জার্মানিতে বসে গবেষণা করে টেলিহেলথ, স্মার্টহোম, ড্রোনের মতো প্রযুক্তিপণ্য তৈরি করেছেন মো. সাইফুল্লাহ ও তানিয়া রহমান। এই প্রকৌশলী দম্পতি ও তাঁদের কাজ নিয়ে আজকের প্রতিবেদন
আইপিএস অতি পরিচিত শব্দ আমাদের কাছে। বিদ্যুৎ চলে গেলে ইনস্ট্যান্ট পাওয়ার সাপ্লাইয়ের কথা কার-ই বা না মনে পড়ে। কিন্তু নতুন যে আইপিএসের দেখা মিলল, তার পূর্ণ রূপ ইনডোর পজিশনিং সিস্টেম। আমরা জিপিএস অর্থাৎ গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের কথা শুনেছি, কিন্তু ইনডোর পজিশনিং? এর কথা শোনালেন প্রকৌশলী মো. সাইফুল্লাহ।
সাইফুল্লাহ আর তাঁর স্ত্রী তানিয়া রহমান জার্মানিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন সাইনপালস নামের এক কোম্পানি। এই সাইনপালস থেকেই বানানো হয়েছে আইপিএস। এটাকে কিছুটা আগামী দিনের যন্ত্র বলা যায়। কোনো ঘরে বা বড় কোনো দালানে আপনি কোথায় আছেন, তা শনাক্ত করে দেবে আইপিএস। আবার কোনো বড় দালানের কোনো একটা ঘরে আপনাকে যেতে হবে।
ব্যবহারকারী হাতে একটা বন্ধনী বা ব্রেসলেটের মতো পরা আইপিএস সেই ঘরের পথনির্দেশনা দেখিয়ে দেবে। এটি দিয়ে ডিজিটাল তালা খোলা ও বন্ধ করার মতো কাজগুলোও করা যাবে। ঘরে বা দালানের বাতাসে ইনফ্রারেড, ব্লুটুথ, ওয়াই-ফাই নানা রকম সংকেত ভেসে বেড়ায়। সেসব ব্যবহার করেই অবকাঠামো তৈরি করতে হবে আইপিএসের জন্য। তবেই এটি হয়ে উঠবে চৌকস হাত-বন্ধনী।
সাইফুল্লাহ-তানিয়া দম্পতি ইনডোর পজিশনিং সিস্টেমের পেটেন্ট করিয়েছেন জার্মানিতে। শুধু আইপিএস নয়, সাইনপালস থেকে তৈরি করা হয়েছে আরও কিছু প্রযুক্তিপণ্য।
শুরুটা যেমন : এবারে বাংলাদেশে একা এসেছেন মো. সাইফুল্লাহ। প্রথম আলো কার্যালয়ে কদিন আগে যখন কথা হলো, তখন বেশ কয়েকটি যন্ত্রপাতির নমুনাও এনেছিলেন সঙ্গে করে। দেখিয়ে দিলেন কোনটার কাজ কী।
জানালেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল (ইইই) বিভাগে সহপাঠী ছিলেন সাইফুল্লাহ ও তানিয়া। ২০০০ সালে স্নাতক হন দুজনেই। বিয়ে করেন। ‘তারপর বছর দুই দেশে কাটিয়ে আমরা পড়তে যাই জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব কাসেলে। প্রথম সেমিস্টারে প্রায় ৯০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে আমি প্রথম ও তানিয়া দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে বৃত্তি পাই।
’ সেখানে তাঁদের বিষয় ছিল তড়িৎ যোগাযোগ প্রকৌশল। পাস করার পর দুজনে চাকরি করেন বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তিনির্মাতা ইনফিনিওন, সিমেন্স, ইনটেল ও কিমন্ডাতে।
ডি-র্যাম নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান কিমন্ডা ২০০৯ সালের দিকে লোকসানের মধ্যে পড়ে। চাকরি হারান সাইফুল্লাহ-তানিয়া। ‘তখন আমরা চিন্তা করলাম দুজনে মিলে কিছু করার।
দেশে ফিরে কিছু করতে চাইলাম। ’ বললেন সাইফুল্লাহ। সে সময় এক বন্ধু সাইফুল্লাহকে বলেন, দেশে গিয়ে সরাসরি কিছু করা কঠিন। এখানে (জার্মানি) কিছু তৈরি করে তবে দেশে যান। ‘এরপর ২০০৯ সালেই আমরা প্রতিষ্ঠা করলাম সাইনপালস।
’
