আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"রাষ্ট্র ও সুশাসন : ৪০ বছর আগে, ৪০ বছর পরে" মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

"রাষ্ট্র ও সুশাসন : ৪০ বছর আগে, ৪০ বছর পরে" মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি। আমার কাছে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো, বাংলাভাষী অঞ্চলে বাঙালি মুসলমানদের উত্থান। সেই শতাব্দীর শেষার্ধে আরেক বড় ঘটনা হলো, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। সেই রাষ্ট্রের দন্তগমের সময় ইতিহাসবিদ-ভবিষ্যদ্বক্তা হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে নিতল ঝুড়ি হিসেবে অভিহিত করেন। বাংলাদেশের দুই অর্থনীতি-প্রবক্তা সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের কথা বলেন।

তাঁরা ভেবেছিলেন ব্যাঙের ঠ্যাং, পুঁটি ও ইলিশ মাছ এবং পাট রপ্তানি করে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। তাঁদের হিসাবের মধ্য ছিল না ওপেকের কালো ধোঁয়ার কথা। পেট্রোলিয়াম-জাতীয় জ্বালানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে আমাদের সব হিসাব তছনছ হয়ে গেল। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হত্যাকাণ্ড বৃদ্ধি পেল। জাতির জনকসহ শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের হত্যাকাণ্ড এবং সামরিক বাহিনীর ক্যু-অভ্যাস দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল।

আমি সেই অনস্বীকার্য অবস্থা সংক্ষেপে বর্ণনা করি আমার লেখা ‘আগামীকালের বাংলাদেশ’-এ: ‘দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে যে দেশ পরপর পাঁচবার শীর্ষস্থান অধিকার করেছে, যে দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর প্রচণ্ডতম শিক্ষাঙ্গন, যে দেশের প্রধান বন্দর চট্টগ্রাম দ্বিতীয় বৃহত্তম বিপজ্জনক সামুদ্রিক বন্দর, যে দেশের একটি ছাড়া প্রতিটি জেলায় একসঙ্গে বোমা বিস্ফোরণ হয়, যে দেশে কর্মরত বিচারক সন্ত্রাসীর হাতে নিহত হন, যে দেশে দুজন রাষ্ট্রপতি অঘোরে প্রাণ হারান, যে দেশে জেলখানার দুর্ভেদ্য আশ্রয়ে রাজনীতিকেরা নিহত হন, যে দেশে উল্লেখযোগ্য নরহত্যার বিচার হয় না আর তারই পাশের দেশে মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীর হত্যাকারীদের আইন অনুযায়ী বিচার হয়, তখন সেই দেশকে ব্যর্থ না বলে কেউ অনুকম্পাবশত ভঙ্গুর বললে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে!’ আমি আরও বলেছিলাম, ‘আশ্চর্য হওয়ার আছে বলেই দুনিয়ার অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। কেমন করে এমন দরিদ্র, দুর্গত এবং দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে গড়পড়তা শতকরা পাঁচ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে, বৈদেশিক ঋণ সময়মতো পরিশোধ করে এবং মাঝারি উন্নয়নের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে? কারণ, আমাদের কৃষক আর আমাদের শ্রমিক। কৃষক অতি দ্রুত শিখে ফেলেছে উচ্চফলনশীল শস্যের বীজ ও সেচের ব্যবহার। তার হরতালের সময় নেই। সে ঠিক সময় বীজ বপন করে, বীজতলা থেকে ধান তুলে চারা লাগায়, ঠিক সময়ে ফসল তোলে এবং ঠিক সময়ে ফসল মাড়াই করে।

