আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভাষা বিড়ম্বনা, সব সম্ভবের দেশ- চীন: পর্ব ৬ [বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে]

ভুল করেছি,প্রায়শ্চিত্য করবো না, তা তো হয় না এমন কোন বিদেশী লোক পাওয়া যাবে না যে চীনে এসে ভাষা বিড়ম্বনায় পড়ে নাই, আমার এই বিড়ম্বনার শুরু হয়েছিল ঢাকা এয়ারপোর্টে চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সে উঠার সময়ই। ঢাবি ভাষা ইনস্টিটিউটে চাইনিজ ভাষা শিখতাম বিধায় মনের অজান্তেই এক ধরনের অহংকার জন্মেছিল, আরে চু চাং চি চিং তো পারি। এসময় CV তে ভাষা দক্ষতা হিসেবে চীনা ভাষা পারি একথাটা সুন্দর করে বোল্ড করে উল্লেখ করতাম। এখানে আসার আগে বাপ মায়ের সামনে ভাব নিতাম ....তোমরা অযথা টেনশন লিচ্ছ হে ...আমি তো চু চাং চি চিং পারি। এমন ভাব মুই কি হনু রে.. এটা ভাগতে বেশি সময় লাগে নি।

সিঁড়ি বেয়ে বিমানে উঠতেই প্রবেশপথে হাস্যময়ী দুই বিমানবালার সামনে মাথা নুইয়ে বললাম- নি হাউ (হ্যালো); তারাও দেখি প্রাণজুরানো, মনকাড়া, হৃদয় নিংড়ানো হাসি দিয়ে মাথা ঝুকিয়ে জানালো নি হাউ। এবার আমি আরও একটু ভাব নেওয়ার জন্য বললাম- নি হাউ মা (কেমন আছ), ব্যাস তাদের উত্তর শুনে টের পাইলাম আমার ভাষার গভীরতা ! মনের অজান্তেই জন্ম নেওয়া অহংকার এক্কারে চূর্ণ বিচূর্ণ হল। কারন তারা উত্তর দিছে - থিং হাউ (ভাল) কিন্তু আমি শিখছি হেন হাউ (ভাল)। পাইশতে পারলাম দুই পাতার বই পড়ে কোনদিন একটা নূতন ভাষা শেখা যায় না। ছোটোবেলা থেকে যে ইংরেজি শিখছি উহাই এখন ভরসা, কিন্তু বিধি বাম ঐখানেও দেখি আর এক কাহিনী; বিমানবালার সাথে কথা বলার সময় সে কয় ছ্যাঙ্ক।

আমি এখন আর বুঝতারিনা হেতা কোন ভাষা কইলো! চৈনিক লোকজন th এর উচ্চারন থ এর মত না করে ছ এর মত করে যেমন থ্যাঙ্ক কে ছ্যাঙ্ক, থিংক কে ছিঙ্ক। আমাদের দেশের অনেকেরই অভ্যাস আছে কথার শেষে ত্যাই ন্যা এসব যোগ করি, যাকে বলা হয়ে থাকে মুদ্রাদোষ। চাইনিজরা গণহারে সবাই এসব যোগ করে- নে-গ, আ, লা, ন্ যেমন বেইজিং এর লোকজন প্রত্যেকটা কথার সাথে আর লাগায়। এরা ইংরেজি বলার সময়ও এটা করে যেমন- no have la (নেই বুঝাতে) আমার সুপারশপ থেকে কেনা একটা জিনিস চেঞ্জ করা দরকার, গুগল ট্রান্সলেটর থেকে চেঞ্জের চাইনিজ শিখে গেলাম carrefour, ওখানকার দায়িত্বরত মেয়েটাকে বললাম- গাই বিয়েন (চেঞ্জ) ; ওমা একি, মেয়েটা নতুন গ্রাম্য বধুর মত মুখ আড়াল করে মুচকি মুচকি হাসছে ! শুধু তফাৎ নতুন বউয়ের ঘুমটা থাকে এর সেটা নেই। পরে শিক্ষককে এই ঘটনা বললে উনি জানালো গাই বিয়েন শব্দটা দুটি মনের বিনিময় বুঝায়।

