আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাবিবুর রহমান: বঞ্চিত এক সংবাদপত্রসেবীর নাম - তৌহিদ জামান



একজন চৌকিদারের তিন মাস বেতন বন্ধ। কত কষ্টে, মানবেতর দিন কাটাতে হচ্ছে তার- এরই বিশদ বর্ণনা কম্পোজ করছেন হাবিবুর রহমান। কম্পোজ করছেন আর মিটিমিটি হাসছেন। দৈনিক ঠিকানা’র এই কম্পোজিটরের মিটিমিটি হাসির কারণ হচ্ছে গত ছয় মাস ধরে তিনি বেতনহীন। হাসির আরেকটি বড় কারণ-এ রিপোর্টটি যিনি করেছেন সেই সাংবাদিক সাহেবেরও প্রায় এক বছরের বেতন বাকি রয়েছে ।

এ ধরনের নানা দুঃখ- বেদনার ভেতর দিয়ে জীবন অতিবাহিত হলেও বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই যার চোখেমুখে সেই মানুষটি হচ্ছেন হাবিবুর রহমান। যশোরের সংবাদপত্রসেবীদের কাছে যিনি হাবিবভাই নামে পরিচিত। দেশের অনেক পত্রিকাতেই রয়েছে তার ভালবাসা আর অভিজ্ঞতার সুনিপুণ হাতের ছোঁয়া। কাগজকে ভালবেসে যিনি কখনও বেতনভাতার দিকে মনোনিবেশ করেননি। যে কারণে দিনের পর দিন চলে গেছে, তার মুখে পড়েনি এক টুকরো খাবার।

তাতে কী-পরদিন সকালে তো তিনি দেখতে পারছেন তার সন্তানতুল্য সংবাদপত্রটিকে। না পাওয়ার বেদনা, কষ্ট, যাতনা নিমেষে সব আনন্দের ফল্গুধারা হয়ে ঝরে পড়েছে সমগ্র মুখায়বে। পরিতৃপ্তির যে ঝিলিক উঁকি দেয় তার সারাদেহমনে এমন সুখ কি আর কোথাও তার জন্য রক্ষিত আছে ! যশোর শহরের নাজির শংকরপুরের বাসিন্দা হাবিবভাই ১৯৪৯ সালের পৌষমাসে জন্মগ্রহণ করেন। আবুবকর সিদ্দিক ও জোহরা বেগমের সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে হাবিবুর রহমান সবার ছোট। শহরের নিউ মডেল স্কুল বর্তমানে আব্দুস সামাদ মেমোরিয়াল স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে মেট্রিক পাশ করেন।

কলেজজীবনে না যেতে পারা এ মানুষটি ঐ বছরই যুক্ত হন পত্রিকার সাথে। যশোরের প্রথিতযশা সাংবাদিক মাহমুদুল হক তাকে তার সম্পাদিত সাপ্তাহিক নতুন দেশ-এ কাজ দেন। শুরু হয় হাবিবভাইয়ের সংবাদপত্রে বর্ণাঢ্য কর্মজীবন। এখানে তিনি কম্পোজিটরের কাজ নেন। বলে রাখি, তখন সংবাদপত্র ছাপা হত লেটারপ্রেসে।

এখানে কয়েক মাস কাজ করার পর তিনি সোজা চলে যান ঢাকায়। কাজ পান দৈনিক ইত্তেফাক-এ। লেটার সেকশনে, কম্পোজিটর হিসাবে যোগদান। মাসিক বেতন সত্তুর টাকা। মালিবাগে একটি মেসে থাকতেন আর প্রতিদিন সেখান থেকে হেঁটে ইত্তেফাক অফিস।

বছরখানেক এখানে চাকরি করেছেন তিনি। এরপর ১৯৬৮ সালের শেষদিকে তিনি চলে আসেন খুলনায়। দি নিউজ নামে একটি ইংরেজি দৈনিকে কাজ পান। এ পত্রিকার সম্পাদক মঈন পয়ামী খুলনার লোক। মাসিক পয়তাল্লিশ টাকা বেতনের এ চাকরি আর খুলনার টুটপাড়াস্থ একটি মেসে কোন রকমে দিন পার করতে লাগলেন।

