, মাস্তানরা বুক ফুলিয়ে রাস্তায় হাটবে, আর মেয়েদের বুকে মাথায় কাপড় দিয়ে ঘরে বসে থাকতে হবে। এই দেশে এসে জানলাম ব্যাপারটা পৃথিবীর সব জায়গায় এক না, উঠতি বয়েসী মেয়েরাও রাত করে বাড়ি ফিরতে পারে, এমনকি একা একাও।
নীলার গল্পের শেষটা ছিল আরও নির্মম। একদিন সুযোগ বুঝে রাস্তায় বাবা-মেয়েকে পিস্তলের মুখে দাড় করিয়ে আমাদের পাড়াত মস্তান দিনে দুপুরে শত শত মানুষের সামনে অপেক্ষমান পাজেরোতে নীলাকে তুলে নিয়ে গেল। নীলাকে নিয়ে যাওয়া হল ঢাকার বাইরে।
জোর করে নামমাত্র বিয়ে পড়িয়ে মাস্তান তার পুরুষত্বের কামনা পূরন করল। আমরা বেশি কিছু আর জানতে পারলাম না। নীলার পরিবার বাসা বদলে চলে গেল অন্য কোথাও, যেখানে সম্ভবত কেউ তাদেরকে চিনবেনা। নীলার কি হল তাও জানি না। সেই মাস্তান ওকে দেশের বাড়িতে রেখে মোহাম্মদপুরে ওর মাস্তানী এবং অন্য সুন্দরী মেয়েদের উত্তক্ত্য করার স্বাধীন চর্চা বজায় রাখল।
কে জানি বলছিল, নীলা “বিয়ের” পরদিন আত্মহত্যা করেছিল। সত্য মিথ্যা যাই হোক, সুন্দরী হবার অপরাধে অপরাধী হবার এই সংস্কৃতি বোধকরি বাংলাদেশেই বাস্তব।
দুইটি বছর প্রবাসে থেকে এমন আরো কত কিছু নিয়ে যে প্রশ্ন জাগল মনে। তোমাকে ছেড়ে, দেশকে ছেড়ে অজানার পথে পাড়ি বাড়ানোর সিদ্ধান্তটা যেন জীবনকে, পৃথিবীকে নতুন করে দেখতে শেখার সুযোগ করে দিল। আমার মত এমন আরো কত মেধাবী বাংলাদেশী ছেলে পৃথিবীর প্রতিটি কোনে ছড়িয়ে পড়েছে – জীবিকার খোঁজে, জীবনের খোঁজে।
তুমি কি জান মা, সবচেয়ে বড় কষ্ট কি প্রবাস জীবনের? না, সেটা তোমাকে ছেড়ে, বন্ধুদের ছেড়ে নিজের ভাষা বলতে না পারার চেয়েও কষ্টকর। ছোটবেলায় গান গেয়েছিলাম সকল দেশের চেয়ে সেরা আমার জন্মভূমি, আর দেশের মানচিত্র থেকে বের হয়ে আকাশে উড়াল দেবার মুহুর্তে জানতে পারলাম আমরা পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ। বাইরের বিশ্ব জানে আমরা বন্যা-বাদলের সাথে লড়াই করে মেরুদণ্ডহীন হয়ে কোন মতে বেঁচেবর্তে আছি। এই দুই বছরের প্রবাস জীবনে কতজনকে যে পৃথিবীর মানচিত্র খুঁজে হাতড়ে দেখাতে হয়েছে “সকল দেশের রাণী” দেশটি কোথায়। এরা কিন্তু শুধু জার্মান নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীরা, যারা আমাদের সাথে একসাথে পড়েছে।
দেশে থেকেও জানতাম আমরা গরিব দেশ, কিন্তু প্রবাসে এসে জানলাম আমরা শুধু দরিদ্রতমই নই, অবহেলিততমও বটে। আমরা যে আছি এটা যেন পৃথিবী জানেই না!
রাইমুন্ড বলছিল জার্মানদের আত্মকেন্দ্রিক হয়ে নিজের পায়ে দাড়ানোর থিওরী। দেশ আসলে শুধুমাত্র একটা প্রতীক, প্রতিটি নাগরিকের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাপকাঠি মাত্র। একটি দেশ তখনই সফল যখন তাদের এক একটি মানুষ ইউনিট হিসেবে সফল হয়। রাইমুন্ড বলে তার জীবনের দায়দায়িত্ব তার নিজের, ও যদি নিজেকে গড়ে তোলে অন্যরা কি করছে সেটা নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে, তাহলে সেটাই বিন্দু বিন্দু করে সমগ্র দেশের গড়ে ওঠায় রুপান্তরিত হবে।
প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব শুধু তার নিজের অংশের কাজ সততা আর একাগ্রতা নিয়ে শেষ করার। একটি জাতি সকল দেশের সেরা হয়ে উঠবে যখন তার প্রতিটি নাগরিক নিজেদেরকে সেরা করে গড়ে তুলবে।
আমি স্বপ্ন দেখছি আপাততঃ আমার ছোট্ট জগতে সেরা হবার। যতটুকু আমার নিজের আয়ত্তের মধ্যে, সেখানে অন্য সব দেশের মধ্যে নিজেকে সেরা করার। তোমার ছেলে সেরা হলে সবাই তার সাথে সাথে বাংলাদেশকেও স্বীকৃতি দিবে সেরা বলে।
জার্মানীর সব শহরের বাংলাদেশী ছেলেগুলি যখন তাদের নিজ নিজ শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা ফলাফল নিয়ে বেরিয়ে আসবে, তখন সবগুলি সফলতার প্রতিধ্বনি হবে গগনবিদারী। শুধু জার্মানী কেন, পৃথিবীর যেখানেই আমরা ছড়িয়ে আছি, যে কোন ক্ষেত্রেই হোক, আমাদের লক্ষ্য হবে অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়া। পৃথিবীর প্রতিটি শহরের প্রতিটি প্রদেশের সেরা সেরা বাংলাদেশীরা একদিন বিশ্বকে জানিয়ে দিবে -আমরাও পারি-।
বাংলাদেশ শুধু কবির কল্পনায় নয়, বাস্তবেও হতে পারে সকল দেশের রানী। আর একটা পরীক্ষা মা।
এটা ভাল হলেই জার্মানীর এই ইউনিভার্সিটির মাস্টার্স প্রোগ্রামের ইতিহাসে বাংলাদেশের নাম লিখা হবে সেরা ছাত্রের তালিকায়। তুমি দেখে নিও মা, তোমার সোনার ছেলে তোমাকে দিয়ে আসা প্রতিজ্ঞা পূরণ করেই তবে দেশে ফিরবে।
ইতি
তোমার প্রবাসী ছেলে
ড্রেসডেন, জার্মানি
২০০৪
পোস্টটি আগে এখানে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।