তখন মনে পড়ল ও গুগল মামা তো সেই জিনিস যা কিনা "আমি বাংলায় গান গাই" এর ইংরেজী দেখায় i'm a cow song. এই গুগল মামা আরো ঝামেলা করে মানুষে মানুষে দ্বন্দ সৃষ্টি করে ! অনলাইনে একটা জিনিস কিনবো, qq তে এক বিক্রেতার সাথে চ্যাট করার সময় সে লিখছে- ই লিয়াং তোং সি ( 一两东西) ....এত দাম আমি গুগলে ট্রান্সলেট করলাম, বারোটা জিনিসের দাম ..এত টাকা। আমি কিনমু একটা, তোমারে জিগাইলাম দাম; আর তুমি কইতাছ ১২টার কথা, ১২টা দিয়া কি ঘোড়ার ঘাস কাটুম ! আসলে ঘটনা হইলো ই লিয়াং তোং সি মানে একটা অথবা দুইটা জিনিস। হায়রে......রে গুগল, ভুলভাল যাই দেখায় তারপরও এখনও আমার গুগলই ভরসা ! তবে মোবাইলে ইন্সটল করা ডিকশনারীও খুব কাজে দেয় ইংরেজী লিখি এরপর চাইনিজটা ওদের দেখাই। সমস্যা হয় অশিক্ষিত চাইনিজদের সাথে কথা বলার সময়, তখন পরিচিত কাউকে ফোনে জিনিসটা বলে মোবাইলটা ধরিয়ে দেই ঐ চাইনিজের কানে। আমার ল্যাবের এক চৈনিক মেয়ের সাথে যখনই কথা হয় তখন জিগাই- নি হাউ (হ্যালো), নি ছি ফান ল মা (খাওয়া দাওয়া করছ) এরপর আর কিছু কইতারি না, কিতা করুম চাইনিজ পারি না।

এরকম ৩ দিন একই কথা জিগাইছি, যাই হোক চারদিনের দিন মেয়েটার সাথে কথা বলবো এমন অবস্হায় আমি কিছু কওয়ার আগেই সে কয় "উঅ ছি ওয়ান ল" (আমি খাওয়া দাওয়া করছি) শালার কি যে লজ্জা পাইলাম .... যে লজ্জার কোন মাও বাপ নাই ! ভাষা না জানায় এরকম লজ্জা প্রতিনিয়ত পেয়েই যাচ্ছি। বইয়ে লেখা আছে miss এর চাইনিজ সিয়াও-চিয়ে, দোকানে গিয়ে লাস্যময়ী এক সুন্দরী রমণীকে ডাক দিছি সিয়াও-চিয়ে বলে; একি! দোকানদার মেয়েটি রেগে আগুন হয়ে উত্তর দিল- উঅ বু ফিয়েন-ই (আমি সস্তা না) ঘটনা বুঝার আগেই আমার চাইনিজ ফ্রেন্ড ওখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিল, যা বললো সেটা হল আমাদের দেশে বইয়ে লেখা নটি মানে দুষ্ট, কিন্তু কথা বলার ক্ষেত্রে কোন মেয়েকে দুষ্টু বোঝাতে নটি বলা হয় না কারন নটি বলে পতিতাদেরকে, তেমনি সিয়াও-চিয়ে বলতে পতিতা বোঝায়, এটাই কথ্যরুপ। আমার হাউজমেটকে এক চাইনিজ মেয়ে দাওয়াত দিছে, সে ইংল্যান্ডের; চাইনিজ মেয়েরা সাদা চামড়া আর নীল চোখ বড় পছন্দ করে। সে চাইনিজ ভাষা পারে না শুধু নি হাউ আর দুএকটা শব্দ পারে, রেস্টুরেন্টে পুরো ১ঘন্টা সময় কাটছে তাদের ইশারা ইঙ্গিতে। আমার মত যাদের চাইনিজে দৌড় অতি সামান্য তাদের ডেইলি কমিউনিকেশনের জন্য যেটুকু লাগে সেটা বোঝাতে গিয়ে প্রায় সময়ই বলার পাশাপাশি বডি ল্যাংগুয়েজ ইউজ করতে হয়, হাত পা নাচাতে হয়, শরীর দুলাতে হয়।