শুরু হলো সাইনপালসের গবেষণা। প্রথমেই তৈরি করা হলো বাংলাদেশের জন্য ভেহিকল নেভিগেশন সিস্টেম। ‘কিন্তু ঢাকা শহরের ডিজিটাল মানচিত্র পুরোপুরি তৈরি না থাকায় ওই যন্ত্র কার্যকর করা গেল না। এরপর অন্য যন্ত্র তৈরি করা শুরু করি। ’ সাইনপালস এখন পর্যন্ত আইপিএসসহ পাঁচটি যন্ত্র তৈরি করেছে।
স্মার্টমিটার: বিদ্যুৎ খরচের হিসাব রাখার যন্ত্র এটি। এ মিটারের সুবিধা হলো বিদ্যুতের হিসাব রাখার জন্য মিটার রিডিংয়ের দরকার পড়বে না। কতটুকু বিদ্যুৎ খরচ হলো, তার তথ্য মোবাইল ফোনের জিএসএম নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে চলে যাবে কেন্দ্রীয় সার্ভারে। বিল সময়মতো পরিশোধ না করা হলে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কেউ যদি নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, তবে তাকে এসএমএসে সতর্ক করে দেওয়া হবে।
বিস্তারিত: http://smartmeter.sinepulse.com
স্মার্টহোম: নানা রকম যন্ত্রপাতি থাকে বাসাবাড়িতে। বাইরে বেরোনোর সময় সব কটি বন্ধ করার বিষয়টি মনে না-ও থাকতে পারে। তাই মো. সাইফুল্লাহরা তৈরি করেছেন স্মার্টহোম। এটি এমন এক ব্যবস্থা, যেটি দিয়ে দূর থেকে বাসার যেকোনো সুইচ চালু বা বন্ধ করা যাবে। বাসায় থাকলে সরাসরি বন্ধ করা যাবে।
আর বাইরে থাকলে এটি ইন্টারনেটের মাধ্যমে সুইচ চালু বা বন্ধ করতে পারবে। এটি দিয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয়টা বেশ ভালোভাবেই করে যাবে। বিস্তারিত: http://smarthome. sinepulse.com
টেলিহেলথ: এটা এমন এক যন্ত্র, যা বিভিন্ন চিকিৎসাযন্ত্রের সঙ্গে ওয়েবের সংযোগ ঘটিয়ে দেবে। রোগীর কাছে চিপ ভরা একটা কার্ড থাকবে। রক্তচাপ মাপার ডিজিটাল যন্ত্র, ওজন মাপার ডিজিটাল যন্ত্র, রক্তে চিনি পরিমাপ করার যন্ত্র ও ইসিজি যন্ত্র রোগী যখন ব্যবহার করবেন, তখন কার্ডটি এসব যন্ত্র থেকে সর্বশেষ তথ্যটি নেবে।
এরপর কার্ডটি কার্ড রিডারের মাধ্যমে ইন্টারনেটে থাকা রোগীর প্রোফাইলে তথ্যগুলো যোগ করে দেবে। চাইলে এ কার্ড দিয়ে জরুরি সময়ে চিকিৎসকের সঙ্গেও যোগাযোগ করা যাবে। টেলিহেলথের জন্য ইসিজি যন্ত্রটি সাইনপালসের তৈরি করা। http://telehealth. sinepulse.com
ড্রোন: চালকবিহীন হেলিকপ্টার বা ড্রোনও বানাচ্ছে সাইনপালস। নানা আকারের বেশ কটি ড্রোন ইতিমধ্যে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।
আগে থেকে দিকনির্দেশনা দেওয়া প্রোগ্রামের মাধ্যমে চলবে এ ড্রোন। আবার ইন্টারনেটের মাধ্যমে দূর থেকেও এটি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। বিস্তারিত: http://telehealth. sinepulse.com
তৈরি করতে চান দেশেই: ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তির গবেষণা ও উন্নয়নে বাংলাদেশি ছাড়া কাউকে নিয়োগ দিই না। ’ বললেন মো. সাইফুল্লাহ। জার্মানির মিউনিখ আর ঢাকায় আছে সাইনপালসের অফিস।
দুই জায়গাতেই চলছে গবেষণা। মিউনিখে কাজ করছেন ২৬ জন আর ঢাকায় সাতজন। সাইফুল্লাহ ও তানিয়ার প্রতিষ্ঠান কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের পণ্য বাজারে ছাড়বেন। প্রথমে বাংলাদেশের বাজারে পণ্য ছাড়ার ইচ্ছা তাঁদের। সাইফুল্লাহ জানালেন, ‘বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন করতে চাই।
সে চেষ্টাই করে যাচ্ছি। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।