হাবিবভাইয়ের জীবনের সাথে মিল আছে এমন একটি ঘটনা ঠিক এখানে ঘটে যায়। এবার কষ্ট করে তার চাকরি ছাড়তে হয়নি, ছয় মাস পর পত্রিকাটিই বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী মিশন সাপ্তাহিক জনবার্তা। এ পত্রিকার সম্পাদক সোহরাব সাহেব। হাবিবভাই এ পত্রিকাতে মেকাপম্যান হিসাবে যোগদান করেন।

বেতন আশি টাকা। যদিও তিন-চার মাস তা বকেয়া থাকতো। বকেয়া বেতন আদায়ের আন্দোলনে নানা স্মৃতি বেরিয়ে আসে মনের গহীন থেকে। সম্পাদককে ফাঁসাতে কত কী করেছেন তিনিসহ তার সহকর্মীরা। এমনকী রাতের অন্ধকারে গোপনে প্রেসরুমে ঢুকে হেডিঙের একটি অক্ষর তুলে ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।

পরদিন পত্রিকা ছাপা হয়ে এলে বেশ বিতর্কের জন্ম দেয়। এ ঘটনার পর অবশ্য তার সেখানে চাকরি থাকার কথা নয়, এবং তা-ই হয়। ১৯৭০ সালের দিকে তিনি মেকাপম্যান হিসাবে যোগ দেন খুলনার সাপ্তাহিক পূর্বাঞ্চলে। সম্পাদক সাহেব তাকে একশ’ দশ টাকা করে মাসিক বেতন দিতেন। পূর্বাঞ্চলের সার্কুলেশন বেশ ভাল, পাঁচ হাজারের মত কাটতি।

বেশ কেটে যাচ্ছে দিন। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে তার স্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে, একটি টেলিগ্রাম প্রকাশ নিয়ে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, তিনি সম্পাদককে অনুরোধ করেন একটি টেলিগ্রাম বের করার জন্যে। সম্পাদক সায় দিলে সহকর্মী ময়জুদ্দিনের সহায়তায় টেলিগ্রামটি বের করেন, যা সেইসময় আলোড়ন সৃষ্টি করে। পূর্বাঞ্চলে আরো কিছুদিন হয়তোবা কাজ করা যেত।

কিন্তু এরই মাঝে ঘনিয়ে আসে সেই কালোক্ষণ। ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন। তার ভাষায়,‘আমাদের প্রিয়নেতা এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে চারটি বাদে অন্যান্য সকল পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেন। কী খাবো- সেই চিন্তা কখনোই মনে আসেনি। শুধু ভাবতাম পরদিন সকালে আমার সন্তানতুল্য পত্রিকার মুখ দেখতে পাবো না।

এই হাহাকার বুকের ভেতর থেকে উঠে আসতে থাকে। তবে কিছুদিন পর ঢাকা থেকে ডাক পাই। দৈনিক জনপদ নামে একটি পত্রিকার প্রেস রেডি হয়ে গেছে। গফ্ফার চৌধুরী এটি সম্পাদনা করবেন। কিন্তু আমার শারীরিক অবস্থা তখন বেশ খারাপ।

তাদের সে ডাকে সাড়া দেয়া হয়ে ওঠেনি আমার। ’ এ কথা বলার সময় একটু কি বুকটা কেঁপে উঠেছিল হাবিবভাইয়ের ! ... ১৯৭৫ সালে চলে এলেন একেবারে যশোর। ফিরে চল মাটির টানে-র মত অবস্থা। সাপ্তাহিক ঠিকানাতে কাজ শুরু। আর এখান থেকে কত মানুষের জীবনের চড়াই-উৎরাই দেখলেন তিনি।

