আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নাস্তিকতা বাড়ছে, আস্তিকতার রূপান্তর হবে



বিশ বছর আগেও এত নাস্তিক ছিল কিনা সন্দেহ আছে। শুধু বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে এখানে। এবং এই নাস্তিকতার প্রসারের ক্ষেত্রে ইন্টানেট এক বিশাল ভূমিকা রেখেছে। ইন্টারনেটের আগে নাস্তিকতার পাঠ কঠিন ও প্রায় অসম্ভব ছিল। মনে আছে প্রবীর ঘোষের লেখা বই “ আমি যে কারণে ঈশ্বর বিশ্বাস করি না” মলাট ফেলে দিয়ে বাড়িতে পড়তে হয়েছিল।

আরজ আলী মাতুব্বরের “সত্যের সন্ধানে” পড়ে প্রশ্ন করার সাহস জুগে ছিল। এসব স্কুল লাইফের কথা। হুমায়ূন আজাদের “আমার অবিশ্বাস” কতবার পড়েছি বলার মত নয়। ঈশ্বর বা আল্লা নেই এই বিষয়ে তখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণপত্র, নানা থিউরি, আত্মা ইত্যাদি বিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এভাবে ঈশ্বর বিতর্কর একটা সমস্যা আছে।

এখনো বলতে গেলে বিজ্ঞান হাঁটা শুরু করেছে। আধুনিক বিজ্ঞানের বয়স ১০০ বছরের বেশি নয়। এই ১০০ বছর বিজ্ঞান পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। মানুষ চাঁদে গিয়েছে, মঙ্গলে যান পাঠিয়েছে। ক্লোন করেছে জীবদেহের।

ডারউইন থিউরি, নিউটন, আইনস্টাইন, হকিং... তবু ঈশ্বর নেই এ বিষয়ে আস্তিকের মনে কোন রেখাপাতই ঘটাতে পারে না। তাই বিজ্ঞানের প্রফেসর নেকীর আশায় পায়ে হেঁটে ইজতেমায় যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজ বিজ্ঞান গুলে খাওয়া লোক খেলাফতে আস্থা রাখে স্রেফ ভক্ত আর ধর্মীক চেতনা থেকেই। বিজ্ঞানকে গুলে খাওয়া মানুষ দিব্যি নবীর সমস্ত সুন্নতে বৈজ্ঞানিক ফজিলত আবিষ্কার করে ফেলে। এদের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই।

আর আল্লা বা ঈশ্বর আছে বা নেই বলে রাত পার করে দেয়া যাবে তবু তর্ক শেষ হবে না। তারচেয়ে বরং ঈশ্বর আছে এটা মেনে নিই আসুন! বেচারা ঈশ্বরের সঙ্গে আমাদের তো কোন বিরোধ জিইয়ে রেখে লাভ নেই। “ঈশ্বর” শব্দটাকে আমরা তাই মেনে নিলাম। আপাতত তিনি ঊর্ধলোকে থাকেন না পাতালে থাকেন সে বিতর্কও তুলবো না। বরং আস্তিকদের দাবী মোতাবেক তিনি সাত আসমানে থাকেন সেটাই মেনে নিব।

কাজেই ঈশ্বর মহাশয় এখন কোন ফ্যাক্ট নন। এটাই ইন্টানেট যুগে ধর্ম আলোচনার মৌলিক পার্থক্য। ঈশ্বর বা আল্লা আছেন এটা স্বীকার করেই ধর্মীকদের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। এভাবেই খুলে গেলো এক নতুন যুগের ধর্মালোচনা। ঈশ্বর বিশ্বাস করেও যেখানে যে কেউ হতে পারে প্রচলতি ধর্ম অবিশ্বাসী।

ব্যাপারটা যে দুনিয়াতে একদমই আনকোরা তা কিন্তু না। এ ধরনের মানুষ আগেও ছিল খুবই সংখ্যালঘু অবস্থায়। এই ইন্টারনেটের যুগে এবার তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকবে আশা জাগনিয়াভাবে। বলা বাহুল্য নাস্তিকদের চেয়ে এদের সংখ্যাই বেশি হবে সঙ্গত কারণেই। কারণ বেশির ভাগ মানুষ “ভবিতব্য” “দৈব” “ভাগ্য” মত ব্যাপার ত্যাগ করতে পারবে না।

মানব জীবনের উত্থান পতন, গ্রীক নাটকের নিয়তির নিষ্ঠুর খেলার মত মানুষ নিজের জীবনে এরকম অদৃশ্য কুশিলব আবিষ্কার করতেই থাকবে। জীবনের এই অনিশ্চতার খাঁজেই জন্ম নিয়েছে সাধারণ মানুষের একদমই নিজস্ব ঈশ্বর বা আল্লা। তারা নিজেরাও জানে না অনেক ক্ষেত্রে তাদের ধর্মীয় ঈশ্বর বা আল্লার সঙ্গে তাদের নিজস্ব ঈশ্বর বা আল্লার তফাত রয়ে যাচ্ছে। এই নিজস্ব আল্লাকে বেশির ভাগ মানুষ ত্যাগ করে উঠতে পারবে না। তারা আস্তিক, কখনও প্রচলিত সব ধর্মগুলো থেকে তারা বিশ্বাস হারিয়ে ফেললেও আস্তিক থেকে যাবে।

