নির্বাচন নিয়ে সিপিবি-বাসদের বক্তব্য: একটি ভুল বার্তার অবকাশ
ড. মঞ্জুরে খোদা
নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে জনগণের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা ততোই বাড়ছে। বিএনপি-জামাতের নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট দিন দিন বেপরোয়া ও মরিয়া হয়ে উঠেছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তারা হরতাল-অবরোধ বোমাবাজি ও জ্বালাও-পোড়াও এর কয়লা নীতি গ্রহন করেছে? দেশ দিন দিন আরও অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে। সাধারণ নাগরিক এবং রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিরা নানা ভাবে এই অবস্থাকে ব্যাখ্যা করছে। ক্ষমতা দখল ও রক্ষার এই যে নীতিহীন লড়াই সাধারন মানুষের জীবন ও সম্পদের প্রভূত ক্ষতি করছে।
একদিকে বিরোধী দলের এই নাশকতাকে মানুষ সমর্থন করছে না অন্যদিকে নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থানও গ্রহন করছে না। বরং মানুষের নিরাপত্তা না দিতে পারার কারনে সরকারী দলকে অভিযুক্ত করছে।
এর মধ্যে বেশ কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে যে বিতর্ক ও প্রশ্নটি লক্ষ্য করছি তা হচ্ছে নির্বাচন প্রসঙ্গে সিপিবি-বাসদের বর্তমান অবস্থান। বিশেষ করে সাবেক ও বর্তমান সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন বলয়ে এ নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছি। যে বিষয় গুলো সেখানে আলোচিত হচ্ছে তা হলো সিপিবি-বাসদের নির্বাচন অংশ নেওয়া না নেওয়া কতটা ভুল ও সঠিক ইত্যাদির বিশ্লেষণ।
বিষয় গুলোর ব্যখ্যা সিপিবি-বাসদই আরও ভাল ভাবে দিতে পারবে । তবে এই বিষয়ে আমার মতামত হচ্ছে, নির্বাচনের হিসেবে সিপিবি-বামপহ্নীরা এখনও কোন প্রভাবকের পর্যায়ে যায়নি কিন্তু এটা আমরা জানি ও বিশ্বাস করি যে এর রাজনৈতিক গুরূত্ব ও তাৎপর্য অনেক বেশী। আর সেই আকাঙ্খা ও যন্ত্রনা থেকেই নেতা, কর্মী, সমর্থক, শুভাকাঙ্খীদের মধ্যে এই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। আমার বিবেচনায় এখানে প্রধান যে বিষয়গুলো তার একটি হচ্ছে গ্রহনযোগ্য নির্বাচন মানে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহন নিশ্চিত করা, তার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাকি অন্য কোন ফর্মূলা সেটি এবং আরেকটি বিষয় হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থা-পদ্ধতির সংস্কার ও এই প্রশ্নের দীর্ঘ মেয়াদী ফয়সালা। কেবল ক্ষমতাকেন্দ্রীক গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের এই দাবী দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের আপাত স্বস্তির হতে পারে কিন্তু তা কোনভাবেই দীর্ঘ মেয়াদের সমাধান দিবে না।
কোন দল ও জোটের খন্ডিত দাবির পূরণ ও এজেন্ডা বাস্তবায়ন (সহায়ক হওয়া) সিপিবি’র রাজনীতি হতে পারেনা। সিপিবি-বাসদের পক্ষ থেকে যে নির্বাচন পদ্ধতি ও ব্যবস্থা সংস্কারের কথা বলা হয়েছে সেটা নিয়ে তাদের অবস্থান অধিক স্পষ্ট ও পরিষ্কার করতে হবে। সিপিবি-বাসদ যদি নির্বাচনে অংশগ্রহন করে তাহলে বর্তমান যে পরিস্থিতি তার কি কোন পরিবর্তন হবে? তা যদি না ঘটে তাহলে সিপিবি-বাসদ কেন এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির দায়-দায়িত্ব নেবে? সেই রাজনৈতিক আকাঙ্খা অর্জন ও নির্বাচন বর্জন অনেক বেশী যৌক্তিক ও গ্রহনযোগ্য হতো।
