গনজাগরনের মাধ্যেমে পরিবর্তন সম্ভব....মানুষের চিন্তার পরিবর্তন করাটা জরুরি ....বুদ্ধিবৃত্তিক পুনরজাগরনে বিশ্বাসী আমি কখনোই মনে করি না, আমার হাতে রয়েছে কোনো অদৃশ্য হাতকড়া। এটা অনুভব করলে আমি লিখতে পারতাম না। কিন্তু বহু আগে জ্ঞানী লোকেরা বলে গেছেন, রুশোর কথাই না সত্য, ‘মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মায়, কিন্তু সবখানে সে শিকলে বাঁধা। ’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা বিখ্যাত কবিতা আছে, বাংলাদেশে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় এবং অন্য আবৃত্তিকারেরা বারবার আবৃত্তি করে সেটাকে আমাদের কাছে অতিপরিচিত করে তুলেছেন—কবির মৃত্যু। কবির হাত শিকলে বাঁধা হয়েছে, তাঁকে বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে গুলি করা হচ্ছে, গুলি লেগে তাঁর হাতের বাঁধন খুলে গেল, কবি বললেন, বলেছিলুম কি না আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না!
কবির হাত শিকলে বাঁধা থাকে না, কারও হাতই শিকলে বাঁধা থাকে না, যখন বুলেট এসে তাঁর শরীর ঝাঁঝরা করে দেয়, যখন তাঁর আত্মা বেরিয়ে চলে যায় মুক্ত আকাশে।
ঢাকার একটা ওয়ার্ডের বিএনপির নেতা রফিকুল ইসলাম মজুমদারের হাতের ‘পুলিশ’ লেখা হাতকড়ার ছবি ছাপা হয়েছে প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায়। তিনি ঝিনাইদহের শৈলকুপায় গিয়েছিলেন। কেউ বলেন বেড়াতে, কেউ বলেন পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে। কিন্তু বাঁচলেন না তিনি। তাঁকে ধরে নিয়ে যায়—প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিবরণ অনুসারে—কালো পোশাক পরিহিত ও অস্ত্রধারী একদল লোক।
তারা নিজেদের র্যা ব বলে পরিচয় দেয়। তারপর রফিকুলের লাশ পড়ে থাকে কুমারখালীর পেঁয়াজের খেতে।
র্যা ব বলছে, তারা এ ধরনের কোনো অভিযান পরিচালনা করেনি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলছেন, ‘বাজারে পুলিশ লেখা হাতকড়া কিনতে পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, সন্ত্রাসীরা এ সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে।
’ আর মৃতের স্বজনেরা বলছে, এটা সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো বাহিনীর লোকেরই কাজ।
এখানে আমাদের সুনীলের কবিতার লাইন থেকে উদ্ধৃতি দিতে হচ্ছে, ‘বলেছিলুম কি না। ’ ক্রসফায়ার যে ভালো জিনিস নয়, এটা যে অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড সবচেয়ে জঘন্য কাজ, এই রোদন আরও অনেক মানুষের মতো এই লেখক বহুবার করেছেন, সবই অরণ্যে রোদন হয়েছে। মহাবীর আলেকজান্ডার এক দার্শনিকের রোদ আটকে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি? উত্তর এসেছিল, আপনি সরে দাঁড়ান, রোদ আসতে দিন, যা আপনি দিতে পারেন না, তা কেড়ে নিতে পারেন না।
সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছি, যে প্রাণ আমরা কাউকে ফিরিয়ে দিতে পারি না, তা আমরা কেড়েও নিতে পারি না, বিনা বিচারে আইনভঙ্গ করে তো নয়ই।
দ্রুত বিচার করার বিশেষ ব্যবস্থা নিন, কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের জন্য আলাদা করে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা আইনানুগভাবে করুন, দয়া করে ‘ক্রসফায়ার’, ‘এনকাউন্টার’, ‘গুম’ করবেন না। আরও বলেছি, আর এটা করা হতে থাকলে ভুল হবে। ভুল করে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করার পর টের পাওয়া যাবে, এ তো ভুল মানুষ, ভুল মানুষ। সেই রকম হয়েছে, মোহাম্মদপুরের এক কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে খেয়ে ফেরার সময় এক নির্বিবাদী তরুণকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং সে লাশ হয়ে গেছে। লিমনের ক্ষেত্রেও ভুল হয়েছে এবং তার পা চিরদিনের জন্য চলে গেছে।
আরও বলেছি, বাংলাদেশের মতো দুর্নীতি-চ্যাম্পিয়ন দেশে শত্রুতাবশত একে অন্যকে ‘ক্রসফায়ারে’ নেওয়ার চেষ্টা করবে। সবশেষে বলেছি, সন্ত্রাসীরা এই সুযোগ নেবে, তারা মানুষ খুন করে রটিয়ে দেবে যে ক্রসফায়ারে ও মারা গেছে। তখন সে দায়িত্ব কে নেবে?
এখন রফিকুল ইসলাম মজুমদারের মৃত্যুর দায়িত্ব কে নেবে? আমি র্যা ব ও পুলিশের তথ্য বিশ্বাস করছি। র্যা ব ও পুলিশ এ কাজ করেনি। তাহলে আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন এই রকম যে বাজারে ‘পুলিশ’ লেখা হাতকড়া পাওয়া যায়, কয়েকজন কালো পোশাক পরে হাতে অস্ত্র উঁচিয়ে র্যা ব পরিচয় দিয়ে মানুষের বাড়ি ঘেরাও করে এবং কাউকে ধরে নিয়ে চলে যায়।
আর আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের টিকিটিরও সন্ধান পায় না?
