অভিনেতা রাজু আহমেদ। তার সম্পর্কে এ প্রজন্মের না জানারই কথা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত শিল্পী এবং চলচ্চিত্র অভিনেতা ছিলেন তিনি। জল্লাদের দরবার শিরোনামে জনপ্রিয় ও মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধকারী অনুষ্ঠানে জল্লাদের ভূমিকায় অভিনয় করতেন রাজু। তার বলিষ্ঠ ও ভরাট কণ্ঠস্বরে অনুষ্ঠানটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠতো।
আমরা যারা রণাঙ্গনে ছিলাম তারা সবাই অনুষ্ঠানটি শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। নাটক পাগল রাজু আহমেদ অল্প সময়ের মধ্যেই যোগ্য অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ষাট দশকের সিনেমার একজন জনপ্রিয় খলনায়ক হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। এই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে ব্যতিক্রমধর্মী খলনায়কের মধ্যে রাজু আহমেদ অন্যতম। আমার সিনিয়র তিনি।
আমার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে নাটককে কেন্দ্র করে। আমি নাটক লিখতাম তিনি অভিনেতা করতেন। অভিনয় পেলে তার কোনো হুঁশ থাকত না। সব কিছু ফেলে অভিনয় নিয়েই পড়ে থাকতেন। জীবনের তাগিদে পাকিস্তানে থাকতে হয়েছিল তাকে।
করাচিতে অবস্থানকালে সেখানেও বাঙালিদের নিয়ে বাংলা নাটক মঞ্চায়ন করে সবার দৃষ্টি কাড়েন। করাচি থেকে ফিরে আবার কুষ্টিয়ায়। পেশা বলতে জীবন বীমার চাকরি আর নেশা বলতে নাটক। মঞ্চে তার অভিনয় এমনই প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল যে, নাটক দেখে তার বাচনভঙ্গি দর্শকরা অনুকরণ করত। ষাট দশকে মঞ্চে নাটক দেখে এমন প্রভাবিত হওয়া কম কথা নয়।
এর কিছু পরেই রাজু আহমেদ চলে আসেন ঢাকায়। রাজ্জাক-কবরীর তখন রমরমা বাজার। সেই মুহূর্তেই বাংলা চলচ্চিত্রে তার আগমন। পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন। স্বাধীনতার পর আবার চলচ্চিত্রে কাজ শুরু।
তার বিচরণ শুধু সিনেমাতেই সীমিত থাকেনি। বেতার, টেলিভিশনেও সমান আধিপত্য ছিল তার। টেলিভিশনে কাজী নজরুল ইসলামের 'রাক্ষুসী' নাটকে তার অভিনয় পরবর্তীকালে কারও পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। চলচ্চিত্রে তার অভিনয় দেখে প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হক ভূইঞা মিসরীয় অভিনেতা ওমর শরীফের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন তাকে। রাজু আহমেদের মধ্যে নাটক বা অভিনয় সম্পর্কে যে আন্তরিকতা দেখেছি আমার দীর্ঘ নাট্যজীবনে তেমন কারও মাঝে খুঁজে পাইনি।
শুধু মনেপ্রাণে অভিনেতাই ছিলেন না রাজু আহমেদ। ভালো মানুষ বলতে যা বোঝায় তার সব গুণই তার মধ্যে ছিল। কোনো অহংকার তাকে ছুঁতে পারেনি। যদিও অহংকার করার মতো যথেষ্ট গুণাগুণ তার মধ্যে ছিল। বরং তিনি ছিলেন আমাদের সবারই অহংকার।
আমরা তার জন্য গববোর্ধ করি। কুষ্টিয়ায় আমার বিচরণ। ঢাকার সঙ্গে তেমন সম্পর্ক ছিল না। রাজু আহমেদের ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল অনেক আগে থেকে। আমি ঢাকায় এলাম ১৯৭২ এর প্রথম দিকে।
রাজু আহমেদ আমাকে টেলিভিশনে নিয়ে গেলেন। টিভি তখন ডিআইটি ভবনে। আবদুল্লাহ আল মামুন বিটিভির নাটক বিভাগের প্রধান। রাজু আহমেদ আমাকে মামুন ভাইয়ের কাছে নিয়ে গেলেন এবং আমার সম্পর্কে অনেক কিছু বললেন। সেই থেকে আমি বিটিভিতে নাটক লেখা ও অভিনয় শুরু করলাম।
আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। টিভিতে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমি তার প্রতি চির কৃতজ্ঞ। শুধু বিটিভিতেই নয়, বাংলাদেশ বেতারেও আমাকে কাজ শুরু করিয়েছেন তিনি। বেঁচে থাকলে অবশ্যই তিনি আমাকে চলচ্চিত্রেও নিয়ে আসতেন। অনন্য প্রতিভার অধিকারি রাজু আহমেদ মুক্ত স্বাধীন দেশে তার অভিনীত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান জল্লাদের দরবার চলচ্চিত্রে রূপ দিতে চেয়েছিলেন।
আবদুল্লাহ আল মামুনের পরিচালনায় এই ছবির মহরত আনুষ্ঠানও হয়েছিল এফডিসিতে। কিন্তু তার কয়েক দিন পরই রাজু আহমদকে অাঁততায়ীর গুলির নিষ্ঠুর শিকার হতে হয়। সংস্কৃতি জগতের সবাইকে কাঁদিয়ে অনন্য এই প্রতিভা অকালেই ঝরে গেল। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো মাত্র ৩৩ বছর। ১৯৭২ সালের ১১ ডিসেম্বর রাজু আহমেদ আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে যান না ফেরার দেশে।
আজ ৪২ বছর পর তার স্মৃতিচারণ করতে এসে এই কথাই বলব- রাজু ভাই, তুমি যেখানেই থাকো ভালো থাক, শান্তিতে থাক।
লেখক : সাংবাদিক, নাট্যকার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।