আওয়ামী লীগও কি বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন করতে চায়? চায় না। সে তার মত করে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে/করছে দলটিকে নির্বাচনে আনার।
কেন করেছে? নির্বাচনের গ্রহনযোগ্যতা (দেশে-বিদেশে), নির্বাচন পরবর্তি রাজনৈতিক অবস্থা এবং ভবিষ্যত ক্ষমতার বিষয়টি আওয়ামী লীগ বুঝলেও অনেক বন্ধু তা বুঝতে ও মানতে পারছেন না। এখানে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয়টি যেমন সত্য তেমনি এটাও তো মানতে হবে একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রন নিশ্চিত করা। আর যদি কেউ বলেন বিএনপি আসলে নির্বাচনে অংশগ্রহন করবেনা বা নির্বাচন হোক তা তারা চায়না। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম তাই ঠিক, এবং তা যদি সত্য হয় তাহলে সরকার এবং দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তাকে সেই সুযোগ দেবে কেন? বা নিজে সেই ফাঁদে পা দেবে কেন? মনে রাখতে হবে গত নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছে ৩৪ শতাংশ ভোট, বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পেয়েছে ৫৭ শতাংশ ভোট আর তাদের বাইরে রেখে এই নির্বাচন করলে কি তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে না? একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে সিপিবি এই কথাটাই বলতে চেয়েছে। আর এই বক্তব্যই সিপিবি পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল একটি বৃহৎ অসাম্প্রদায়িক সামাজিক বলয়কে আশাহত করেছে।
বর্তমান এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে নির্বাচনে যাবার উপযুক্ত পরিবেশ নাই বিধায় সিপিবি নির্বাচন করা থেকে নিজেদের বিরত রাখছে, এই বক্তব্য অনেক বেশী গ্রহনযোগ্য হবে। বিএনপি যাকে গ্রহনযোগ্য নির্বাচন ও নির্বাচনের পরিবেশ বোঝায় নিশ্চয়ই সিপিবি তা বোঝায় না। তাহলে কেন বিএনপি’র নির্বাচনে যাওয়া মানে সকলের অংশগ্রহনে গ্রহনযোগ্য নির্বাচনে নিজেদের অংশ নেয়া না নেয়ার বিষয়টি যুক্ত করা হলো। তর্কের খাতিরে না হয় মানলাম এই নির্বাচন একটি তথাকথিত গ্রহনযোগ্য ফর্মূলায় করা হলো, তারপর? কোন স্থায়ী বা দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যার সমাধান তো হলো না! আবারও সেই একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তার দায় কে বহন করবে? সেই বক্তব্য কোথায়? সেটাও কি একটি উপযুক্ত বক্তব্য হতে পারতো না এই নির্বাচন থেকে সরে দাড়ানোর? তাহলে কেন ঘটা করে এমন বক্তব্য দেয়া হলো যার মাধ্যমে এই বলয়ের বৃহৎ অংশের কাছে এই সিন্ধান্তের একটা ভুল সংকেত যাবে? জোট-মহাজোটের বাইরে যেমন বাম-গণতান্ত্রিকদের একট তৃতীয় শক্তির আহ্বান রাখা হয়েছে, একইভাবে বলা-বক্তব্যের ক্ষেত্রেও হতে হবে যথেষ্ট কৌশলী ও সতর্ক।
সিপিবি-বাসদের দাবী অনুযায়ী আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ দাও আর বিএনপি জামাত ছাড়ো।
সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ যদি বিএনপিকে নির্বাচনে আনার একটি কৌশল ও পরিবেশ তৈরী করে তাহলে বিএনপি কি জামাতকে ছাড়বে? এই ক্ষেত্রে সিপিবি নেতারা কি বলবেন? সেই ক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান কি হবে? নির্বাচনের পক্ষে না বিপক্ষে? এই ক্ষেত্রে সিপিবি’র বক্তব্য যথেষ্ট সতর্ক ও যুক্তিপূর্ণ না হলে অনেকের কাছে সেটা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে। যে প্রশ্ন গুলো এখন নানা ভাবে ঘুরে ফিরে আসছে। তাই বলছি পরিস্থিতি খুব জটিল ও কঠিন। সিপিবি’র জন্য এই ধরনের অগ্নিপরীক্ষা এটিই প্রথম নয়, এর আগেও দলটিকে আরও অনেক কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে। বিষয়, পরিস্থিতি ও সময়ে সঠিক সিন্ধান্ত না নিতে পারার যন্ত্রনা, গ্লানি ও অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই দলের নেতৃত্বকে অনেক পরিপক্কতা দিয়েছে।
এখন আর একটি উপযুক্ত সময় পার করছে, প্রয়োজন যথার্থ বক্তব্য ও সিন্ধান্ত।
নির্বাচনকে ঘিরে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হচ্ছে জামাতসহ সাম্প্রদায়িক মৌলবাদের বিপদ মোকাবেলা করার প্রশ্নটি। কিন্তু তাদের মোকাবেলা করার কৌশল কি? এই বিপদ শুধু বাংলাদেশে নয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যে যার মত করে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। একটা নির্বাচন দিয়ে, তাদের নিষিদ্ধ ও দমন-পীড়ন করে কি তা সম্ভব? সাম্প্রদায়িকতার মূল উপাদান রাষ্ট্র-সমাজ-দলে রেখে তা সম্ভব নয়। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর পুষ্টি যোগায় যে উপাদান গুলো তাকে শুকিয়ে মারতে নীতি গ্রহন করতে হবে।
তার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ মেয়াদী শিক্ষা, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। আর তার জন্য অতি প্রয়োজন একটি গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখা। কিন্তু যে কোন ভাবে কারো ক্ষমতায়ন যেন সেই প্রশ্ন ও প্রয়োজনের দীর্ঘ মেয়াদে নির্বাসনে না পাঠায়। তাতে কোনভাবে মূল লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না।
মুক্তিযুদ্ধের যেটুকু অর্জন তা যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয় এ ব্যপারে আমিও একমত।
কিন্তু তা কিভাবে? সেই অর্জন রক্ষা করতে যেয়ে এমন কোন কাজ করা ঠিক হবেনা যা ‘স্মাট সুশীলদের বিশেষ আরেকটি অরাজনৈতিক এজেন্ডা’ বাস্তবায়ন করা সুযোগ করে দেয়া। যে কোনভাবে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকুক এবং তাকে কোনভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না করে বুর্জোয়া রাজনীতির নানা সমীকরণের মধ্যে তা করতে হবে। সেই ভুলের মাশুল আমরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও তার পরবর্তি সময়ে বেশ কয়েকবার দিয়েছি। গণতন্ত্রের চলার পথকে আমরা মসৃন করতে পারিনি। নির্বাচন হলে সিপিবি ক্ষমতায় যাবেনা, এমনকি কোন আসনও না পেতে পারে, তাহলে কেন তারা এত সতর্ক? আমার মনে হয় সেই উপলব্ধি অনুধাবনের রাজনৈতিক জ্ঞান ও মান নিশ্চয়ই তাদের আছে যাদের আকাঙ্খাকে সিপিবি ধারণ করতে পারেনি।
তবে তাদের যে যন্ত্রনা ও অস্থিরতা তা আমার মধ্যেও প্রচন্ড আছে। আমিও প্রায়ই এই বিষয়ে সংশয়ী হয়ে উঠি..। তবে এটুকু বুঝি যে কোন বিপদ ও জটিল পরিস্থিতিতে নিয়ত ঐক্য ও মতাদর্শগত সংগ্রামের কাজটি অধিক গুরূত্বপূর্ণ।
লেখকঃ মঞ্জুরে খোদা টরিক, গবেষক, ইনস্টিটিউট অব পলিসি সাইন্স, সাবেক ছাত্রনেতা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।