ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আর মাত্র ৩৪ দিন পরই সংসদ নির্বাচন। অথচ প্রধান দুই রাজনৈতিক শিবির এখনো বিপরীত অবস্থানে। প্রধান বিরোধী জোট ছাড়াই একতরফা নির্বাচনের পথে এগোচ্ছে সরকার। এ অবস্থায় দেশজুড়ে সংঘাত যখন ছড়িয়ে পড়ছে, তখন বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নানামুখী প্রয়াস জোরদার করছে।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরোধী জোটের মধ্যে সমঝোতার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এক বছরের বেশি সময় ধরে দুই পক্ষকে উৎসাহ জুগিয়ে আসছে।
গত কয়েক দিনের হরতাল-অবরোধে ধ্বংসযজ্ঞ, সহিংসতা আর অসহায় লোকজনের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংকট সমাধানের জোর তাগিদ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন গত ২৫ নভেম্বর দুই নেত্রীকে চিঠি লিখেছেন। ‘সত্যিকার অর্থেই অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন আয়োজনের পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে তাঁর বিশেষ দূত ও জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে তিনি ৫ ডিসেম্বর ঢাকায় পাঠাচ্ছেন।
এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার নাবি পিল্লাই গতকাল বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক হানাহানিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গতকাল জেনেভায় এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘দুই পক্ষের রাজনীতি-বিদদের যে ধরনের মতপার্থক্যই থাকুক না কেন, ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।
কারণ, এ ধরনের অপতৎপরতা বাংলাদেশকে বিপজ্জনকভাবে বিরাট সংকটের দিকে নিয়ে যাবে। রাজনীতিবিদদের নিজেদের দায়িত্ব পালন করা উচিত এবং প্রভাব বিস্তার করে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানো উচিত।
গত শনিবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি ক্যাথরিন অ্যাশটনও এক বিবৃতিতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তির তাগিদ দিয়েছেন। তবে সেই সঙ্গে তিনি এও বলেন, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশে ইইউর নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়টি। অসমর্থিত একটি সূত্র জানিয়েছে, আগামী ৯ ডিসেম্বর ক্যাথরিন অ্যাশটন ঢাকায় আসার কথা রয়েছে।
সরকারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র গতকাল রোববার প্রথম আলোকে জানিয়েছে, জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিবের সঙ্গে গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টার ফোনে কথা হয়েছে। এ সময় তারানকো শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
তারানকোর ঢাকা সফরের প্রথম দিন অর্থাৎ ৫ ডিসেম্বর ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে শুনানির কথা রয়েছে। এতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
এদিকে ভারতের নতুন পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং ৪ ডিসেম্বর হঠাৎ দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন।
তাঁর এ সফরটি দ্বিপক্ষীয় হলেও চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এ সফরে পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করার পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর আলোচনার কথা রয়েছে।
পাশ্চাত্যের অভিন্ন সুর: দুই নেত্রীকে বান কি মুনের চিঠি ও ক্যাথরিন অ্যাশটনের বিবৃতিকে ঢাকার কূটনীতিক মহল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিবেচনা করছে। এ ক্ষেত্রে বান কি মুন ও অ্যাশটনের বক্তব্যের বেশ কিছু শব্দের ওপর তাঁরা গুরুত্ব দিচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে ‘অংশগ্রহণমূলক’, ‘বিশ্বাসযোগ্য’ ও ‘সহিংসতামুক্ত’ নির্বাচনের উল্লেখ করেছেন বান কি মুন।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে তাঁদের বৈঠকের উল্লেখ করে বান কি মুন বলেন, ‘আমাদের আলোচনার সময় সবার অংশগ্রহণে একটি বিশ্বাসযোগ্য ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আপনার অঙ্গীকার আমাকে উজ্জীবিত করেছে। ’
অ্যাশটনও শনিবারের বিবৃতিতে বলেন, একটি শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সহিংসতার অবসান ও আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পাওয়াটা অপরিহার্য।
প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে লেখা চিঠিতে ‘পরস্পরের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান’ খুঁজে বের করার কথা বলেন জাতিসংঘের মহাসচিব। অ্যাশটনও মনে করেন, জনমতের মতামতের প্রতিফলন ঘটানোর লক্ষ্যে নির্বাচন আয়োজনের জন্য ‘পরস্পরের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধানের উপায়’ খুঁজে বের করতে হবে।
গত ১৭ নভেম্বর দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনায় সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন আয়োজনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ক্যাথরিন অ্যাশটনের বক্তব্যের তাৎপর্য: ঢাকা ও ব্রাসেলসের কূটনীতিক সূত্রগুলো গতকাল এ প্রতিবেদককে জানিয়েছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর চলমান সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাথরিন অ্যাশটনের বিবৃতিটি তাৎপর্যপূর্ণ। এতে দুই পক্ষকেই বার্তা দেওয়া হয়েছে। হরতাল, সংঘাত ও সহিংসতার ব্যাপারে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে বিরোধী দলকে বার্তা দেওয়া হয়েছে। আবার রাজনীতিক ও মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তারে উদ্বেগ জানিয়ে বার্তা দেওয়া হয়েছে সরকারকে। ২০০৮ সালের মতো নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রস্তুতি থাকলেও তাতে শর্তযুক্ত করে বলা হয়েছে, সিদ্ধান্তটি নির্ভর করবে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা ইইউর এমন অবস্থানে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, ইইউ যদি পর্যবেক্ষক পাঠানোর ব্যাপারে শর্ত জুড়ে দেয়, তবে তাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কাজে আমন্ত্রণ জানানো হবে কি না, তা সরকার ভেবে দেখবে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আসন্ন শুনানি: ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি (ইপিপি) গ্রুপ ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করবে। ওই আলোচনার প্রতিপাদ্য হচ্ছে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পথে বাংলাদেশ: তত্ত্বাবধায়ক সরকার কতটা অপরিহার্য। এই শুনানিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেও এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ব্যস্ততার কারণে তিনি এ আলোচনায় যোগ দিচ্ছেন না বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।
সুজাতা সিংয়ের সফরের তাৎপর্য: ঢাকা ও দিল্লির কূটনীতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকের আমন্ত্রণে প্রথম ঢাকা সফরে আসছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং। তাঁকে অক্টোবরে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানানো হলেও শুরুতে সাড়া মেলেনি। এখন এমন এক সময়ে তিনি ঢাকায় আসছেন, যখন নির্বাচন নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থানকে কেন্দ্র করে সংকট ঘনীভূত হয়েছে।
এ সময় তিনি কী বার্তা নিয়ে আসছেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনীতিক মহলের কৌতূহল রয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।