জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। বছরের এ সময়টায় সারাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সেদিনও হচ্ছিল। বৃদ্ধাশ্রমের ঘরে বৃদ্ধ হাবিবুর রহমান সাহেব সারাদিন বৃষ্টি থামবার অপেক্ষায় থাকলেও বৃষ্টি থামল না। বরং বিকেলের দিকে বৃষ্টির বেগ বাড়বার সাথে সাথে ঝড় ও শুরু হল।
তিনি ঘড়ির দিকে তাকালেন। বিকেল ৪টা ২১। ৬টার সময় পোষ্ট অফিস ঘর বন্ধ হয়ে যায়। নিবারণ পিয়ন চিঠি আনলে এতক্ষণে নিশ্চয় চলে আসত। আজ বৃহস্পতিবার, হাবিবুর রহমান সাহেব প্রতি বৃহস্পতিবার তার স্ত্রীর চিঠি পেলেও গত বৃহস্পতিবার পাননি।
তাই আজকের চিঠির জন্য তিনি আকুল হয়ে বসে ছিলেন, বসে ছিলেন বৃষ্টি থামবার জন্য ও। আজ চিঠি না পেলে এই চিঠির জন্য শনিবার পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে তাকে। স্ত্রীর একটা চিঠির জন্য এমনিতেই যে সাতদিন অপেক্ষা করতে হয় সে অপেক্ষা করতে নারাজ তিনি, তার উপর গত সপ্তাহে একবার চিঠি পাননি, এর পরও বাড়তি সাতদিনের সাথে আরও দুইদিন অপেক্ষা করতে একেবারেই সহ্য হবেনা তার। অবশেষে ঝড় বৃষ্টির মধ্যেই একটা লাঠি আর ছাতা হাতে বের হলেন হাবিবুর রহমান সাহেব। বৃদ্ধাশ্রম থেকে বের হয়ে রাস্তার এদিক ওদিক ভাল করে একবার তাকালেন তিনি।
না, ভ্যান, রিক্সা, অটো কিছুই নেই। তারপরও নিরাস হলেন না তিনি। বৃদ্ধাশ্রম থেকে মাত্র দুই কিঃমিঃ দূরে পোষ্ট অফিস। তিনি হাটতে শুরু করলেন। একটা সময় ছিল যখন হাবিবুর রহমান সাহেব মাইলের পর মাইল ও হেটে গেছেন।
কিন্তু এখন একটু দূর গিয়েই হাফসে পড়েন তিনি। দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রায় সবসময়ই কোন না কোন ভাবে জানান দিচ্ছে তার সময় শেষ। তবু আজ কোনকিছুই তাকে পোষ্ট অফিস যাওয়া থেকে আটকাতে পারবে না, তা ঘূর্ণিঝড় আইলা, ভূমিকম্প সুনামি যা ই হোক না কেন। তিনি শুধু জানেন আজ মারা গেলেও তাকে পোষ্ট অফিসের বারান্দায় গিয়ে তার স্ত্রীর চিঠি পড়েই মারা যেতে হবে। স্ত্রী মাহাবুবা বেগমকে অসম্ভব ভালবাসেন তিনি।
কিন্তু তিন ছেলেকে মানুষ করতে গিয়ে ভালবাসার প্রকাশটাই করা হয়নি কখনও। কি করেননি তাদের জন্য, পরিবারকে টিকিয়ে রাখার জন্য। গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করে যা কামিয়েছেন সবই বিনা সংকোচে ঢেলে দিয়েছেন। স্ত্রীর গয়না, নিজের ভিটে মাটি সব, সব বিক্রি করে কাওকে মেজিস্টেড বানিয়েছেন, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শেষে ছোট ছেলেটাকে পি এইস ডি করিয়েছেন জার্মানি থেকে। শুধু একটায় আশা ছিল ছেলেরা একদিন বড় হবে, অনেক টাকা হবে, আবার গুছিয়ে নেবেন সবকিছু।
বড় দুই ছেলে চাকরি পেয়ে, বিয়ে করে গৃহত্যাগী হয়েছে, ছোট ছেলে পি এইস ডি শেষে দেশে ফিরেছে, সে ও বড় দুই ভাইয়ের মত চাকরি বিয়ে সব করেছে, কিন্তু তারা নিজেদের মত সব গুছিয়ে নিলেও হাবিবুর রহমানের আর নিজেকে গোছান হয়ে উঠেনি। ছেলেদের বড় ফ্লাট, প্লটে স্থান হয়নি তার কিংবা তার স্ত্রীর।
পোষ্ট অফিসে গিয়ে নিবারণকে খুঁজতে থাকেন হাবিবুর রহমান। পোষ্ট অফিসের ঘর বন্ধ দেখে তিনি ক্লান্ত ভঙ্গীতে যখনই বারান্দায় বসেন ঠিক তখনই পেছন থেকে নিবারণ
পিয়ন তাকে উদ্দেশ্য করে বলে
: কাকাজি কেমন আছেন মুরব্বি?
