গত রোববার ভোররাতে জেনেভায় ইরান ও বিশ্বের শক্তিধর ছয়টি রাষ্ট্রের মধ্যে এক সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে, যেটিকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। চুক্তিটিকে বলা হচ্ছে অস্থায়ী বা অন্তর্বর্তীকালীন। কারণ, তা কার্যকর থাকবে ছয় মাস। এ ছয় মাস ইরান চুক্তির শর্তগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ মেনে চলছে কি না, তা অপর পক্ষ পর্যবেক্ষণ করবে। ইরান তাদের সন্তুষ্ট করতে পারলে পরে একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
রোববার স্বাক্ষরিত অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিটির মূল বিষয় হলো, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির উপযোগী মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ আগামী ছয় মাস স্থগিত রাখবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ৫ শতাংশ সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়ামই যথেষ্ট। পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে হলে আরও অধিক মাত্রায় সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়ামের প্রয়োজন হয়। ইরান এ পর্যন্ত তাদের কয়েকটি পারমাণবিক কেন্দ্রে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে দেশটি পরমাণু অস্ত্র তৈরির উদ্দেশ্যেই অধিক মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে চলেছে। সদ্য স্বাক্ষরিত চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ইতিমধ্যে ইরানের কাছে ২০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধকৃত যে পরিমাণ ইউরেনিয়াম মজুত হয়েছে, ইরানি কর্তৃপক্ষ আগামী ছয় মাসে তার অর্ধেকটা ডাইলুট করে সমৃদ্ধির মাত্রা ৫ শতাংশে নামাবে।
ইরান আগামী ছয় মাস ৫ শতাংশের বেশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করবে না এবং নতুন কোনো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণকেন্দ্র স্থাপন করবে না। ব্যবহূত ইউরেনিয়াম পুনঃপ্রক্রিয়াকরণেরও চেষ্টা করবে না ইরান।
এসব শর্ত পালনের বিনিময়ে ইরান কী পাবে? এ বিষয়ে বলতে গেলে আগে সংক্ষেপে বলা প্রয়োজন যে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির উপযোগী মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে আসছে বলে তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে বছরের পর বছর ধরে। এ কারণে ইরানের অর্থনীতি অত্যন্ত রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। ইসরায়েলের আগ্রাসী আচরণ ও সৌদি আরবের তিক্ত বৈরিতার কারণে ইরানের অনেক মানুষ যদিও মনে করে, তাদের পরমাণু অস্ত্রের মালিক হওয়া জরুরি, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক নানা অবরোধের ফলে ইরানের অর্থনীতির যে করুণ দশা হয়েছে, সেটাও ইরানি জনগণের জন্য বেশ কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
এ রকম একটা মরিয়া পরিস্থিতিতে ইরান দৃশ্যত তাদের পরমাণু প্রকল্প আপাতত স্থগিত রাখতে রাজি হয়েছে, যেন দেশটির বিরুদ্ধে বহাল বহুপক্ষীয় অবরোধগুলো শিথিল করা হয়। অন্ততপক্ষে ইরান তার বিপুল তেলভান্ডার ও সোনাসহ মূল্যবান ধাতুর কিছু অংশ বিক্রি করে অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরাবে।
স্বাক্ষরিত চুক্তিতে বলা হয়েছে, ইরানের তেল বিক্রি আরও কমে যায়, এমন সব প্রয়াসে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো বিরতি দেবে (পজ এফোর্টস টু ফারদার রিডিউস ইরানস ক্রুড অয়েল সেল)। বিভিন্ন দেশে তেল রপ্তানি বাবদ ইরানের প্রাপ্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বকেয়া রয়েছে, অবরোধের কারণে ক্রেতা দেশগুলো সেই অর্থ ইরানের কাছে এত দিন পাঠাতে পারেনি। সদ্য স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ইরানের সেই অর্থ পাওয়ার পথে বাধা থাকবে না (যদিও কী পরিমাণ অর্থ হস্তান্তরিত হবে, সেটাও চুক্তির দুই পক্ষ আলোচনা করে স্থির করবে)।
