আমি সত্য জানতে চাই
প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সংঘ, উদীচী সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ও রাজনীতিবিদ সত্যেন সেন। এ দেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে সত্যেন সেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি উদীচী সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি বিপ্লবী, শ্রমিক সংগঠক সত্যেন সেন ১৯৮১ সালের আজকের দিনে মৃত্যুবরণ করেন। আজ ৩২তম মৃত্যুদিনে এ বিপ্লবীকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
সত্যেন সেন ১৯০৭ সালের মার্চ ২৮ তারিখে বিক্রমপুর (বর্তমান মুন্সীগঞ্জ) জেলার টঙ্গীবাড়ী উপজেলার সোনারং গ্রামের সেন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় ডাক নাম ছিল লস্কর। তার পিতা নাম ধরনীমোহন সেন, এবং মাতার নাম মৃণালীনি সেন। চার সন্তানের মধ্যে সত্যেন ছিল সর্বকনিষ্ঠ। সোনারং গ্রামের সেন পরিবার ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার এক অনন্য উদাহরণ।
সত্যেনের কাকা ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। তার আর এক কাকা মনোমোহন সেন ছিলেন শিশুসাহিত্যিক। সত্যেন সেনের পরিবারেই তার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়। প্রাইমারী ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনাও পরিবার ও গৃহ শিক্ষকের কাছেই সম্পন্ন করেছিলেন। ১৯১৯ সালে সোনারং হাইস্কুলে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়।
১৯২১ সালে তিনি যখন সোনারং হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তখন থেকেই তার মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ লাভ করে। ১৯২৪ সালে সোনারঙ হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে কলকাতায় কলেজে ভর্তি হন। এবং সেখানকার একটি কলেজ থেকে এফএ ও বিএ পাস করেন। এর পর তিনি কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস বিভাগে এমএ শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্তু বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে ১৯৩১ সালে কারাবরণ করলে জেলে থেকেই তিনি বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন।
জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি কৃষক আন্দোলনে যোগদেন এবং আমৃত্যু বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়াও সত্যেন সেন ছিলেন একজন নির্ভীক সাংবাদিক। প্রথমে দৈনিক মিল্লাতে তাঁর সাংবাদিক জীবনের শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৪ সালে সহকারী সম্পাদক হিসেবে দৈনিক ‘সংবাদ’র মাধ্যমে সত্যেন সেন সাংবাদিকতা করেছেন। জীবনের নানা চড়াই-উৎরাইয়ের বাঁকে তিনি কোথাও আপোষ করেননি।
যারা করেছে, তাঁদেরকে তিনি ঘৃণা করতেন। শ্রমিক সংগঠক ও কথাশিল্পী সত্যেন সেন ১৯৬৯ সালে বিপ্লবী রণেশ দাশগুপ্ত, শহিদুল্লা কায়সারসহ একঝাঁক তরুণ উদীচী গঠন করেন। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী এদেশে সুস্থ সাংস্কৃতিক ধারার সংস্কৃতি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সত্যেন সেনের সৃষ্টিকর্ম ও সাহিত্য হলো সমাজ বাস্তবতার স্পষ্ট প্রকৃতি-স্বরূপের প্রতিচ্ছবি। তাঁর জীবনের সকল কিছুতেই মৌলিক বিষয় হিসেবে কাজ করেছে মানুষের জীবন-সংগ্রাম ও শ্রম-সভ্যতার ইতিহাস।
স্বাধীনতার পর তিনি উদীচী পুনর্গঠনের কাজ করেন। সাহিত্য চর্চাও অব্যহত রাখেন। গান মাধ্যমে মানুষকে জাগরিত করা সহজ। এই উপলব্দি নিয়ে গণমানুষের জন্য মানুষের জীবন বাস্তবতার গান রচনা করেছেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত ও গণসঙ্গীতের সুকন্ঠ গায়ক এবং গণসঙ্গীত রচয়িতা।
জন্মলগ্ন থেকে উদীচী অধিকার, স্বাধীনতা ও সাম্যের সমাজ নির্মাণের সংগ্রাম করে আসছে। উদীচী ’৬৮, ’৬৯, ’৭০, ’৭১, সালে বাঙালির সার্বিক মুক্তির চেতনাকে ধারণ করে গড়ে তোলে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম।
সত্যেন সেন পরিণত বয়সে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন এবং তাঁর রচিত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় চল্লিশ। তিনি মূলত কোনো লেখাই লেখার জন্য লিখতেন না। তিনি লিখতে মানূষের অধিকারের কথাগুলো।
সত্যেন সেনের সাহিত্যকর্ম সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার একটি নিদর্শন এবং বাংলা সাহিত্যের অনন্য পথিকৃৎ। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ সমূহঃ
১। মহা বিদ্রোহের কাহিনী, ২। ভোরের বিহঙ্গী, ৩। রুদ্ধদ্বার মুক্ত প্রাণ, ৪।
অভিশপ্ত নগরী, ৫। পাপের সন্তান, ৬। সেয়ান, ৭। পদচিহ্ন, ৮। পুরুষমেধ, ৯।
আলবেরুনী, ১০। সাত নম্বর ওয়ার্ড, ১১। বিদ্রোহী কৈর্বত, ১২। কুমারজীব, ১৩। অপারেজয়, ১৪।
মা, ১৫। উত্তরণ, ১৬। একুল ভাঙ্গে ওকুল গড়ে ইত্যাদি। সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতি স্বরূপ সত্যেন সেন ১৯৬৯ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৮৬ সালে সাহিত্য মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন।
১৯৭৩ সালে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে সত্যেন সেনের ।
চিকিৎসার জন্য চলে যান ভারতে। আশ্রয় নেন শান্তি নিকেতনের তার মেজদিদি প্রতিভা সেনের কাছে। সাহিত্য চর্চা ও অসুস্থতার মাঝে চলে যায় ৮টি বছর। ১৯৮১ সালে ৫ জানুয়ারি শারীরিক অবস্থার অবনতির হলে শান্তি নিকেতনের গুরুপল্লীতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আজ তার ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী।
আজীবন সংগ্রামী কৃষক সংগঠক, শিল্পী, সাংবাদিক ও লেখক সত্যেন সেনের মৃত্যুদিনে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।