নিবারণকে দেখে হাবিবুর রহমানের মলিন মুখটা চকচক করে উঠে। যেন প্রাণ ফিরে পান তিনি।
নিবারণের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন
: দেখ তো বাবা আমার কোন চিঠি এসেছে নাকি।
: না কাকা এ সপ্তাহে ও আপনার নামে কোন চিঠি নেই।
: এমনটা তো হবার কথা নয়, একটু ভাল করে দেখ না বাবা।
: না কাকা আসে নি, ভাল করেই দেখেছি। এর আগে ও তো আপনাকে চিঠি দিয়েছি, আসলে দেব না কেন বলেন।
এটাই তো আমাদের কাজ।
: কিন্তু একটা সপ্তাহ পার হয়ে দুই সপ্তাহ হয়ে গেল তবু চিঠি এলো না, এমন তো হবার কথা নয়। বাবা তুমি না হয় আর একটাবার কষ্ট করে দেখ।
: আসুন আমার সঙ্গে।
পিওন নিবারণ হাবিবুর রহমানকে ভেতরে নিয়ে গেল।
: এখানেই সব চিঠি থাকে, আপনি নিজেই খুঁজে দেখুন।
হাবিবুর রহমান সব চিঠি যত্ন করে খুঁজতে লাগলেন। একবার, দুইবার , এভাবে বহুবার। কিন্তু কোন চিঠি ই পেলেন না তিনি।
: কাকা, চিঠি পেলেন?
বৃদ্ধ হাবিবুর রহমান অসহায় ভঙ্গিতে বললেন-
: না বাবা।
: আপনাকে চিঠি লেখে কে কাকা? কাকী ই তো, তাইনা?
: হ্যাঁ, তোমার কাকী।
: কাকী তো মেহেরপুর থাকে, না কাকা?
: হ্যাঁ।
: আপনার ছেলে-মেয়ে কেও নেই?
ছেলের কথা বলতেই বৃদ্ধ হাবিবুর রহমানের বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে, তিনি অন্যমনস্ক হয়ে উঠেন। পিওন নিবারণ আবারও জিঞ্জেস করে
: আপনার ছেলেমেয়ে নেই কাকা?
হাবিবুর রহমান বুকে জমে থাকা ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলেন
: না বাবা, আমার কোন ছেলেমেয়ে নেই।
হাবিবুর রহমান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
অনেক দূর হেটে এসে ক্লান্ত তিনি, তবু তিনি আর অপেক্ষা করতে চাননা একটু। সন্তান বিষয়ে যে কোন প্রশ্নই এড়িয়ে যান তিনি। ছেলেরা তাকে দেখলো না, কখনও খোঁজ নিল না, তবুও তিনি চাননা তারা কষ্টে থাকুক, তাদের অপমান হোক। বরং বেঁচে থাকুক, চিরজীবন বেঁচে থাকুক।
নিবারণ পিয়ন পেছন থেকে হাবিবুর রহমান কে ডাক দিল।
: কাকা দাঁড়ান।
: বল।
: কাকী মেহেরপুর কোথায় থাকে?
: গাংনিতে।
: আমঝুপি থেকে কতদূর?
: এই ধর ২কিঃমিঃ মত?
: কাকী থাকে কার কাছে?
: ওর ভাই এর বাড়িতে।
: ও আচ্ছা, আমি তো আগামীকাল একটা কাজে আমজুপি যাব, কাকা আপনি উনার ঠিকানাটা দিন তো, আমি না হয় উনার খোঁজ নিয়ে আসব।
এ কথা শোনার পর হাবিবুর রহমানের চোখ চকচক করে উঠে। তিনি উৎসাহের সঙ্গে তার স্ত্রীর ঠিকানাটা লিখে দেন।
: তুমি যাবে কবে বললে?