প্রিয় পাঠক, আপনি কি শিউরে উঠছেন না, একটা অদৃশ্য হাতকড়া আপনার হাতে অনুভব করছেন না এবং আপনার মনে হচ্ছে না, আপনিও হতে পারেন এর শিকার, পড়ে থাকতে পারেন পিঁয়াজের খেতে লাশ হয়ে? ভুল করেও তো আপনাকে ধরা হতে পারে!
তারও পরে আছে ছাত্রলীগ! বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের পরে ঘটনার সঙ্গে জড়িত গ্রেপ্তারকৃতের স্বীকারোক্তি খবরের কাগজে পড়লাম। একজন বলছেন, বিশ্বজিৎকে মারা হয়েছে। কারণ, ওখানে একটা ককটেল বিস্ফোরিত হয়েছিল, সে দৌড়াচ্ছিল, কাজেই এটা মনে করা হয়েছে যে বিশ্বজিৎই ককটেলটা ফাটিয়েছে। ওই ছাত্রলীগ বাহিনীর নেতারা বলে দিয়েছিলেন, এই এলাকায় যেন কেউ অবরোধ করতে না পারে। বুুঝুন অবস্থাটা! কে রাস্তায় ককটেল ফাটাল, তাকে কুপিয়ে হত্যা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে লাঠিসোঁটা, কিরিচ, চাপাতি, পিস্তল, বন্দুক হাতে নেমে পড়েছে ছাত্রলীগের সদস্য।
ঠিক একই ঘটনার শিকার হয়েছেন প্রথম আলোর চার ফটোসাংবাদিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, গত শনিবার। গাড়িতে আগুন লাগানোর খবর শুনে ফটোসাংবাদিকেরা ছুটছেন অকুস্থলে। তাঁদের ধরে বসল শান্তি রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া ছাত্রলীগাররা, ‘তোমরা এখানে ককটেল ফাটিয়েছো। ’ তাঁরা সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হলেন, প্রথম আলোর হাসান রাজাকে মারধর করেন। শেষে দায়িত্বশীলতার পরিচয় হিসেবে দুই সাংবাদিককে পুলিশের হাতে তুলে দেন।
এর চেয়ে বিপজ্জনক আর কিছুই হতে পারে না, যখন ছাত্রলীগাররা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে লাঠিসোঁটা, কিরিচ, চাপাতি, পিস্তল, বন্দুক হাতে রাস্তায় নেমে আসে। প্রেক্ষাপটে বাজতে থাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাণী, যুবলীগের কর্মীদের প্রতি আহ্বান, মাঠ পরিষ্কার রাখো। ভাগ্যিস, যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা সঙ্গে সঙ্গে মুখের ওপরে বলে দিয়েছিলেন, ওটা যুবলীগের কাজ নয়, ওটা পুলিশের কাজ।
প্রথম আলোরই একজন সহকর্মী লিখেছেন এবং আমাদের গল্প শুনিয়েছেন, রাতের বেলা চা খেতে বেরিয়ে তিনি স্থানীয় সরকারদলীয় কর্মীদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে গেছেন, তারা বলছিল, তুই শিবির। তাঁকে নানাভাবে প্রমাণ করতে হয়েছে, তিনি শিবির নন।
এ তো ভয়াবহ পরিস্থিতি! প্রথম কথা, কোনো লীগেরই কাজ রাস্তা পাহারা দেওয়া নয়! দ্বিতীয় কথা, শিবির হলেই কি তাকে ঘেরাও করতে হবে? মার দিতে হবে? এই মনোভাব থেকেই বিশ্বজিৎ খুন। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেশে অরাজকতা তৈরি করবে, নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে।
বস্তুত, নানা দিক থেকে সেই লক্ষণও স্পষ্ট। রাজনৈতিক বিবেচনায় করা মামলা প্রত্যাহার করতে গিয়ে প্রকৃতই যেখানে অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, সেই মামলার আসামিদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে। খুনের দায়ে ফাঁসির আদেশপ্রাপ্তকে ক্ষমা করে দেওয়া হচ্ছে।
কারাগার থেকে সব কুখ্যাত অপরাধী বেরিয়ে এসে যদি জনপদে বিচরণ করতে থাকে, তাহলে আমাদেরকে কারাগারে নিন। অপরাধীরা বাইরে থাকুক, শান্তিপ্রিয় নিরীহ মানুষেরা আশ্রয় নিক কারাগারে। তেমনি করে আজ আমরা সবাই আমাদের হাতে একটা করে হাতকড়া অনুভব করতে শুরু করেছি।
মনে হচ্ছে, আমাদের মুক্তি নেই। এই ভয়াবহ হতাশা আমাদের চেপে ধরে, যখন দেখি, বর্তমানের ভাগ্যবিধাতাদের বিকল্প যে গতকালের ভাগ্যবিধাতারা কোনো অংশে এঁদের চেয়ে কম নন, কোনো ক্ষেত্রে এঁদের চেয়েও বেশি ভয়াবহ।
তাহলে আমরা যাব কোথায়?
অথচ এটা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার যে তারা মানবাধিকার রক্ষা করবে, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করবে। এটা তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার যে তারা দলীয়করণ করবে না। কেউ কথা রাখেনি, ৪২ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না।
একটা বড় হাতকড়া আমাদের সবাইকে বেঁধে ফেলতে চাইছে।
একটা সার্বিক ভয়ের অনুভূতি আমাদের চেপে ধরতে চাইছে।
এটা ভালো কথা নয়। এটা ভালো কথা নয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
উৎসঃ প্রথম আলো ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।