নিজেকে টারজানের মত বন্য প্রাণী মনে হয়। গলায় স্বর থেকেও বোবা হয়ে থাকতে হয়। আমাদের CNC Machine এর উপর একটা ল্যাব ক্লাস ছিল, টিচাররা তো আর ল্যাব করায় না, এক ল্যাব এসিসট্যান্ট ক্লাস নিবে কিন্তু সে ইংরেজি পারে না। একে তো fine, eat, very good এর মতো সহজ ইংরেজি না; মেশিনারিজের ইংরেজি। ঐ ল্যাব এসিসট্যান্ট ৩ জন চাইনিজ ছাত্র নিয়ে আসছে দোভাষী হিসেবে কাজ করতে, উনার পাশে ২জন দাঁড়াইছে আর ১জন কম্পিউটারের সামনে বসে আছে।

এই ২ জন যখন না পারছে তখন আর একজন ইন্টারনেটে fanyi.youdao তে ট্রান্সলেট করে আমাদের জানাচ্ছে। গুগলের মত চাইনিজদের নিজস্ব অনলাইন ট্রান্সলেটর আছে, এটা গুগলের তুলনায় অনেক বেশি সঠিক অনুবাদ করে। ল্যাব এসিসট্যান্ট কে দেখে আমাদর নিজেদেরই খুব খারাপ লাগছিল, বেচারা শীতের মধ্যেও ঘামছিল। এখানে আমি এক ভলান্টিয়ার এসোসিয়েশনের সদস্য, ওটার এক অনুষ্ঠানে এক মেয়ে নিজ থেকে আমার সাথে পরিচিত হতে এগিয়ে আসলো কিন্তু বিধি বাম, আমি পারি না চাইনিজ আর সে ইংরেজী। এখন কেমনে দুজনের মনের ভাব বিনিময় করা যায়।

অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ুয়া অন্য এক মেয়ে দোভাষী হিসেবে সাহায্য করতে এগিয়ে এসে সে নিজেই আমার সাথে প্যাঁচাল শুরু করল বাংলাদেশী টাইগারের কথা সে নাকি শুনেছে, তার বংশনাম বাঘ। এই মেয়ের ইংরেজী প্র্যাকটিসের কারনে আর হলো না নিজ থেকে এগিয়ে আসা মেয়েটির সাথে কথা বলা ! চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্ররা সিনিয়রদের তুলনায় ইংরেজীতে অনেক এগিয়ে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে ইংরেজী বলার ক্ষেত্রে জড়তা কাজ করে না, MS Phd ছাত্ররা ইংরেজী জানে কিন্তু বলতে লজ্জা পায়, প্রথম বর্ষের ছাত্রদের এই ভীতি নেই। এরা খুঁজে খুঁজে ফরেনারদের সাথে বন্ধুত্ব করে, বিদেশীদের আয়োজন করা অনুষ্ঠানগুলোতে যোগ দেয়। চীনে ফরেন স্টুডেন্টের সংখ্যা অনেক, আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি এখানে ৪০ টা দেশের ৩০০ জন আছে।

এই শহরটা বেইজিং শাংহাইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কোন সিটি না, নরমাল একটা শহর তাতেই এত ফরেন স্টুডেন্ট। শুনেছি শাংহাইয়ের Tong Ji বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪,০০০ ফরেন স্টুডেন্ট আছে। এটা চাইনিজ ছাত্রদের ইংলিশ ইম্প্রোভে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। এছাড়া সরকারের কিছু শিক্ষানীতি বেশ ফল দিচ্ছে, এগুলোর মধ্যে CET (college english test) পরীক্ষায় সবাইকে পাস করতে হয়। ভাল চাকরি পেতে হলে অবশ্যই CET- 6 পাশ করতে হবে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাইলে CET-4।

পরীক্ষাটা IELTS, TOEFL আদলে করা তবে লিসেনিং টেস্ট থাকলেও স্পিকিং টেস্ট নাই। আমাদের দেশে ইংরেজি পরীক্ষা মানে শুধু লেখা কোন লিসেনিং টেস্ট নাই, এদিক দিয়ে এরা এগিয়ে। এদের একটা টিভি চ্যানেল CCTV-4 যার অধিকাংশ অনুষ্ঠানের প্রত্যেকটা কথারই ইংরেজী সাব-টাইটেল থাকে,এমনকি চীনা গানেরও। তাই আমার মনে হয় আগামী ১০ বছর পরে চাইনিজ ছাত্ররা ইংরেজীতে আমাদের দেশের ছাত্রদের চেয়ে এগিয়ে যাবে বিশেষ করে বিদেশীদের সাথে কথোপকোথনের ক্ষেত্রে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.