: কালকে সকালেই যাব।
হাবিবুর রহমান সাহেবের কাছে ১৩২ টাকা ছিল, তিনি সব টাকায় নিবারণ পিয়নের হাতে দিয়ে বললেন-
: বাবা, তুমি এই টাকাটা রাখ, আর যাবার সময় একটু মনে করে কাচাগোলা কিনে নিয়ে যেও, তোমার কাকী খুব পছন্দ করে।
: আচ্ছা।
: আর একটু কষ্ট কর বাবা, আমাকে একটু কাগজ কলম দেবে? তুমি যখন যাচ্ছ ই তোমার কাছে একটা চিঠি লিখে দেই। হাতে হাতে দিনের দিন ই পেয়ে যাবে তাহলে।
পিয়ন নিবারণ হাবিবুর রহমানকে কাগজ কলম এনে দেওয়া মাত্রই তিনি চিঠি লিখতে শুরু করেন। চিঠি লিখতে গিয়ে তার চোখ দুটো ধরে আসে। এক শ্রেণীর মানুষ আছে, যারা জগত সংসার নিয়ে এতটাই মেতে থাকেন, ভালবাসার মানুষকে “ভালবাসি” সেটা বলা ই হয়ে ওঠে না।
হাবিবুর রহমান ও তাদের দলে। জীবনের ৬৫ বছর পার করে এসে আজ হাবিবুর রহমানের খুব বলতে ইচ্ছা হচ্ছে “ ওগো আমি তোমাকে ভালবাসি, জীবনে কখনও তোমাকে সুখ দিতে পারিনি, তুমি আমায় ক্ষমা করো” কিন্তু তিনি সেসব কিছুই লিখলেন না। তাড়াহুড়া করে কিছু লিখে নিবারণ পিয়নের হাতে সেটা ধরিয়ে দিলেন মাত্র, আর বারবার সাবধানে চিঠিটা রাখতে বলে, চিঠির উত্তর নিয়ে আসতে বললেন।
পরদিন দুপুরের খাওয়া শেষে বৃদ্ধ হাবিবুর রহমান পোষ্ট অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। একটি করে বাস পোষ্ট অফিসের সামনের স্ট্যান্ডে দাঁড়াচ্ছে, অমনি তিনি উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে গিয়ে বাসের সামনে দাঁড়াচ্ছেন, আর বাসের মধ্যে উকি দিচ্ছেন।
দুপুর পেরিয়ে বিকেল, বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হল তবু নিবারণ এলো না। ঠিক যখন হাবিবুর রহমানের মনে শঙ্কা হল নিবারণ হয়ত আজ আর ফিরবে না, তখনই নিবারণ পিয়নকে তিনি বাস থেকে নামতে দেখে তার কাছে ছুটে গেলেন।
: তুমি এসেছ নিবারণ? চিঠি এনেছ বাবা? দাও বাবা চিঠিটা।
নিবারণ কোন কথা বলে না, পকেট থেকে শুধু একটা কাগজ বের করে দেয়। বৃদ্ধ হাবিবুর রহমান সেটা পেয়ে দূত চিঠির ভাঁজ খুলেন।
: এটা তো আমার লেখা চিঠি, তোমার কাকিরটা কই? নাকি তুমি যাওনি গাংনিতে।
: হ্যাঁ গিয়েছিলাম।
: তাহলে তোমার চাচির চিঠি কই?
নিবারণ কোন কথা বলেনা, চুপ করে থাকে।
: নিবারণ বাবা, তোমার কাকী তোমাকে কোন চিঠি দেয়নি?
নিবারণ হঠাৎ ঢুকরে কেঁদে উঠে, তারপর বৃদ্ধ হাবিবুর রহমানকে জড়িয়ে ধরে বলে-
: কাকা, কাকী আর কোনদিন আপনাকে চিঠি লিখবেনা।
এ কথা শোনার পর হাবিবুর রহমান সাহেব অবাক হয়ে নিবারণের দিকে তাকায়, কিন্তু তিনি কিছু বলেন না।
ঠিক যেভাবে চুপ করে এসেছিলেন, তেমনি চুপচাপ ক্লান্ত বেসে, নিবারণের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, বুকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে আবার ফিরে যান বৃদ্ধাশ্রমের ঘরে।
এরপরও হাবিবুর রহমান ১০ বছর বেঁচে ছিলেন, তাকে আর কখনও পোষ্ট অফিসের বারান্দায় দেখা যায়নি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।