আমিও সেই কলেজে পড়েছি। বলা যেতে পারে এক ধরনের ভ্রাতৃত্ববোধ যাকে ইংরেজীতে Fraternity বলা হয়, আমাকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে খাঁটি বাঙালি। এই বাঙালিত্বের চেতনাকে তিনি সারাজীবন লালন করে এসেছেন এবং এই চেতনা তার সকল মননশীল তথা মনোজাগতিক কর্মকাণ্ডে সার্থকভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল। অক্সফোর্ডে পড়াশুনা করতে গিয়ে হাবিবুর রহমান ইউরোপের উদারনৈতিক ও মানবতাবাদী দর্শনের সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হন যা তাঁর চিন্তা-চেতনাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই যখন হাবিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন সে সময় আমাদের ভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই আন্দোলন হাবিবুর রহমানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণ শিক্ষক থাকাকালীন তিনি এই আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়লেন। এর জন্য তাকে বেশ কিছু সময়ের জন্য কারারুদ্ধ থাকতে হয় এবং তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিও হারাতে হয়। এই সময় ছিল তার জীবনে এক ক্রান্তিকাল।
তার চিন্তা চেতনায় এক গভীর অন্তবীক্ষণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। তিনি স্বদেশ চিন্তায় গভীরভাবে আত্মমগ্ন হন। তাঁর সমসাময়িক প্রিয় বন্ধু জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মত তিনি সক্রিয় রাজনীতির পথে না গিয়ে সৃজনশীল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। বাঙালি জাতিসত্ত্বা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার উদ্দেশ্যে তিনি বাঙালির ইতিহাস, ভাষা, ও সাহিত্য সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞান অর্জনের দিকে মনোনিবেশ করেন। বস্তুত এটা হয়ে পড়ে তার জীবনের সাধনা।
পেশাগত দিক দিয়ে তিনি পর্যায়ক্রমে ইতিহাসের অধ্যাপক, আইনজীবী, ব্যরিষ্টার এবং বিচারকের আসনে অধিষ্টিত থাকলেও বুদ্ধি ও তার চর্চার প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় অনুরাগ। এটাকে তিনি সবসময় লালন করে এসেছেন। এর ফলশ্রুতি হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে তার রচিত বাংলার ইতিহাস, ভাষা ও সাহিত্য, বিশেষ করে, রবীন্দ্র সাহিত্য সম্পর্কে কয়েকটি অসাধারণ বই যেমন “গঙ্গা ঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ”, “যথাশব্দ”, “মাতৃভাষার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথ,” “রবীন্দ্র রচনার রবীন্দ্র ব্যাখ্যা” “রবীন্দ্র বাক্যে আর্ট সংগীত ও সাহিত্য” প্রমুখ। বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রতি হাবিবুর রহমান অসাধারণ অনুরাগ পোষন করতেন। সমগ্র রবীন্দ্র রচনাবলি অত্যন্ত যতেœর সঙ্গে পাঠ করে তিনি রবীন্দ্র সাহিত্যের যে বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যা করেছেন সেটা সত্যি বিস্ময়কর।
অন্যান্য বিষয় সম্পর্কেও হাবিবুর রহমান বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে লিখে গেছেন। আইন সংক্রান্ত তার কয়েকটি মূল্যবান বই রয়েছে। ইদানিং হাবিবুর রহমান বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রচুর লিখেছেন। শুধু তাই নয়, কবিতা ও ছড়া রচনাও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
হাবিবুর রহমানের প্রতিভার আর একটি অসাধারণ দিক হল তার ধর্মচেতনা।
কিন্তু তাঁর এই চেতনা অন্ধবিশ্বাস ও গোঁড়ামি বিবর্জিত। প্রথম যৌবনে পশ্চিমি দুনিয়ার উদারতা যুক্তিবাদী, মানবতাবাদ যেমন তাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল, বিশেষ করে অক্সফোর্ডে অধ্যায়ন কালে, তেমনি পরবর্তীতে পরিণত বয়সে তাঁর চিন্তা-চেতনার আধ্যাত্মিক ধর্মীয় অনুভূতির জাগরণ দেখতে পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে আমি তাঁর দুটি অসাধারণ প্রকাশনার কথা উল্লেখ করতে চাই। প্রথমটি “কোরআনসূত্র”। এই গ্রন্থটি বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে।
এর পর এর বেশ কয়েকটি পুনঃমুর্দ্রন প্রকাশিত হয়েছে। বস্তুত এই বইটি কোরআন সম্পর্কে এক ধরনের কোষগ্রন্থ বা অভিধান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। নিঃসন্দেহে এটি হাবিবুর রহমানের অতুলনীয় কির্তি। এর পর ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় হাবিবুর রহমানের “কোরআন শরীফ: সরল বঙ্গানুবাদ”। মূল আরবী ভাষায় রচিত ‘কুরআন’ এবং বিভিন্ন সময় প্রকাশিত এর ইংরেজী ও বাংলা অনুবাদসমূহ গভীর ও তুলনামূলক পাঠ করে হাবিবুর রহমান এই মহৎ কাজটি সম্পন্ন করেছেন।
হাবিবুর রহমান এত সহজ সরল এবং যুগোপযোগী ভঙ্গিমা এবং ভাষায় কোরআনের যে অনুবাদটি সম্পন্ন করেছেন সেটি পাঠককে আনন্দ দেয় এবং পবিত্র গ্রন্থের মর্মবানী উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।
উপসংহারে বলা যেতে পারে যে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের মানসভূবনে তিনটি ধারার সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়:(ক) দেশজ বাঙালিত্বের ধারা; (খ) আধুনিক ইউরোপীয় উদারনৈতিক, যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী ধারা এবং (গ) ইসলামী ধারা। যদি বলি আমার এই বরেণ্য সুহৃদ হাবিবুর রহমান শেলির ইন্টালেকচুয়াল বা মনোজাগতিক সত্ত্বায় এই ত্রি ধারার সমন্বয় সার্থকভাবে ঘটেছিল তাহলে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। তার আত্মার শান্তি কামনা করি।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।