বহির্বিশ্বের সঙ্গে ইরানের আর্থিক লেনদেনে অনেক নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিবন্ধকতা আছে। যেমন বহুজাতিক অনেক ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ও ব্যাংক ইরানকে সেবা দেয় না, ইরানের যেসব শিক্ষার্থী ইউরোপ-আমেরিকায় পড়াশোনা করে, তারাও বৈধ পন্থায় টিউশন ফির অর্থ ইরান থেকে নিতে পারে না। খাদ্য, ওষুধপথ্য, চিকিৎসার সরঞ্জামসহ অনেক মানবিক সেবাপণ্যও ইরান আমদানি করতে পারে না। এমনকি জাতিসংঘের চাঁদা বাবদ ইরানের প্রদেয় যে অর্থ বকেয়া রয়েছে, সেটা হস্তান্তরেরও কোনো বৈধ আর্থিক চ্যানেল নেই। রোববারের চুক্তিতে বলা হয়েছে: ইরানের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন মেটাতে মানবিক সেবাপণ্যের ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা দিতে বহির্বিশ্বের সঙ্গে ইরানের আর্থিক লেনদেনের জন্য একটি ‘ফাইন্যান্সিয়াল চ্যানেল’ সৃষ্টি হবে; নির্দিষ্ট কিছু বিদেশি ব্যাংক ও ইরানি ব্যাংকগুলোকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইরানের পেট্রোকেমিক্যাল, সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা ছয় মাসের জন্য স্থগিত রাখবে। এ রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইনস্যুরেন্স ও পরিবহনসেবার ওপরে নিষেধাজ্ঞাও স্থগিত হবে। ইরানের ওপর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পরমাণুসংক্রান্ত যে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ আছে তা থাকবে, তবে নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও এ রকম নিষেধাজ্ঞা আছে, সেটাও থাকবে। তবে নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে না।
ইরানের ওপর একপক্ষীয় অবরোধ সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় জারি করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র; চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেসের আলোচনা সাপেক্ষে পরমাণুসংক্রান্ত আর নতুন কোনো অবরোধ আরোপ করা হবে না।
এ চুক্তি অনুযায়ী আগামী ছয় মাস ইরান বাড়তি কিছু পাবে না; তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হবে তেল রপ্তানি বাবদ বিভিন্ন দেশের কাছে তার যে অর্থ প্রাপ্য আছে, এখন সে তা পেতে যাচ্ছে। এ অর্থের পরিমাণ ৪২০ কোটি মার্কিন ডলার। আর বিভিন্ন অবরোধ স্থগিত রাখা হলে আগামী ছয় মাসে ইরানের আয় হতে পারে ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু অবরোধ যদি তুলে নেওয়া হতো, তাহলে আগামী ছয় মাসে তেল বিক্রি থেকেই ইরানের আয় হতে পারত তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলার।
কিন্তু তা করা হয়নি, আগের মতোই নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি অপরিশোধিত তেল আগামী ছয় মাসও রপ্তানি করতে পারবে না।
ইরান আসলে অ্যাটম বোমা চায়; কিন্তু সেটা বানাতে গেলে শক্তিধর বৈরীবিশ্ব তাকে ফতুর, ভুখা-নাঙ্গা বানিয়ে দিতে পারে। তাই ইরান আপাতত অ্যাটম বোমার স্বপ্ন সরিয়ে রাখতে বাধ্য হলো। কিন্তু তাতেও তার বিপদ যাবে না। প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ ইসরায়েল ফুঁসছে হাসান রুহানি বারাক ওবামাকে বোকা বানালেন ভেবে।
মাথা খারাপ করে সে ইরানের দিকে মিসাইল না ছুড়ে দেয়! সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের নাকি গোপনে কথা হয়েছে, ইরানকে শায়েস্তা করতে ইসরায়েলকে সৌদি আকাশসীমা ব্যবহার করতে দেবে। কিন্তু এ রকম সম্ভাবনা বোধ হয় কম। ইরানের বিপদ বরং কূটনৈতিক; ওবামা প্রশাসনের লোকজন নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ইরান যদি আগামী ছয় মাস চুক্তি মেনে না চলে, যদি লুকোছাপা করে, চোখে ধুলা দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে এ অস্থায়ী চুক্তি তো বাতিল করবেই, উপরন্তু নতুন করে আরও অনেক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। এমনকি ইরানের প্রকল্পগুলোর ওপর তখন সামরিক আক্রমণও যে হবে না, এটা কে নিশ্চিত বলতে পারে?
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।