আমি সেই আস্তিকের বন্দনাই করি। আমি স্বপ্ন দেখি সারা বিশ্বে সেই আস্তিকে ভরে উঠছে। প্রচলিত ধর্মমত থেকে সরে আসছে। মানব ধর্ম প্রসার হচ্ছে। আমাদের বাউল দর্শন এই আস্তিকতার খানিকটা ধারন করে।

বাংলার বাউল সাধকরা সবাই এমন এক ঈশ্বরের ভজনা করেছেন যিনি আসলে প্রচলিত সব ধর্মীয় ঈশ্বর থেকে আলাদা। এ জন্য এই সাধকদের কাফের, ধর্মদ্রোহী ইত্যাদি ফতোয়ার শিকার হতে হয়েছেন। কিন্তু বাংলার কৃষক, মাঝি, জেলে এই চেতনার সঙ্গে পরিচিত। দুঃখের বিষয় রাত জেগে পালা গান, বাউল গানের আসরে গূঢ় ঈশ্বর চিন্তার যে দর্শন চলতো গ্রাম বাংলায় তার বিপরীতে বাংলার মধ্যবিত্তকে ড্রয়িংরুমে পিচ টিভিতে এক ভালগার ঈশ্বরের সঙ্গে পরিচিত হতে হয় জাকির নায়েকের ভাষ্যে। ইন্টারনেট সেই মধ্যবিত্তকেই পাল্টে দিতে পারে তার আস্তিকতা ধরনকে।

এ এক রূপান্তর। খুবই ধীর কিন্তু চলমান এক ধারা। আমি তাই বলি, ভাই, ধর্মীয় বই পড়–ন। বেশি বেশি করে ধর্মীয় বই পড়–ন। শুধুমাত্র ধর্মীয় বই পড়ে যত মানুষ নাস্তিক হয়েছে তত মানুষ বিজ্ঞানের বই পড়ে হয়নি, ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়ে হয়নি, কোন নাস্তিকের লেখা বই পড়ে হয়নি।

অনেক মাদ্রাসার ছাত্র ঘোর নাস্তিক হয়ে গেছে। মানুষের মধ্যে যারা ঘৃণা, বিদ্বেষ, সংক্রিনতা, সাম্প্রদায়িকতার বিষ লালন করে চলে তারা ধর্মীয় বইয়ের ভেতরের এই নির্যাসগুলো গ্রহণ করবে এ জন্য যে তারা আসলে মনের ভেতর এসবই লালন করে। কিন্তু দুনিয়ার বেশির ভাগ মানুষ এরকম না। তারা আসলে অসাম্প্রদায়িক কিন্তু তাদের সাম্প্রদায়িক বানানো হয়েছে। তারা হতে বাধ্য হয়েছে কারণ তারা ধর্মর কাছে জিম্মি।

একজন ক্ষমতাবান ঈশ্বর যিনি তাকে অমান্যর শাস্তি সরূপ আগুনে পোড়ানোর আগাম প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন। আমার নিজের বিশ্বাস এটার চাইতেও দুনিয়ার জীবনের অনিশ্চতা ব্যক্তিকে সাহসী হতে বাধা দেয়। সে ভয় পায় ঈশ্বরের বিধানের কোন একটার সঙ্গে দ্বিমত পোষন করলে ঈশ্বর হয়ত তাকে দারিদ্র দিয়ে, অভাব দিয়ে বা আরো বড় কোন সাংসারিক সমস্যা দিয়ে শাস্তি দিতে পারেন। এই ভাবনা তার চিন্তাকে মুক্ত হতে দেয় না। কারণ সে কখনো জানেনি কে এই ঈশ্বর? কারা এই ঈশ্বরের প্রতিনিধি? ঈশ্বরের প্রতিনিধিদের জীবন ও কর্ম, ঈশ্বরের বাণীর সবিরোধীতা, ঈশ্বরের উদ্দশ্য এসব তার অজানা।

এই অজানাই জানছে গত পাঁচ-ছয় বছর। আপনার পাশেই আছেন একজন নাস্তিক, যিনি প্রকাশ করেন না নিজেকে, হয়ত পরিপাশ্বিক চাপে আপনার সঙ্গে নামাজও পড়েন! তিনি হয়ত নাস্তিক নন, আস্তিকই, এক সময় আপনার মত প্রচলিত ধর্মর উপর আস্থা ছিল, আজ নেই। কিন্তু তিনি আস্তিক, রূপান্তিত আস্তিক। বাংলার গগন হরকার বাংলা মাঠে ঘাটে খুঁজে বেড়াতেন সেই ঈশ্বরকে “আমি কোথায় পাবো তারে...”। যে মাটিতে এমন সাধক মানুষ জন্মে সেখানে সময়িক পিচ টিভির প্রসার হতে পারে।

জাকির নায়েক যত লেকচারই ঝাড়–ন তাদের মন কিছুতেই পাবেন না। আর মধ্যবিত্ত তো সবেমাত্র ইন্টারনেটে খুঁজতে শিখেছে। আর বিশটা বছর যেতে দেন...। আমি ভাই সত্যি আশাবাদী।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।