‘পত্রিকাটি দৈনিক হিসাবে আবির্ভূত হওয়া পর্যন্ত কাজ করেছি। আবুল হোসেন মীর এ পত্রিকার সম্পাদক। ’ একবার হয়েছে কী, প্রিন্টার্স লাইন ভেঙে যাওয়ায় কম্পোজিটর শাজাহান তার কাছে জিজ্ঞাসা করে ওস্তাদ কী লিখবো- রসিকতা করে তিনি বলেছিলেন, সম্পাদক প্রকাশক সবকিছুতে লেখো হাবিবুর রহমান। ‘এই একদিন আমি সম্পাদক-প্রকাশক সবই হলাম। ’ পরদিন অবশ্য অন্যচিত্র।

সম্পাদক সাহেব জানতে চাইলে বলি, ‘দেশে কখন কে প্রেসিডেন্ট হয়ে যাচ্ছে-আজ সাত্তার সাহেব তো কাল এরশাদ সাহেব। তাই আমিও একদিনের জন্যে সম্পাদক হয়ে গেলাম আর কি ! দৈনিক ঠিকানাতে আমার বেতন ছিল একশ’ ষাট টাকা। ’ দৈনিক স্ফুলিঙ্গ পত্রিকায় পাঁচ বছরের মত কাজ করেছেন হাবিবভাই। ১৯৭৭ সালে এখানে যোগ দেন। মেকাপম্যান হিসাবে এখানে তার বেতন ধার্য করা হয় একশ’ আশি টাকা।

বেতন প্রদান যথারীতি অনিয়মিত। বেতনের চিন্তার চেয়ে নতুন পত্রিকার দিকে সদা আগ্রহ তার। সে কারণে ১৯৮২ সালের দিকে তিনি একশ’ পচিশ টাকা বেতনে দৈনিক রানার-এর চাকরিতে ঢোকেন। দু’বছর পর এখান থেকে চলে আসেন দৈনিক কল্যাণ-এ। কল্যাণে বছর পাঁচেক প্রিন্টিং ইনচার্জ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

বেতন দাঁড়ায় দুইশ’ পচিশ টাকাতে। কল্যাণের পর তিনি তিন মাস বিনা বেতনে সার্কুলেশন ইনচার্জ হিসাবে কাজ করেন সেই সময় যশোর থেকে অফসেটে প্রকাশিত একমাত্র পত্রিকা দৈনিক টেলিগ্রাম-এ। এ পত্রিকাটি মালিকানা দ্বন্দ্বের কারণে পরবর্তীতে আর সেভাবে প্রকাশ পায়নি। ফকির শওকতের সম্পাদনায় এরপর বাজারে আসে দৈনিক লোকসমাজ। এ পত্রিকার উদ্বোধনের সময় প্রকাশক তরিকুল ইসলাম তাকে সার্কুলেশনে কাজ করতে বলেন।

তিনি শুরুও করেন। দশ বার দিন পর শুনতে পান তার স্থলে যোগ দিয়েছেন নতুন কর্মী। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। চাকরিহীন হাবিবভাই। মূলত নব্বই সালের পর থেকে তিনি আর ঐভাবে কোন পত্রিকার সাথে নেই।

বয়স বাড়ছে-কিন্তু এখনো পত্রিকায় কাজ করার জন্যে উদগ্রীব এই মানুষটাকে প্রশ্ন করলে ছলছল চোখে বলেন অনেক কথা। তার কন্ঠে বাজে ভালোলাগার অনুরণন। বেশ দিলখোলা এ মানুষটা বলেন, ‘এক জায়গায় বেশিদিন কাজ করার চেয়ে নতুন নতুন জায়গাতে কাজ করতেই আমার আনন্দ। আমি রাত-বিরাতে কাজ করেছি দৈনিক পূরবীতে। কোন পয়সা নিইনি।

কুষ্টিয়ার সাপ্তাহিক ইস্পাত, বগুড়া থেকে প্রকাশিত করতোয়া, ঢাকার গণকণ্ঠ, দৈনিক সমাজ, সাপ্তাহিক মুক্তিবাণী এমন বিভিন্ন পত্রিকায় তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত কাজ করেছি। ’ ‘বেতন ছাড়া কাজ করতে কোন অসুবিধা হয়নি’-এমন কথা তিনি কীভাবে বলেন? বলতে পারেন যদি সাথে থাকেন তেমন সহধর্মিনী । হাবিবভাইয়ের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হচ্ছেন তার স্ত্রী। ১৯৭৫ সালে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিন ছেলে তার।

