প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর কর্মরত আয়াকে দিয়ে মেঝে ঝাড়া-মোছা করার নির্দেশ দিচ্ছেন ওয়ার্ডমাস্টার। রোগীর আত্মীয়দের যাঁদের পরনে ভালো পোশাক নেই, তাঁদের ওয়ার্ডের বাইরে বের করে দেওয়া হচ্ছে। বারান্দায় থাকা রোগীদের বিছানাসহ টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে অন্যত্র। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন রোগীরা, ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। কারণ, অবরোধের ঘটনায় অগ্নিদগ্ধদের দেখতে প্রধানমন্ত্রী হাসপাতালে আসছেন।
তাঁর আগে আসেন আরও চারজন মন্ত্রী। সঙ্গে ছিল সচিব ও কর্মকর্তাদের ভিড়।
গতকাল রোববার দিনভর এভাবেই মন্ত্রীসহ ভিআইপিদের চাপে বিপর্যস্ত ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট। সকাল ১০টায় গেছেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সঙ্গে ছিলেন নৌপরিবহন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী শাজাহান খান।
বেলা ১১টায় টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন পরিদর্শনে আসেন। বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী রওশন এরশাদ। পরে বেলা তিনটায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসেন।
অগ্নিদগ্ধদের অবস্থা যে ভালো নেই, তা জানালেন বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সামন্তলাল সেন। তিনি বলেন, ‘ভর্তি হওয়া ৩৭ জনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।
এঁদের একজনকেও আমরা এই মুহূর্তে আশঙ্কামুক্ত বলতে পারছি না। ’
কিন্তু দিনের শুরু থেকেই রোগীদের চিকিৎসার বদলে গোছগাছে ব্যস্ত হতে হয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। পেয়িং ওয়ার্ডের (পুরুষ) রোগীদের ব্যথা-বেদনা অগ্রাহ্য করে আয়া, সেবিকারা পুরোনো ব্যান্ডেজের ওপর জড়িয়ে দেন নতুন ব্যান্ডেজ। ময়লা বিছানার চাদর না বদলিয়েই ঢেকে দেওয়া হয় নতুন সাদা চাদরে।
পেয়িং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আবদুর রাজ্জাক (৪০)।
গত বৃহস্পতিবার শাহবাগে পেট্রলবোমায় অগ্নিদগ্ধ হন তিনি। পুড়ে গেছে শরীরের ৪ শতাংশ। তিনি প্রথম আলোকে জানান, সকালে নাশতার পর ওষুধ খাওয়ানোর জন্য নার্স বা কর্তব্যরত চিকিৎসক আসেননি। সবাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে ধ্যান দিয়েছেন। ওবায়দুল কাদের আসার আগ পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ‘ঝাড়ু দাও, পরিষ্কার চাদরে বিছানা ঢাকো’—এসব নির্দেশ দিয়ে গেছে।
রাজ্জাকের আত্মীয়রাই মুখে-কপালের পোড়া অংশে মলম লাগিয়ে দিয়েছেন। বেলা ১১টার দিকে ক্ষতস্থান পরিচ্ছন্ন (ড্রেসিং) করার কথা থাকলেও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর পরিদর্শনের কারণে তা হয়নি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী রওশন এরশাদের পরিদর্শন শেষে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল ট্রাকচালক মেহেদী হাসানকে। মন্ত্রী থাকা অবস্থাতেই তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটে। গত শনিবার রাত সাড়ে আটটায় কৃষ্ণপুর থেকে ফরিদপুর আসার পথে গৌরীপুর বাজারের কাছে ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলায় অগ্নিদগ্ধ হন তিনি।
সন্ধ্যা ছয়টার দিকে মুঠোফোনে মেহেদীর চাচা তৌহিদুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেহেদী মারা যাচ্ছে। সেই সাড়ে ১১টায় তাঁকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু এখনো নেয়নি। এমনকি মেহেদীর ওষুধ-ড্রেসিং করার লোক নেই কোথাও, আমি নিজ হাতেই করছি এসব। ’
বেলা তিনটায় বার্ন ইউনিটে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটা ৩৫ মিনিটেই শুরু হয় তোড়জোড়।
নাম না প্রকাশের শর্তে এক চিকিৎসক জানান, মন্ত্রীদের সম্মান দেখিয়ে উপস্থিত থাকতে হলে রোগীরা নিয়মিত পরিচর্যা থেকে বঞ্ছিত হচ্ছেন। কিন্তু না গেলেও হয় না। একটায় হাসপাতালের তিনতলা ও চারতলায় খাবারের ট্রলি নিয়ে প্রবেশ করেন খাদ্য সরবরাহকারীরা। রোগীদের আত্মীয়দের সবাই যখন লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার সংগ্রহে ব্যস্ত, ঠিক তখনই (১.৩৫) পুরো হাসপাতালে শোরগোল ‘পিএম আসছেন’। মাত্র ২০ মিনিটেই খাওয়ার ট্রলিগুলো নিচে চলে যায়।
যাঁরা পেরেছেন খাবার নিয়েছেন, যাঁরা পারেননি, তাঁদের পরে দেওয়া হবে বলে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি সামাল দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি বারান্দায় থাকা রোগীদের আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে দ্রুত তাঁদের বিছানা অন্য বারান্দায় সরিয়ে দেওয়া হয়। আহত রোগীদের কাতর শব্দেও টলেনি কেউ। ওই রোগীরা খাওয়া তো পরের কথা, ওষুধ খেয়েছেন কি না, তা জানার জন্যও কেউ ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে সবাই ব্যস্ত ছিলেন।
হাসপাতালের পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বেশ বিরক্ত হয়েই বললেন, পুড়ে যাওয়া রোগীদের সংক্রমণের আশঙ্কা বেশি রয়েছে। এমনিতেই এদের অবস্থা ভালো না। রাজনৈতিক ঘটনার শিকার হওয়ায় যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত দর্শনার্থীদের চাপ। পাশাপাশি দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।