শ্রমিকেরা এখন হরতালে অভ্যস্ত। তালেগোলে হরতালে দিন কাটিয়ে বিনিদ্র রজনী জেগে কাজ করে রপ্তানির মাল সময়মতো ঠিকই তৈরি করে। ২০০২ সালের ২১ এপ্রিল এক খবরে বলা হয়, ‘গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ দুই লাখ ১৮ হাজার ৭৩৫ (৩৭ বিলিয়ন ৭১৩ মিলিয়ন ডলার) কোটি টাকা সাহায্য পায়। সর্বোচ্চ ঋণদাতা ছিল বিশ্বব্যাংক ও অনুদানদাতা ছিল জাপান। ওই দিন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বলেন, ‘দাতাদের অর্থে দেশ চলে না, দেশ তার নিজস্ব সম্পদেই চলে।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মাত্র ১০ শতাংশ অর্থের জোগান দেয় দাতাগোষ্ঠীগুলো। ’ ২০০০ সালের ৩ ডিসেম্বর বিআইডিএসের সুবর্ণজয়ন্তীতে অর্থনীতিবিদেরা বলেন, ‘বিদেশি সাহায্য অনেক কমেছে, মানসিক নির্ভরতা রয়েই গেছে। ’ প্রবাসীর প্রেরিত অর্থ ও তৈরি পোশাক রপ্তানিলব্ধ অর্থ গুরুত্বপূর্ণ হলেও এখনো এ দেশের অর্থনীতির ভিত্তি কৃষি। কৃষিজমির ৬৫ শতাংশ উর্বরতা হারালেও তিন ফসলি জমির পরিসর গত ১২ বছরে বেড়েছে ৩০ শতাংশ। এখন স্বল্পমেয়াদি জাতের শস্যের উৎপাদন কৃষিক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে।

ইউনেসকোর এক প্রস্তাবে বলা হয়, ‘প্রতিটি প্রজন্ম জলবায়ু ও মৃত্তিকা পৃথিবীতে যে বিশুদ্ধ ও অদুষ্ট অবস্থায় পেয়েছিল সে অবস্থায় রেখে যাবে। ’ আমরা ৪০ বছরের আগে যে বাংলাদেশকে পেয়েছিলাম তার অনেক ক্ষতিসাধন করেছি এবং তার জন্য আমাদের নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আমরা নদী ও নদীপথের যে ক্ষতি করেছি, সেদিকেই সবিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার একান্ত প্রয়োজন। কম্পিউটার, উপগ্রহের সাহায্যে মানচিত্র অঙ্কন এবং দূর-অবধান জাতীয় প্রযুুক্তির বদৌলতে পরিবেশবিষয়ক বিতর্ক-বিরোধ সমাধানের সম্ভাবনা আজ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে।

কৃষক, কৃষিশিক্ষা ও কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত প্রয়াস নিতে হবে। সৎ উদ্দেশ্যে ভূমি সংস্কার কেন অর্জিত হলো না এবং কী উপায়ে তা অর্জন করা সম্ভব, তা বিবেচনা করতে হবে। কৃষির ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাশাবাদীদের কথা, আমাদের চাষযোগ্য জমি বাড়ছে না, ক্রমাগতভাবে কমছে এবং তার ওপর চাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশাবাদীরা অবশ্য মনে করেন, কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগে একরপ্রতি উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। বীজ, সার ও সেচ—কৃষির প্রতিটি ক্ষেত্রে সুব্যবস্থার ফলে আরও উন্নতি সাধন সম্ভব, যখন কৃষি শুধু কৃষিই থাকবে না, কৃষিশিল্পরূপে বিকাশ লাভ করবে।

বিশ্বের বহু দেশ যেখানে এক ফসলি, সেখানে আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়ায় বছরে ১০০ ধরনের ফসল ফলানো যায়। আমাদের উদেযাগী কৃষিকর্মীরা বিশ্বায়নের চাহিদার সুযোগ নিয়ে নানা ধরনের ফল-ফুল উৎপাদন করছে। দি ইকোনমিস্ট পত্রিকার ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ ২০১০ সালের গণতন্ত্রের সূচক বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। নির্বাচন-প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, জনগণের স্বাধীনতা, সরকারের কর্মপদ্ধতি, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি—এই পাঁচটি বিষয়ে বিবেচনা করে বলা হয়, পূর্ণ গণতন্ত্র রয়েছে মাত্র ২৬টি দেশে। নরওয়ের স্থান সবার শীর্ষে।

সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে গণতন্ত্রচর্চায় কিছুটা অবনতি ঘটেছে। ত্রুটিযুক্ত গণতন্ত্রের সংখ্যা ৫৩টি, এর মধ্যে ভারত একটি। বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় শ্রেণীতে, সংকর শাসনব্যবস্থার দেশগুলোর মধ্যে। কিছুটা স্বস্তির কথা, যেখানে বহু উন্নয়নশীল দেশ গণতন্ত্রের সূচকে পিছিয়ে পড়ছে, সেখানে বাংলাদেশ আট ধাপ এগিয়ে বর্তমান ৮৩তম স্থানে আছে। গণতন্ত্রের সূচকে প্রথম শ্রেণীতে উঠতে আমাদের আরও দুই শ্রেণী পার হতে হবে।

নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, জনগণের স্বাধীনতা, সরকারের কর্মপদ্ধতি, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি—এই পাঁচটি ক্ষেত্রের প্রতিটিতে আমাদের অনেক ঘাটতি রয়েছে। সেই ঘাটতি দূর করে নাগরিক সম্পদ বৃদ্ধি করতে হবে। ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) থেকে প্রকাশিত ‘ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা ২০১০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে ১০টি সূচককে বিবেচনা করা হয়েছে। যেমন, ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করার সময় ও প্রক্রিয়া, নির্মাণকাজ শুরু করা, শ্রমিক নিয়োগ, সম্পত্তি নিবন্ধন, ঋণের প্রাপ্যতা, বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা, কর প্রদান, আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া, চুক্তির বাস্তবায়ন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করার সময় ও প্রক্রিয়া। বিশ্বায়নের জন্য আমাদের এই স্বল্পোন্নত দেশের যে কয়েকটি সুবিধা রয়েছে তা কাজে লাগাতে কেবল সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভর না করে দক্ষ শ্রমের জন্য কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে।

গত ৪০ বছরে যে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, তা আরও বৃদ্ধি লাভ করতে পারে। ইতিমধ্যে আমরা নতুন নতুন ফলমূল উৎপাদন করছি, বহির্বাণিজ্যে তা আর অপ্রচলিত রপ্তানিপণ্য নয়। ফলের চাষ আর সামান্য ব্যাপার নয়, সে আজ কোটি টাকার ব্যাপার। বিশ্বায়নের জন্য আমাদের রপ্তানি-বাণিজ্য বাড়বে। পরিবর্তে আমরা হয়তো বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি এবং প্রযুক্তিগত দুর্নীতির সম্মুখীন হতে পারি।

আমাদের অর্থনীতি বারবার পর্যুদস্ত হয়েছে জ্বালানি তেলের সরবরাহ নিয়ে, বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে। সর্বশেষ প্রচেষ্টায় কুইক রেন্টালের বিদ্যুৎ যা পাওয়া গেছে তার চেয়ে দুর্নীতির আখড়ায় নন্দীভৃঙ্গীদের নৃত্য বৃদ্ধি পেয়েছে। গত দুই বছরে জ্বালানি চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণ এবং খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে চার গুণ। আমাদের বৈজ্ঞানিকেরা ধানের তুষ ও পাথরকুচি থেকে যে বিদ্যুৎ তৈরি করেছেন, তা ছাত্রদের বার্ষিক বিজ্ঞান মেলার মতো। তবে বিশ্বায়নের আবিষ্কারে ধানের তুষকে অবজ্ঞা করা যাবে না।

সৌরবিদ্যুৎ আহরণে নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে যদি কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়। বর্তমানে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আইন-আদালতে সার্বিকভাবে অস্বাভাবিকতা বেড়েছে। দেশের সরকার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক আচরণ ফিরে এলে, অবকাঠামো উন্নত হলে, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার জন্য প্রণোদনা ফিরে এলে দেশ সম্পর্কে আজ যে উজ্জ্বল ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে, তা হয়তো সত্য হবে। পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ এখন ভবিষ্যদ্বাণী করছেন যে বাংলাদেশ আগামী ৪০ বছর পরে উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে। আর বর্তমান সময়ের অস্বাভাবিক অবস্থায় উত্তরোত্তর অবনতি ঘটলে, সমাজের বৈষম্য বৃদ্ধি পেলে ও সামাজিক ভারসাম্য বিনষ্ট হলে দেশে মধ্যাহ্নে অমানিশা নেমে আসবে।

দেশের মাত্র ৮৫ জনের কাছে এক হাজার ৩০০ কোটি ডলার রয়েছে, তা ফক্কা হয়ে যেতে পারে। মতিচ্ছন্ন নৈরাজ্যের আশঙ্কা-দুর্ভাবনায় কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করতে কেউ কি উৎসাহিত হবে? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.