বেশ কয়েকটা ঈদ গেছে কিছুই কিনতে পারেননি। না ছেলেদের কাপড়, না বাজার-সদাই। বড়ছেলের বয়স যখন সাত-আট তখনকার কথা। সেবার ঈদে সেমাই কিনতে গেছেন দোকানে, বাকিতে। ছেলে বলে, বাবা বাকিতে সেমাই খাওয়ার চেয়ে না খাওয়াই ভালো।

সেমাই না খেলে কী হয়? একবার শবেবরাতের সময় সম্পাদকের (দৈনিক ঠিকানা) কাছে টাকা চাইলাম। তিন মাসের পাওনা রয়েছে। এক টাকাও দিলো না। কিন্তু কাজ ছাড়িনি। পত্রিকা বন্ধ হোক তা কোন সাংবাদিক বা কর্মচারী চায় না।

যত কষ্টই হোক না কেন সারাদিন-রাতের পরিশ্রমের ফসল পত্রিকাখানি পরদিন সকালবেলাতে দেখতে পেলে সব দুঃখ বিলীন হয়ে যায়। ‘ওয়েজবোর্ডের জন্য আন্দোলন- তাও করেছি। পত্রিকা মালিক জানান, আমরা পত্রিকার স্টাফ নই। আমরা প্রেসের লোক। কিন্তু সে সময় প্রখ্যাত সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী যশোরে এলেন।

তার সাথে তিনঘণ্টা বৈঠক চললো। ’ তিনি বলে গেলেন, আমরা পত্রিকারই স্টাফ। ওয়েজবোর্ড প্রাপ্তির অধিকার আমাদের আছে। কিন্তু এরপরই আমাকে সম্পাদক সাহেব ধরিয়ে দিলেন সেনাবাহিনী দিয়ে। ‘তিনমাস আমাকে অন্তরীণ থাকতে হয়।

অনেক নির্যাতন সহ্য করেছি। আমার মুক্তির জন্য কোন আন্দোলন হয়নি। আমি কিন্তু ঠিকানার ক্ষতি চাইনি। কেননা পত্রিকার মালিক তো আর মীর সাহেব (আবুল হোসেন মীর) নন, এর মালিক হচ্ছে দেশের জনগণ। আমি সবসময় চাই, পত্রিকা টিকে থাক।

বেতন-ভাতা টাকা-পয়সা বড় কথা নয়। ’ বর্তমানে টুকটাক প্রেসের কাজ করে যাওয়া হাবিবভাই বলেন, ‘কেন যে মানুষ সাংবাদিকতায় আসে। তারা কখনো তাদের ন্যায্য পাওনা পায় না। বিশেষ করে মফস্বলে তো সাংবাদিকদের কোন মূল্যায়নই নেই। প্রেসকর্মচারীদের চেয়ে তাদের বেতন কম।

তাছাড়া তাদের বেতন অনিয়মিতও বটে। ’ এত প্রশ্নের উত্তর নিজে নিজে পেয়েছি- জানান হাবিবভাই। আসলে নেশা। আবিষ্কারের নেশা। ভালোলাগার নেশা, ভালোবাসার নেশা।

তার আক্ষেপ, যশোরে কত ভালো ভালো সাংবাদিক রয়েছেন। তারা কত সুন্দর সুন্দর লেখেন। অথচ তাদের ন্যূনতম সম্মান দেয়া হয় না। সবচেয়ে কষ্টের কথা হলো, ১৯৮৫-’৮৬ সালের দিকে আমি একটি পত্রিকার ডিক্লিয়ারেশন চেয়েছিলাম। শ্রমিকদেশ নামে ঐ পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে শাহাদাত হোসেন কাবিল আর প্রকাশক হিসাবে রয়েছে আমার নাম।

বিনা ঘুসে যদি ডিক্লিয়ারেশন পাই, তবে পত্রিকা বের করবো। নইলে না। #

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.